X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বন্ধ’ হলেও দিব্যি আছেন তারা

মাসুদ আলম, কুমিল্লা
০৪ মার্চ ২০২১, ০১:১২আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২১, ০১:১২

বন্ধের সময়েও সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্য করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) হলগুলোতে বেশ কিছু ছাত্রকে হলে অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এদের বেশিরভাগই সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। প্রশাসন থেকে হলে অবস্থান নিষিদ্ধ করা হলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মানছেন না, চারটি হলের প্রভোস্টদের জ্ঞাতসারেই হলে নিয়মিত অবস্থান করছেন তারা। এদের কেউ পরীক্ষার দোহাই দিয়ে, কেউ বা লেখাপড়ার দোহাই দিয়ে ক্যাম্পাসে থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। যদিও প্রশাসনের আইন প্রয়োগের কঠোরতা দেখা গেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেলায়। তাদের হলে অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৭ মে থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে আবাসিক হল খুলে দেওয়া হবে এবং ২৪ মে থেকে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সব ধরনের পরীক্ষা, ক্লাস বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এসময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ এর টিকা নিতে বলা হয়েছে তাদের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিকা নিয়ে তবেই তারা হলে উঠতে পারবে। এর আগে করোনা সংক্রমণের ভয়ে গত বছরের মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। মাঝে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালানোর নির্দেশ থাকলেও নানা কারণে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠদান পদ্ধতি আশানুরূপ সফল হয়নি। এ কারণে সেমিস্টার পরীক্ষা সশরীরে হাজির হয়ে দেওয়ার দাবি ছিল শিক্ষার্থীদেরই। এজন্য বেশিরভাগ ক্যাম্পাসে সংশ্লিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে এলেও তাদের থাকতে হয়েছে আশেপাশের মেসগুলোতে। তবে পরীক্ষার কারণে এবং ক্লাস করা, বই-খাতা নেওয়া ইত্যাদি অজুহাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের আগমন প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে দরীয় পদ পদবীর প্রভাব খাটিয়ে অনেক ছাত্রলীগ নেতা নিজের কক্ষেই রাতযাপনের জন্য উঠে গেছেন। প্রশাসন বিষয়টি জানে। হল প্রভোস্টদের সবাই বিষয়টি অবগত। তবে কেউ নিয়ম না মানায় চারটি হলে ছাত্রনেতাদের অবস্থান এখন ওপেন সিক্রেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধভাবে তারা হলে থাকছেন। এই পরিস্থিতিতে গত সোমবার (১ মার্চ) রাত ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে কুবি শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত দুই শিক্ষার্থী আহতও হয়েছেন। আহত দুই শিক্ষার্থী হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় দত্ত হলের ছাত্রলীগ কর্মী প্রীতম সেন এবং সোহেল হাওলাদার।

কুমিল্লা-বিশ্ববিদ্যালয়

প্রত্যক্ষদর্শী ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ এক শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় মাসখানেক আগে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল ছাত্রলীগ কর্মী সালমান চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের কর্মী সোহেল হাওলাদারের হাতাহাতি ও মারামারি হয়। ওই ঝামেলার জেরে গত সোমবার রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরীর বাসভবনের সামনে দত্ত হলের ছাত্রলীগের কর্মী সালমান চৌধুরী অন্তত ১০ জন ছাত্রলীগ কর্মী নিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের কর্মী সোহেল হাওলাদারের ওপর হামলা চালায়। এ সময় সোহেল হাওলাদারের ডান চোখের ওপরে জখম হয়। হামলায় বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ সাহা, সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াসিফুল ইসলামসহ আরও অন্তত আটজন সোহেলের সাহায্যে এগিয়ে এলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, কিল-ঘুষি ও মারামারি হয়। এসময় দত্ত হলের ছাত্রলীগ কর্মী প্রীতম সেন ও বঙ্গবন্ধু হলের সোহেল হাওলাদার আহত হন। পরে তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এর আগেও করোনাকালেই গত ডিসেম্বরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কের সামনের সড়কে মারামারিতে জড়ান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ছাত্র হল নয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলেও ছাত্রীরা অবস্থান করতেন। সেই সময় কুবির চারটি হলের সামনে ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাতে ক্যাম্পাসে আড্ডা, হলের সামনে মিছিল, মিটিংসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। করোনাকালীন সময়ের কারণে হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্টরা স্বাভাবিক সময়ের তো খোঁজ-খবর রাখেন না। যার ফলে হলে যে কোনও সময় যে কোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অস্বাভাবিক নয়। করোনার সময়ে হল খুলে রাখা ও নজরদারির অভাবে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এখনও বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে সবার সামনে। আর সরকারি নির্দেশ না মেনে হলে অবস্থানের কারণে যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয়েছে, সিলেটের শাহজালাল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বাইরে পরীক্ষার জন্য অবস্থান করতে হয়েছে সেখানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে অবস্থান স্পষ্টভাবেই সরকারি নির্দেশনা না মানা। দলীয়ভাবেও ছাত্রলীগ নেতাদের এ সময়ে হলে থাকার কোনও নির্দেশনা নেই।

বন্ধ ক্যাম্পাসে হলে কিভাবে ছাত্রলীগ নেতারা থাকছেন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল প্রভোস্ট ড. মো. জুলহাস মিয়া জানান, অফিশিয়ালি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ। তারা কীভাবে থাকেন আমার জানা নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত আনুযায়ী, আমাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে হলে কোনও ছাত্র থাকতে পারবে না। অফিশিয়ালি হল বন্ধের পরও যদি কেউ থেকে থাকে ওই ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হলে থেকে ছাত্রলীগের মারামারির বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল প্রভোস্ট মো. জিয়া উদ্দিন জানান, দুই হলের ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হলের ভেতরে নয় বাইরে হয়েছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় অফিশিয়ালিভাবে হলও বন্ধ রয়েছে। তার দাবি হলে কোনও ছাত্র থাকে না এবং থাকতে পারবে না।

তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কোনও কাজ থাকলে ছাত্ররা হলে আসে, আবার চলে যায়। তারা হলে থাকতে পারবেন না সেই বিষয়ে আমরা তৎপর। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া আছে, সেখানে তারা মিছিল মিটিং করছেন। তবে কোন হলেও ভেতরে এই বন্ধ অবস্থায় বাস করার সুযোগ নেই।

যদিও তার হলে এখনও বেশ কিছু ছাত্র দলীয় পরিচয়ে অবস্থান করছে এমন অভিযোগ করেছে সাধারণ ছাত্ররা। হল ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরকারি নির্দেশনা না মেনে ছাত্ররা কিভাবে বন্ধ হলে থাকেন জানতে চাইলে কাজী নজরুল ইসলাম হল প্রভোস্ট মো. এমদাদুল হক জানান, ক্যাম্পাস বন্ধ অবস্থায় হলে ছাত্রদের থাকার নিয়ম নেই। নভেম্বরের দিকে হঠাৎ পরীক্ষা চালু হওয়ার পর কিছু ছাত্র হলে থাকা শুরু করেছে। হলে ছাত্রলীগ কিংবা ক্যাম্পাসে কোন দলের নেতাকর্মী সেটা আমরা বিবেচনা করি না। আমরা সবাইকে ছাত্র হিসেবে জানি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং পরীক্ষা বন্ধ করায় আমরা সকল ছাত্রকে পুনরায় হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছি।

এ বিষয়ে কথা বলতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইলিয়াছ মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল ইসলাম মাজেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। হলে অবস্থানরত অন্য ছাত্ররাও প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি। তবে তাদের সবাই পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়েছেন। এখন পরীক্ষা নেই তাহলে হল ছাড়বেন কিনা এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন বেশিরভাগই, কয়েকজন বলেছেন, ‘দেখি’।

হলে ছাত্রলীগের মারামারি এবং থাকার বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পাস ছাত্রদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। আমি প্রক্টরকে দায়িত্ব দিয়েছি বিষয়টি মীমাংসা করে দিতে। আর করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ একটি বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। কিছুদিন আগে পরীক্ষার কারণে বই এবং কাগজপত্র নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করেছে। তারা তো অপরাধী না, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং হল তাদেরই। তবে সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত যেন শিক্ষার্থীরা অমান্য করতে না পারে সেই দিকে আমি সব সময় খেয়াল রাখছি।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া