X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জরিমানায় ভাষাপ্রেম!

আমীন আল রশীদ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:২৭আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:২৭

আমীন আল রশীদ
গত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে চট্টগ্রামের একটি খবর নজরে আসে। বনভোজনের গাড়িতে হিন্দি গান বাজানোর অপরাধে চালককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। খবরে বলা হয়, শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজা এলাকা দিয়ে বনভোজনের একটি ট্রাক বেপরোয়া গতিতে ও উচ্চস্বরে হিন্দি গান বাজিয়ে অতিক্রম করছিল। এ সময় গাড়িটি থামানোর সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু চালক তা না মেনে গতি বাড়িয়ে চলে যান। পরে দুই কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ক্রসিং এলাকা থেকে গাড়িটি আটক করা হয় এবং চালককে জরিমানা করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট জানান, বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ ও প্রসারের জন্য এমন জরিমানা অব্যাহত থাকবে।

একই দিন চট্টগ্রামের আরেকটি সংবাদে বলা হয়, ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলকে ‘বিজাতীয়’ ভাষা সরিয়ে বাংলা লেখার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ নির্দেশনা অমান্য করলে আইনের আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনের তিন জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে বাংলা ভাষা প্রচলন নিশ্চিতে সতর্ককরণ অভিযান পরিচালনাকালে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ সময় প্রায় ২০টি দোকান ও প্রতিষ্ঠানকে বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড না থাকার জন্য সতর্ক করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরও চট্টগ্রামে ইংরেজিতে লেখা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড লাল কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন হলো, জরিমানা করে কিংবা ইংরেজি তথা বিদেশি ভাষার সাইনবোর্ড পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়ে কী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা যায়? তাছাড়া প্রতি বছর মাতৃভাষা দিবস এলেই কেন এরকম তৎপরতা চোখে পড়ে? এখানে ভাষাপ্রেম নাকি কাজ দেখানো—কোনটা মুখ্য? মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও তার মর্যাদা রক্ষার অর্থ কি এই যে, বিদেশি ভাষা শেখা যাবে না বা বিদেশি ভাষায় সাইনবোর্ড টানানো যাবে না?

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডের মানুষের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, এটি যেমন ঠিক, তেমনি এই আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং সারা বিশ্বের সকল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও অনুপ্রেরণা। যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। অতএব, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কেউ হিন্দি গান বাজালে কিংবা ইংরেজিতে সাইনবোর্ড লাগালে জরিমানা করাটা যৌক্তিক ও ন্যায্য কিনা— সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া সারা বছর যদি হিন্দি গান শোনায় কিংবা ইংরেজিতে সাইনবোর্ড লেখা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হয় এবং জরিমানা করা না হয়, তাহলে কেবল বছরের একটি দিনে এসে এরকম তৎপরতা কী অর্থ বহন করে?

তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে আমরা কী করে উদযাপন করবো বা মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা রক্ষায় নাগরিক ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী?

১. নাগরিকদের দায়িত্ব তার নিজের, অর্থাৎ বাংলাদেশের যে অঞ্চলে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে তার প্রাথমিক পরিচয় থাকতে হবে। কারও বাড়ি নোয়াখালীতে হলে তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষায় কথা না বললেও সেই ভাষার সঙ্গে পরিচিত থাকবেন, সেই ভাষার অনেক শব্দ জানবেন এবং পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে কেউ ‘নোয়াখাইল্যা’ ভাষায় কথা বললে তিনি গর্বিত বোধ করবেন, আনন্দিত হবেন— এটিই তার ভাষাপ্রেম।

২. নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব, যে বাংলা তার সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা, সম্ভব হলে সেই ভাষার প্রমিত বানান ও উচ্চারণ শেখা। বিশেষ করে যারা শিক্ষিত। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পাননি বা বেশিদূর যেতে পারেননি, তাদের কাছ থেকে প্রমিত বানান ও উচ্চারণ আশা করা অনুচিত। কিন্তু শিক্ষিত মানুষ তার মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে লিখতে ও বলতে পারবেন— এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শিক্ষিত মানুষদের একটি বিরাট অংশই প্রমিত বাংলায় লিখতে ও বলতে পারেন না। শিক্ষকদেরও বড় অংশ প্রমিত বাংলা জানেন না।

৩. নাগরিকের দায়িত্ব, তিনি যে মাধ্যমেই পড়াশোনা করুন না কেন, তার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে মাতৃভাষা। বাংলাদেশি একজন নাগরিক ইংরেজি মাধ্যমে বা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও প্রমিত বাংলাও যাতে তিনি রপ্ত করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাটি তার পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে।

৪. রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সেই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে সকল প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত ও সহজ কারিকুলাম নিশ্চিত করা। ব্যাকরণের মোটা বই দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাথা ভারী করে দিয়ে মাতৃভাষা শিক্ষাকে কঠিন করে তোলার যে প্রয়াস বছরের পর বছর ধরে চলছে, সেটি দূর করার কোনও কার্যকর পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়ে না।

৫. রাষ্ট্রের একটি বড় দায়িত্ব, সেই ভূখণ্ডে রাষ্ট্রভাষার বাইরে আরও যেসব ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করেন, তারা যাতে ভাষার কারণে রাষ্ট্রের কোথাও, চাকরি বা অন্য কোনও সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা।

৬. রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেই ভূখণ্ডের রাষ্ট্রভাষার বাইরে আরও যেসব ভাষা রয়েছে, সেগুলোর মর্যাদা রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের নিজেদের ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করা। এই ইস্যুতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক কাজ হলেও তা এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেনি।

৭. প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় না কি অন্য কোনও ভাষায় লিখিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ব্যক্তির। এখানে রাষ্ট্রের জবরদস্তি করার সুযোগ নেই। তবে রাষ্ট্র সবাইকে বাংলায় সাইনবোর্ড লিখতে উৎসাহ দিতে পারে।

৮. মাতৃভাষা দিবস মানে ওইদিন বাংলা ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না বা অন্য কোনও ভাষার গান বাজানো যাবে না— এরকম অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। বরং নাগরিকদের মনে যদি মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদার বিষয়টি গেঁথে দেওয়া যায়, তাহলে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ দিনে তারা হিন্দি গান বাজাবে কী বাজাবে না। এটি পুলিশিং দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয় নয়।

পরিশেষে…

আমাদের দুর্ভাগ্য, সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বলে উল্লেখ করা হলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসেও একটি ভাষানীতি বা ভাষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এখনও উচ্চ আদালতের রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। যদিও গত একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন জানিয়েছেন, ইংরেজিতে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আদেশ প্রয়োজনে সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলায় অনুবাদ করা হবে, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে।

উল্লেখ্য, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার উন্মোচন করে। যা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শীর্ষ আদালতের আদেশ ও রায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করবে।

যদিও আদালতের রায় লেখা বা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে একটা বড় জটিলতা হলো আইনের ভাষা ও বহু শব্দের উপযুক্ত বাংলা না থাকা। যে কারণে বহুদিন ধরেই এই দাবিটিও রয়েছে যে, সব আইন বাংলায় করতে হবে। এরই মধ্যে বেশ কিছু আইন, বিশেষ করে পুলিশ আইনও বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। এখন আদালত বা বিচার বিভাগ সম্পর্কিত সব ইংরেজি ও বিদেশি শব্দের যুৎসই বাংলা করতে হবে। সেই চেষ্টা অবশ্য চলছে।

বাংলা একাডেমি নামে একটি বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানের অভিধানও সব গণমাধ্যম অনুসরণ করে না। বরং অনেকেই নিজেদের মতো বানান রীতি তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো, কোনও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তার নিজের মতো করে বানান রীতি করতে পারে কিনা? সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান থাকার কী প্রয়োজন? আবার একই বানান একজন পাঠক বাংলা একাডেমির অভিধানে একরকম এবং গণমাধ্যমে আরেকরকম দেখলে তিনি কোনটি গ্রহণ করবেন? পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় কোন বানানটি লিখবেন?

জাতীয় সংসদের স্পিকারের রুলিং দেওয়ার পরও দেশের একটি শীর্ষ বাংলা সংবাদপত্র এখনও সংসদ সদস্যদের ‘সাংসদ’ লেখে। অথচ ‘সাংসদ’ শব্দটি বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত নয়। প্রশ্ন হলো, ওই সংবাদপত্র কি জাতীয় সংসদকেও চ্যালেঞ্জ করছে? রাষ্ট্রের একটি ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা থাকলে কি কোনও গণমাধ্যম নিজের মতো করে বানান তৈরি করতে পারতো?

আবার বাংলা একাডেমিও বানান হালনাগাদ করার যুক্তিতে ‘শহীদ’ ও ‘ঈদ’-এর মতো অতি পরিচিত এবং মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া তথা মানুষের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার অনেক বানান বদলে দিয়েছে, যা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে চায় না। ফলে পুরো বিষয়গুলো নিয়েই যে ধরনের খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার, তা অনুপস্থিত।

ভাষার সিঁড়ি বেয়েই যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং যেহেতু আমরা এখন সেই স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে— ফলে এরকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণেই রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা নিশ্চিত করা, ভাষায় জোরজবরদস্তি এড়িয়ে শৃঙ্খলাবিধান এবং সেই সাথে বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য আঞ্চলিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় একটি ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেইসাথে ১৯৮৭ সালে যে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়েছে, সেটিও হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেনাকাটার একাল-সেকাল
অনলাইন শপিংকেনাকাটার একাল-সেকাল
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ