X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:২৬আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:২৬

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রচলন করার উদ্যোগের প্রতিবাদে বাংলার ছাত্র সমাজ জেগে ওঠে। ছাত্র সমাজের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে সরব হন। ভাষা আন্দোলনের ওই উত্তাল প্রেক্ষাপটে ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। বাংলার গণমানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওই জন্ম পরবর্তী সময়ে বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে। ফলে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বদলে যায় দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান স্মরণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দীর্ঘদিন এ দেশের ইতিহাসবিদরা ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই অমূল্য অবদানকে সচেতনভাবে আড়াল করে রেখেছিল। একটি স্বার্থান্বেষী মহল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কয়েক যুগ ইতিহাস বইগুলোয় ভাষা আন্দোলনের আলোচনায় কোথাও বঙ্গবন্ধুর অবদান স্বীকার করেনি। যদিও ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের উৎস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন সংগঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হন। মিছিল মিটিংয়ে আওয়াজ তোলেন। কয়েকবার কারারুদ্ধ হন।

ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন। তিনি দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমন করেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় অংশগ্রহণ, জোরালো সমর্থন দেওয়া ও নীতিনির্ধারণী নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ওই সময়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়োজিত বিভিন্ন মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। তিনিই প্রথম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা ঠিক করবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করার জন্য তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে আহ্বান করেন।

ওই বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়। ওই মাসেই রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন বুদ্ধিজীবী সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য দাবিসহ যে ২১ দফা দাবি সংবলিত ইশতেহার প্রকাশ করেন, ওই ইশতেহার প্রকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা এবং স্বাক্ষরদাতা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন দশ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ছিল অন্যতম। তিনি ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুলে ছাত্রদের যে ক্লাস বর্জন, ধর্মঘট ও মিছিল হয় তার সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালনের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনকে আরও জোরালো করেন। ছাত্রদের মনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপনের মন্ত্র গেঁথে দেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ওই হরতালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নেতৃত্বের অগ্রভাগে। ফলে পাকিস্তানি সরকারের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।

পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার ছাত্রদের কাছে নতি স্বীকার করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পান। তবে শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তি মানতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নয়ছয় শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। এই পর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জোরালো ভূমিকা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের উছিলা খুঁজতে থাকে। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেফতার করার সেই মওকা পেয়ে যায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে জেলে আটকে রাখে পাকিস্তানি সরকার। দীর্ঘদিন মুক্তি না মেলায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তাল আন্দোলনের সময়ে তিনি জেলে বসেই ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেন। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য জেল থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বার্তা পাঠান তিনি।

ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রেও তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার বিপক্ষে অবস্থান নিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চেষ্টায় সোহরাওয়ার্দী তার মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। সোহরাওয়ার্দী রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিকে সমর্থন করে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের আইন পরিষদের অধিবেশনে অধিবেশন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ ও বিতরণ করার দাবি করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। তার ওই দাবির পূর্ণতা পায় পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারই দাফতরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলন করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরকার সরকারি অফিসে বাংলা ভাষা প্রচলনের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেন।

বঙ্গবন্ধুর সরকারের মতোই ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ভাষা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতায় ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর অধিবেশনে জাতিসংঘের ১৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে। ওই ঘটনার প্রায় এক দশক পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদেই ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকেই সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

এভাবে সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন এ দেশের তরুণ, যুবা, ছাত্রসমাজ, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীরা, তার ফলে শুধু বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ লাভ করেনি। বরং বাংলা ভাষা ও বাঙালির রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রামের স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্বসভায়। জাতিসংঘে। বাংলার দামাল ছেলেদের মায়ের ভাষা রক্ষার দাবিতে প্রাণ উৎসর্গ করার দিনটি আজ পালন হচ্ছে দেশে দেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বের ভূমিকা থেকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। আর তার যোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাষা আন্দোলনের দিনটি তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার কৃতিত্বের রাজনৈতিক দল হিসেবে সব সময় সারথি হয়েছে আওয়ামী লীগ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ