পাপ
বৃত্তের চারপাশে পাপ থাকে
বহুবিধ রঙঘরে
লাল-নীল-হলুদ পাপ
ঘিরে থাকে চন্দ্রচ্যুত মন।
সাঁতার জানি না, না ছলাকলা
ডুবে আছি আকণ্ঠ শুভ্র-প্রপাতে
বৃত্তের সীমারেখা পাথর মেনে
ক্ষয়ে যায় হরিণজীবন!
জল-তৃষ্ণার মরীচিকা শেষে
রাখি শরীর বৃষ্টির নিচে
সমুদয় আলো রাত্রিতে মুছে গেলে
পাপঘরে ছুঁয়ে যায় মন।
আমাকে যে নিতে এলে
ঘোরের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে যাচ্ছি কোথাও
ঠিকানা জানি না, কোনো পরিচয় নেই আমার
পকেট হাতড়ে কবে থেকে খুঁজে ফিরছি তেল জবজবে চুল,
লাঙ্গল, হালচাষের দুখানি গরু আর পোড় খাওয়া মাথাল...
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার হাতখানা দেখি—
তোমার হাতে কি আছে পাটের গন্ধ, কাস্তের দাগ
তোমার গায়ে কি লেগে আছে কাদা, ধান আর
বৃষ্টি পড়ার শাব্দিক আখ্যান?
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার মুখখানি দেখি—
তোমার চোখে কি আছে পূর্ণিমার চাঁদ
জোয়ার, ভাটা, গহিন গাঙের স্রোত...
তোমার ঠোঁটে কি আছে ডাল-ভাত, কাচামরিচের খেত
আছে কি মায়ের আঁচল, আদর, রোদ-মেঘের হাসি?
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার হাত, মুখ আর চোখ দেখি
একবার মিলিয়ে নেব রক্তের গন্ধ, কম্পন...
তবে এসো, বাড়িয়ে দাও হাত—
ফেরারি হব আজন্ম, ফেনিল স্রোতে...
মিথ্যুক আবশ্যক
বিধিমোতাবেক একজন মিথ্যুক নিয়োগ করা হবে
বেজন্মার মতো যার কথা হবে জন্মপরিচয়হীন
যে নিয়ম করে অসংখ্য মিথ্যা বলবে রোজ রোজ
ছাই দেবে বিনম্র লোকের মুখে মুখে
মিথ্যের ভেলকিতে পাড়া মাত হবে
কুপোকাত হবে ভদ্র-সুধীজন,
শুয়োরের বাচ্চাতুল্য এমন একজন
খাঁটি মিথ্যুক জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক।
আগ্রহী মিথ্যুকগণ আবেদন করুন কুৎসিত ছবিসহ
খুব দ্রুত করুন, সময় যে খুব কম
বেতন নিয়ে ভাববেন না একদম
বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ, হিরে-মুক্তো-মানিক যা প্রয়োজন
বাড়ি-গাড়ি মদ-বেশ্যা যার যা প্রয়োজন অকাতরে দেবো
বিনিময়ে আমি কেবল একজন জাতমিথ্যুক চাই
বেজন্মার মতো যার কথা হবে জন্মপরিচয়হীন...
বিলুপ্ত পুরুষ
একটি পাতার ওপর দাঁড়ালেই
ঘোর বৃষ্টি নামে সুঠাম শরীরে
ঝুম শব্দে কাঁপে নদী
দিগন্ত গিলে নেয় শ্বাস
জেগে ওঠে হন্তারক চোখ
হাঁটে লক্ষ্যহীন, উন্মত্ত ক্ষীপ্রতায়—
চারদিকে জমে আমারই মৃতদেহ!
যুগান্তর ডাক দিলে
একটি পাতার ওপর দাঁড়াতেই
প্রতিটি যুদ্ধ থামে
প্রতিটি নারী তখন ফলবতী
সংসারে—প্রতিটি সন্তান দুধে ও ভাতে!
আমি এক বিলুপ্ত পুরুষ
খুন করি নিজেরই শরীর
যুগান্তর-প্রতীক্ষায়...
কাছের বাঁশি
সমুদ্র কাছে এলে
আঁচল কেন দূরে রাখো মেয়ে
কি অত ভয়
কি বিস্ময়
ফেরি করে ফেরো অচেনা বন্দরে?
আমি তো প্রাচীন রাখাল
বাঁশি ফেলে দূরে
বেজে যাই তীব্র একা
প্রতিরাতে না-ফেরা ঘরে!
আমাকে কাছে রাখো চুড়ি, কপালের টিপ
অলসদুপুর রাখো, জলেভাসা দীপ
রাখো স্পর্শ—অনন্ত মদিরায়
রাখো আকণ্ঠ ডুবে যেতে যেতে
অতল গহিনে...
সমুদ্র কাছে এলে
ফিরে এসো মেয়ে, অনন্ত দহন রেখে...
সত্তার রঙ
বৃক্ষ থেকে উজ্জ্বল সবুজ
আর আসমান থেকে মেঘ মেখে
তোমার দুটি ঠোঁটের লজ্জা
অব্যর্থ কিছু দৃষ্টি নিয়ে
আঁকা হবে আজ অনন্ত চুমুক।
মানুষ এনেছে মাতাল রাত্রি
উৎসুক চোখে জ্যোৎস্নার সাজ
যেন ফিরেছে পিকাসোর তুলি
ফিরেছে ভিঞ্চি... এবং
আবার আঁকা হবে মোনালিসা!
বিভ্রম জগৎজুড়ে রঙের জলসা
আঁকি বছর, শতাব্দী, মহাকাল
আঁকি নিজের মুখ অকপটে
আঁকি মুখোশ, সেতার বাজনা...
অন্ধ যেমন চেনে না রঙ
চেনে না প্রভেদ, জ্যোৎস্নার তির
অবুঝ মানুষ তেমনি ফেরে ঘরে
পড়ে থাকে রঙ এবং জীবন
তারপর সবুজ ফিরে বৃক্ষে, পাতায়
আসমানে ফেরে মেঘ
তোমার দুটি ঠোঁট তোমারই থাকে
উষ্ণতাবিহীন...।
শিল্পী নিহত হলে রঙ মুছে যায়
মুছে যায় জীবন, তীব্র চুমুক...।
পরিভ্রম
অফুরান অবসরে এক এক করে পাতা ঝরে যাচ্ছে
হাওয়ায় দুলছে অলস গল্প, আঙুল থেকে মুছে যাচ্ছে পিয়ানোর পরশ
আমি বসে আছি উদোম, কোনো এক গানে—
শুনে যাচ্ছি ঝাউবন, মায়াবনবিহারিণী...
চোখ পেতে দেখি উচ্ছল এক নদী ফিরছে বাড়ি
বৃক্ষের গায়ে লেগে আছে প্রগাঢ় চুম্বন
আলাদীন গোপন রাখে ইচ্ছের দৈত্য, সমস্ত জাদুবল
আমিও রই গোপনে...
পার হয়ে সিন্ধুনদী, হেঁটে যাই নগরীর কোণে
জনারণ্যের প্রাচীর ভেঙে একলা দাঁড়াই—একা!
কেউ নেই, চারপাশে চৈত্রের মলিন হাহাকার
একটু দূরে এক এক করে অবসরে পাতা ঝরে যায়
আর আঙুলে লেপ্টে থাকে পিয়ানোর পরশ...
আলাদিনের দুঃখ
ধীর-পায়ে যে রাত নেমে গেছে অনন্তে
তার পিছু হাঁটি সর্বত্র
আমি আর সেই গল্পের আলাদিন
প্রদীপ নিয়ে ঘুরি জলে-জঙ্গলে
মানুষ হৃদয়ে—
কাছে থাকি প্রতিটি মন্ত্রে
শুনি জাদুধ্বনি—‘আদেশ করুন জাঁহাপনা!’
আমি আদেশ করতে পারি না
অগনিত শকুন খেয়ে নেয় চোখ
কুকুর স্বভাবে বাড়ে দাঁতাল মানুষ,
আর যান্ত্রিক চিৎকার...
ক্ষয়িষ্ণু মানুষ ছায়াশরীর হলে
আমি নীরব-নক্ষত্রে হারাই
আলাদিন ফেরে না গ্রামে!