X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবুন

ফারাবী বিন জহির
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:০৯আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:০৯

ফারাবী বিন জহির একটি ধ্রুব সত্য হচ্ছে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনও জাতি উন্নতি লাভ করতে পারেনি, এমনকি ভবিষ্যতেও পারবে না। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সেই জাতি তত বেশি উন্নত। কিন্তু শিক্ষা তখনই যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হবে যখন সেই শিক্ষা হবে উন্নত মানসম্পন্ন। আর এই উপযুক্ত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই এই কথা অবধারিত সত্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

করোনা এই মুহূর্তে পৃথিবীজুড়ে বয়ে যাওয়া আতঙ্কের নাম। এই করোনা নামক ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানব জাতির জীবনযাত্রা পুরোপুরি থমকে গেছে এই ভাইরাসের কারণে। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলাদেশেরও এমন কোনও খাত পাওয়া যাবে না যা করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাংলাদেশে করোনাকালে অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যদি একেবারে শুরুর দিক থেকে আলোকপাত করি তাহলে দেখবো দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ১৭ মার্চ থেকে সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এই পৌনে ছয় কোটি শিক্ষার্থী তখন থেকে ঘরবন্দি, সঙ্গে ছিল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। এপ্রিলের এক তারিখ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমনা পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তাও সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশজুড়ে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত (প্রায় পৌনে ছয় কোটি) যে পরিমাণ শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করে তা পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। আচমকা করোনাভাইরাসের ছোবলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা হতবিহবল হয়ে ওঠে। যেহেতু করোনাভাইরাস অভিজ্ঞতা ছিল বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন, তাই অন্যান্য খাতের মতো এই খাতটিকেও বেশ সংকটময় মুহূর্ত কাটাতে হয়। পরবর্তীতে এই সংকটময় মুহূর্তকে মাথায় রেখে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যদিও এই অনলাইন ক্লাসকে ঘিরেও ছিল বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক। যেহেতু বাংলাদেশে সব অঞ্চলে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক সমান শক্তিশালী নয় তাই এই অনলাইন ক্লাস করতে বেশ বেগ পেতে হয় শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয় ইন্টারনেটের মূল্য। এক একটি ক্লাস করার জন্য যে পরিমাণ ডাটা প্রয়োজন সেই পরিমাণ ডাটা কেনার অর্থ প্রদানের ক্ষমতা বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থীর অবশ্যই নেই। তারপরেও লকডাউনে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে চলছিল এই অনলাইন ক্লাস।

কিন্তু বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক তখনই হয় যখন অন্যান্য খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেসব খাতের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লকডাউন তুলে নিয়ে অফিস-আদালত, বাজার-ঘাট সব উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষা খাতের বেলায় এই ধরনের কর্ম তৎপরতা একেবারেই অনুপস্থিত থাকে। কর্তৃপক্ষ শুধু শিক্ষা খাতের বেলায় একের পর এক ছুটির ঘোষণা দিয়ে দায় সারতে থাকেন। যে দেশে সিনেমা হল বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেই দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কেবল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া ছুটি বৃদ্ধির খড়গ ঝুলতে থাকে এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শিক্ষার্থীর করোনাকালীন নিরাপত্তার কথা! তাহলে কি শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেই অনিরাপদ?

স্বভাবতই এমন সিদ্ধান্তের ফলে যে প্রশ্নগুলোর উদ্রেক হয় তা হলো পৃথিবীর কোনও গবেষণাপত্রে এমন কোনও প্রমাণ কি পাওয়া গেছে যে করোনাভাইরাস শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করে? তা না হলে বারবার করোনাভাইরাস বিস্তারের দোহাই দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ রাখা হচ্ছে? যে দেশে শপিং মল, গণপরিবহন, দূরপাল্লার পরিবহন, অফিস-আদালত, বাজার-হাট সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কীভাবে করোনাভাইরাস বিস্তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো, একজন শিক্ষার্থী কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শুধু ঘরে অবস্থান করে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকবে, যেখানে তার পিতা কিংবা মাতা অথবা পিতা-মাতা উভয়কেই জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন বাইরে যেতে হচ্ছে? তারা হয়তো গণপরিবহনে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে যাচ্ছেন এবং কর্মস্থলে কাজ শেষে আবার বাসায় ফিরে আসছেন। একই ঘরে অবস্থান করা শিক্ষার্থী তার পিতা-মাতার মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আর বিষয়টি যদি হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাহলে তো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সমস্যা কোথায়? বিনোদন কেন্দ্র বা সিনেমা হলে শিক্ষার্থীদের প্রবেশে কোনও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। সেখানে যদি তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ করতে পারে তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সমস্যা কোথায়? যদি প্রশ্ন আসে গাদাগাদি করে অবস্থানের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে না তাহলে স্বভাবতই যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গাদাগাদি করে বসা হয় গণপরিবহনে আর সেই গণপরিবহন অবাধে চলতে দিয়ে একই অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা কী? সমাজ জীবনে সব জায়গায় স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনে শিক্ষার্থীদের কীভাবে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? বিশেষ ছুটির দিনগুলোকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যে লাখ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটছে সেখানে যে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? শিক্ষার্থীরা কি সমাজের বাইরে বসবাসরত কোনও গোষ্ঠী? এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে কওমি মাদ্রাসা খুলে দিয়ে দিয়ে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার পেছনে যুক্তি কী?

আবার আলোকপাত করা যাক এই শিক্ষার্থীরা অনলাইনের ক্লাস নামক আপৎকালীন ব্যবস্থার ফলে কী ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের ব্যবহারিক কোনও ক্লাস কিংবা পরীক্ষা কোনোটি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একজন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য ব্যবহারিক ক্লাস কত গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বলা হচ্ছে এই ব্যবহারিক ক্লাস পরে নেওয়ার কথা। বন্ধের গ্যাঁড়াকলে জমে থাকা ব্যবহারিক ক্লাস এবং বন্ধ শেষ হওয়ার পর যে নতুন সেমিস্টারের ব্যবহারিক ক্লাস মিলে যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হবে, সে অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কী শিখতে পারবে তা তো কেবল বিধাতাই জানেন!

এ তো গেলো ব্যবহারিক ক্লাসের কথা, এবার আসি নিত্যনৈমিত্তিক ক্লাসের নামে যে অনলাইন ক্লাস করানো হয় সেই বিষয়ে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে শিক্ষার্থীরা দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্কের কারণে একটি অনলাইন ক্লাসের কতটুকুই বা শুনতে পাচ্ছে? একজন শিক্ষার্থী যদি তার ক্লাসের লেকচার ঠিকমতো শুনতেই না পারে তবে সেই ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এরপর আরেকটি হতাশাজনক পরিস্থিতির অবতারণা হয় অনলাইন পরীক্ষা নামক পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে। অনলাইনে নেওয়া পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব? শিক্ষক একটি প্রশ্ন অনলাইনে আপলোড করে দিচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা সেই প্রশ্ন ডাউনলোড করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর লিখে শিক্ষককে ফেরত দিচ্ছেন। এখন সেই প্রশ্ন পেয়ে আসলে কী বই দেখে লেখা হয়েছে নাকি অন্য কারও সাহায্য নিয়ে লেখা হয়েছে? অনলাইন পরীক্ষায় এই বিষয়গুলোর উত্তর জানা কি সম্ভব? অনলাইন পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ কি সম্ভব? মানহীন পরীক্ষার মূল্য কতটুকু? নিঃসন্দেহে বলা যায় আপৎকালীন ব্যবস্থা তথা অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা যত বেশি প্রলম্বিত হবে, শিক্ষা ব্যবস্থা ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি বিষয় আমাদের বুঝতে হবে যে ব্যবসায়িক খাতের মতো শিক্ষা খাতের ক্ষতির মূল্য নগদ অঙ্কে নিরূপণ সম্ভব নয়। কিন্তু এই শিক্ষা খাতের বিন্দুমাত্র ক্ষতি অন্য যেকোনও খাতের যেকোনও অর্জনকে মুহূর্তে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে। তাই সময় এসেছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার। এই সত্যটি অনুধাবন করতে হবে যে শিক্ষা খাতের প্রতি বিন্দুমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

লেখক: অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ