X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

জয় হোক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফেনি-রাউজান মডেলের

রুমিন ফারহানা
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৪০আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৪০

রুমিন ফারহানা
মাত্রই শেষ হলো পাঁচ ধাপের পৌর নির্বাচন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের জাতীয় থেকে স্থানীয় যে কোনও নির্বাচন একটা প্যাটার্ন নিয়েছে। এই প্যাটার্নের মূল বৈশিষ্ট্য হলো– উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিএনপি প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া, অনেক ক্ষেত্রেই বিএনপি প্রার্থীর দ্বিতীয় স্থানেও না আসা,নৌকা এবং ধানের শীষের ভোটের অস্বাভাবিক ব্যবধান,বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট না থাকা,ভোটার উপস্থিতি খুব কম থাকা, সন্দেহজনক (যার ভোট নৌকায় নাও যেতে পারে) ভোটারদের নিরুৎসাহিত করা,নির্বাচন কমিশনের ‘কানে দিয়েছি তুলো’ মার্কা আচরণ। এসবের ফল দাঁড়িয়েছে ‘নৌকা মানেই জয়’ ধরনের নির্বাচন। সুতরাং অসংখ্য নির্বাচনেই দেখা গেছে নৌকার সাথে মূল লড়াই হয়েছে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীর এবং অনেক জায়গাতেই নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীও দাঁড়িয়ে গেছে। এ সব কিছুর সাথে এখন নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে নৌকার প্রার্থীদের নির্বাচনি বয়ান। কে ভোটকেন্দ্রে যাবে কে যাবে না, কে ভোট দেবে কে দেবে না, নির্বাচনটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে এসব কিছুই এখন ঠিক করে দিচ্ছেন নৌকার প্রার্থীরা।  

এই যেমন কিছুদিন আগে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ভাইরাল হয়েছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। তার উক্তিগুলো খানিকটা আব্দুল কাদের মির্জার মতো– নতুন কিছু বলেননি, বলেছেন আমাদের জানা কথাই, কিন্তু আওয়ামী লীগের মানুষের মুখ থেকে সরাসরি এভাবে মানুষ আগে শুনে অভ্যস্ত ছিল না। 

ভিডিওতে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর ভোট ঠেকাতে কৌশল শিখিয়ে দেন দেলোয়ার। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে পরিশ্রম করছি কিসির জন্যি? ভোটের জন্যি। এই ভোটগুলো কীভাবে বাড়ির কাছে আটকে দেব? গলির মদ্যি জামায়াত-বিএনপি। টুক করে ভোটের আগের রাত্রি গলির মদ্যি বুলে আসতি হবে, তুই বাড়ির মদ্যিতি নড়বিনে। নড়লি তোর খবর আছে। এবং তুই হচ্ছে রাজাকার, তুই হচ্ছে জামায়াত। ভোট করার কায়দা আছে, অনেক কায়দা আছে। ভোট আগে থাকতি কইরে ফেলতি হবে। স্যান্টারে যায়ে ভোট হবে না।’

এরপরের ঘটনাও অনুমিত। নির্বাচন অফিস তলব করে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান কাদিরকে। শোনা যায়, তিনি নাকি সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন এবং অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। মনে পড়লো দুদকের কথা– সরকার দলীয় কাউকে ডাকা মানে তাকে সার্টিফিকেট দিয়ে শুদ্ধ প্রমাণ করা।

মজার কথা হলো, উক্তিটি যিনি করেছেন, সেই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতিকে কিন্তু ডাকেননি নির্বাচন কর্মকর্তারা। তিনি যে উক্তি করেছেন সেটা পরিষ্কার বাংলায় ফৌজদারি অপরাধ। সেই বিষয়ে কি কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? না, নেওয়া হয়নি।  

যে ভদ্রলোকের উক্তি নিয়ে এই কথা হলো তিনি খুব তুচ্ছ নেতা নন। কিন্তু কেউ কেউ হয়তো বলবেন আওয়ামী লীগের পৌরসভা পর্যায়ের একজন মানুষের এমন উক্তিকে খুব গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তর্কের খাতিরে তা যদি মেনেও নেই তারপরও দেখা যাবে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঠিক একই ধারায় কথা বলেছেন।

ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় নির্বাচনি প্রচারণা সভায় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম বলেন, ‘যাদের মনে ধানের শীষের সঙ্গে প্রেম আছে, তারা কী করবেন? ১৩ তারিখে ঠাকুরগাঁও ছেড়ে চলে যাবেন। ১৩ তারিখ সন্ধ্যার পরে তাদের দেখতে চাই না। তাদের ভোটকেন্দ্রে আসার কোনও প্রায়োজন নাই। তাহলে ভোটকেন্দ্রে যাবে শুধু কে? নৌকা, নৌকা আর নৌকা।’

তিনি আরও বলেন,‘একদম পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, খাইদাই আমি জব্বারের, গান সালামেরটা গাইব না। কালকে থেকে রাস্তায় কোনও ধানের শীষের পোস্টার আমরা দেখতে চাই না। ধান বলে কোনও কথা নাই। ধানের শীষ বলে কোনও কথা নাই। আমরা শুধু দেখতে চাই নৌকা আর নৌকা। যদি ধান থাকে, তবে ধরে নেব এখানে আওয়ামী লীগ নাই।’ 

এই কথাগুলোও নতুন নয় আর সবার মতো আমরা জানি এই দেশে ভোট কীভাবে হয়, কীভাবে বিরোধী দলের এজেন্ট-কর্মী, এবং ভোটারদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আওয়ামী লীগের এক খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠনের দ্বিতীয় প্রধান মানুষটি বলছেন এসব কথা। এইসব উক্তির ক্ষেত্রে আরো খুব বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে - এসব কথা এখন আর প্রকাশ্যে বলতে তারা কোনও দ্বিধা রাখছেন না। 

সবকিছুর পরও যদি ভোটাররা যুদ্ধ করে ভোট কেন্দ্রে চলে যায়, তারপর যা ঘটে তার বিস্তারিত রিপোর্ট আমরা নিয়মিত পত্রিকায় দেখছি। প্রতিটি পৌর নির্বাচনের সময় খবর পড়েছি, ছবি দেখেছি, ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে বলে কোনও কক্ষ এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর থাকে না। ভোটাররা যখন তাদের ভোট দেওয়ার জন্য সেই কক্ষে যান, তখন সেখানে উপস্থিত থাকে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। বহু ক্ষেত্রেই ভোটটা তারাই দিয়ে দেন কিংবা ভোট দিতে বাধ্য করেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে। আবার এটাও ভাবার ব্যাপার আওয়ামী লীগের একজন লোকের সামনে দাঁড়িয়ে নৌকার বাইরে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা বা সাহস কয়টা মানুষের আছে? 

এই প্রক্রিয়া থেকে রেহাই নেই এমনকি পৌর নির্বাচনের মেয়র প্রার্থীর‌ও। কিছুদিন আগে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান নানা অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেন। তবে তিনি দেন এক ভয়াবহ তথ্য, বলেন– 

‘মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভা নির্বাচনে সকাল ৯টার দিকে আমার স্ত্রী সালিমা রহমান নুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়ম মেনে ভোট কক্ষে প্রবেশ করে। এরপর বহিরাগত যুবক গোপন কক্ষে উপস্থিত থেকে জোরপূর্বক ভোট নৌকা প্রতীকে দিয়ে দেয়। আমার স্ত্রী ধানের শীষে ভোট দিতে চেয়েছিল। পরে আমার পুত্রবধূ মিথিয়াও একই কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট দিতে পারেনি। তার ভোটও গিয়েছে নৌকায়। তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের অবগত করলেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি।’

বিএনপির পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও একটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিএনপি না থাকলে নির্বাচনটিতে নিজেদের লোকদের জিতিয়ে আনার জন্য এইসব নোংরা কূটকৌশল করতে হতো না। এই দেশের জনগণ এসব জানে, জানে আন্তর্জাতিক মহলও। কিন্তু তারপরও তাদের সামনে এই পরিস্থিতি বারবার আসা উচিত। বিএনপি নির্বাচনে না আসলে নিশ্চয়ই এইসব আলোচিত মানুষদের এতটা আগ্রাসী আচরণ আমরা দেখতে পেতাম না। 

দীর্ঘকাল জনগণের ম্যান্ডেটহীনভাবে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি নিশ্চয়ই মনে করে কেন তারা নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থেকে যেতে পারছে না। একটা প্রহসনের নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতেও নিশ্চয়ই এখন তাদের আর ভালো লাগে না। সত্যিই লাগে না, এটার প্রমাণও এখন দেখা যাচ্ছে। 

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে সংবাদ এসেছে দেশের দু’টি অঞ্চল নিয়ে – রাউজান আর ফেনী। 

রাউজান উপজেলায় ইউনিয়ন ১৪টি। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মধ্যে ১১টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এরপর ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

সেই রিপোর্টে জানা যায় সেখানে কোনও প্রার্থী বিএনপি তো বটেই এমনকি আওয়ামী লীগ করা কিন্তু সেখানকার সংসদ সদস্যের মতের বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারে না। ‌ সেখানে রীতিমতো পাহারা বসানো হয়। 

একই রকম ঘটনা ঘটছে ফেনী জেলাতেও। পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগেই মেয়র ও ১২ কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১৬ সালেও এখানে নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ওই বছরই অনুষ্ঠিত পরশুরাম উপজেলায় তিনটি ইউনিয়ন পরিষদেই চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

২০১৬ সাল থেকে পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই রীতি চলে আসছে।

২০১৬ সালে ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র ও ২৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একটি ওয়ার্ড ছাড়া ২৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত নেতা-কর্মী। এ ছাড়া ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত সবাই বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। সম্প্রতি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুর পরও একইভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে খায়রুল বাশার মজুমদার জয়ী হন।

এরপর জেলার ৬টি উপজেলায় ৪৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১০টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জেলার সোনাগাজী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জহির উদ্দিন মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

বিভিন্ন জায়গায় যে রকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তাতে এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে, ক্রমেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে রাউজান আর ফেনী মডেলের দিকে। অবশ্য তা নয়ই বা কেন নিরবচ্ছিন্নভাবে জবাবদিহিতাহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে এক সময় মনে হতেই পারে নির্বাচনের নামে এই প্রহসনই বা কেন?

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ