X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভর্তি পদ্ধতির সাতকাহন

ড. মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন
০৫ মার্চ ২০২১, ১৬:১৫আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২১, ১৬:১৭

ড. মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন একটি দেশের অগ্রগতির জন্য উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ এবং উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান খুবই জরুরি কারণ একটা দেশ যখন উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যায় তখন তারা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৪৭ সালের পূর্বে এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেটা হলো– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান শাসনামলের দীর্ঘ ২৪ বছরে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে মাত্র ৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে ২০২১ সালে এখন পঞ্চাশের অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০০-এর অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিকসহ অনেকগুলো বিষয় থাকে। বিষয় যাইহোক না কেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পূর্বে কীভাবে সে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলা হবে সে ব্যাপারে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত এবং যখনই মনে হবে এই পরিকল্পনাগুলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য তখনই একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। একটি নতুন স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির পূর্বে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হলো–

(১) প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ;

(২) যথাযথ লোকবল নিয়োগ; 

(৩) ল্যাবরেটরি, ক্লাস ফেসিলিটি এবং আবাসন সুবিধা নিশ্চিতকরণ।

এসব বিষয়গুলো নিশ্চিত করার পর একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত যা বিশ্বের সব উন্নত দেশই করে থাকে। আমাদের দেশে বিষয়টা পুরোই উল্টো। চিন্তার বিষয়টা এখানেই। কোনও অবকাঠমো নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, শুধু নেই আর নেই কিন্তু যেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি পেলো, সাথে সাথে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির তোড়জোড় শুরু। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কিন্তু তাদের মোহ ভাঙতে সময় লাগে না।

আসুন ইতিমধ্যে বাংলাদেশে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক অবস্থা ধারাবাহিকভাবে আলোচনার চেষ্টা করি। আজকে আলোচনার বিষয় ভর্তি পদ্ধতি।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা এখন পর্যন্ত মোটাদাগে পুরোটাই লিখিত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার বড় দিক হলো এখন পর্যন্ত কোনও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেনি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এখন পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনও পোষ্য কোটা নেই। এমনকি কোনও শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি পরীক্ষার্থী হয়ে থাকে তাহলে ওই শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলকেই পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়, যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্ণধারও হয়ে থাকেন। এখন পর্যন্ত কোনোরকম তদবির এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করেনি। বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমি মনে করি প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়টি এরকমই হওয়া উচিত কারণ ভর্তির বিষয়টি শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া অতীব জরুরি। এ সকল কারণে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হিসেবে সকলের কাছে প্রতীয়মান। আশা করি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে কারণ জাতির মঙ্গলের জন্য এধরনের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের নির্বাচিত করা অতীব জরুরি।

পাবলিক, কৃষি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা মোটা দাগে এমসিকিউ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ১০০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্ন থাকে এবং পরীক্ষার সময়কাল থাকে কমবেশি এক ঘণ্টা। ভর্তির ক্ষেত্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে নেওয়া পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরে এবং এইচএসসি এবং এসএসসি থেকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে একটি মেধা তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এর বাইরে দেশে মেডিক্যাল কলেজগুলোর জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা দীর্ঘদিন যাবৎ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনও কোনোটির ব্যাপারে ভর্তি বিষয়ক কিছু প্রশ্ন যে উঠেনি সে কথা আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না। এর কারণ মূলত এমসিকিউ পদ্ধতিতে নেওয়া ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের মতো সেনসিটিভ বিষয়গুলো মাঝে মাঝে শোনা গেলেও অনেক ক্ষেত্রে বিষয়গুলো জাস্টিফাই করা সম্ভব হয় না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়গুলো স্পষ্ট হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রায়ই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, যা সত্যি দুঃখজনক।

আমাদের অভিভাবকদের একটি অংশের অতি লোভও প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি বড় কারণ। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এ ধরনের অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে কী আসা করে? তারা কি মনে করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি হয়ে বা পরীক্ষায় পাস করে  তাদের ছেলে-মেয়েরা তাদেরকে ভবিষ্যতে সুখে-শান্তিতে রাখবে। এমনটা যে হওয়ার নয় তাতো আমাদের আশেপাশের দুর্নীতিবাজদের দেখলেই বুঝতে পারি। তাহলে কেন এই নিচুতা, কেন আমাদের ছেলে-মেয়েদের মেধা ধ্বংসকারী এই প্রবণতা। আমরা সব অভিভাবক এ ব্যাপারে শপথ নেই যে আমরা ছেলে-মেয়েদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনও চোরা পথে হাঁটবো না। তাহলে দেখবেন আমাদের এই ছেলে-মেয়েরাই একদিন সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। দেখবেন আপনার ছেলে-মেয়ে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে না পারলেও আপনাকে সুখে শান্তিতে রাখার জন্য তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবে। 

দীর্ঘদিন পরে  হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টার  কারণে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার  প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের একটি অংশের গ্রেফতার তারই প্রমাণ। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সাথে জালিয়াতি চক্রের একটি অংশ ধরা পড়েছে বলে জানা যায়। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে।

গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা

গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর দীর্ঘদিন যাবৎ একটা চাপ ছিল যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ, তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো নিয়ে কোনও গবেষণা পরিচালিত হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর কথা বারবার বলা হচ্ছিল তা হলো–

(১) এতে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক অর্থ, সময় ব্যয় হয়;

(২) অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন ফাঁকা থাকে;

(৩) আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট লোকজন, বিশেষত: শিক্ষকবৃন্দ আর্থিকভাবে যে বড় মাপের সুবিধা পেয়ে থাকেন তা বন্ধ করা প্রয়োজন;

(৪) একই সময়ে একের অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা থাকার কারণে অনেক ছাত্র-ছাত্রী সবগুলো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।

গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমরা যদি একটি জরিপ পরিচালনা করতাম, যেখানে যে সকল ছাত্র-ছাত্রী ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়েছে তাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখা যেত যেমন–

(১) যেখানে ভর্তি হয়েছে সেখানে ভর্তি হওয়ার পূর্বে সে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে;

(২) যে সাবজেক্টে পড়ছে সে সাবজেক্ট নিয়ে সে সন্তুষ্ট কিনা;

(৩) ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে তার সর্বমোট কেমন খরচ হয়েছে;

(৪) ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে সে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল কিনা;

(৫) সে নতুন কিছু শিখে ছিল কিনা, তাহলে আমাদের এ সিদ্ধান্ত আরো বেশি বাস্তবসম্মত হতো বলে আমার বিশ্বাস। আমার ব্যক্তিগত মতামত একজন ছাত্র বা ছাত্রী ৫-৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বেশি সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় খুব কম ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণ করে। ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ৫-৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বড় কোনও বিষয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক ছাত্র-ছাত্রী একটি বা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়।

যদিও মোটামুটি সবাই গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার সুবিধার কথা বলছেন, আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ারও অনেক সুবিধা রয়েছে।

যেমন–

(১) একজন ছাত্র বা ছাত্রীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হলেও অন্য অনেক জায়গায় সে চেষ্টা করে দেখতে পারে;

(২) শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোনও ভালো ছাত্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অসম্ভব না হলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ তার থাকে;

(৩) একজন ছাত্র দেশটাকে ঘুরে দেখার সুযোগ পায়; (৪) তার অনেকের সাথে মেশার সুযোগ তৈরি হয়;

(৫) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রীদের গমনাগমনের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার মানুষ উপকৃত হন।

গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার সুবিধা-অসুবিধা যা-ই থাকুক না কেন বাস্তবতা হলো গত কয়েক বছর যাবৎ সরকারের প্রচেষ্টা এবং বিজ্ঞজনদের চাপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীজুড়ে মহামারির অবস্থাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে আমার মনে হয়। এ উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকবার আলোচনা হয়। আলোচনা পুরোপুরি ফলপ্রসূ হয়েছে কথাটা বলা যাবে না। কারণ গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের বড় চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাতে রাজি হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়- চুয়েট, কুয়েট এবং রুয়েটের সাথে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় না আসার কোনও কারণ আমি খুঁজে পাই না। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার সাথে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির তেমন কোনও পার্থক্য নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোর্স কারিক্যুলামও পুরোপুরি বুয়েটের মতো এবং সিনিয়র ফ্যাকাল্টিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। এছাড়া এ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অতীতে কোনোরকম প্রশ্ন উঠেছে এমনও তো নয়। তাছাড়া, অত্যন্ত  সফলভাবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিআইটি থাকাকালীন সময় এ প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোরকম প্রশ্ন ওঠা ব্যতিরেকে সমন্বিতভাবে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। এমতাবস্থায়, বুয়েটের এমন কী কারণ থাকতে পারে যে তারা অন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে আগ্রহী নয় তা পরিষ্কার করা জরুরি বলে আমি মনে করি।

৭৩ অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একই ধরনের কথা প্রযোজ্য। তারা কেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসতে আগ্রহ দেখায়নি আমার জানা নেই। আমরা কি বলতে পারি, এই বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অতীতে ১০০%   ত্রুটিমুক্ত ছিল? বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার সময় দেখা যায় ক্যাম্পাসের বাইরে অন্যান্য জায়গায় আসনের ব্যবস্থা করতে হয়। ভর্তি পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট অনিয়ম যেমন প্রশ্ন ফাঁস বা পরীক্ষার হলে দেখাদেখি ক্যাম্পাসের কেন্দ্রগুলোতে সচরাচর দেখা না গেলেও ক্যাম্পাসের বাইরের অনেক কেন্দ্রেই পরিলক্ষিত হয়।

আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন কথা হলো এ চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় যেত তাহলে সকল ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেওয়া সম্ভব হতো  এবং পরীক্ষার স্বচ্ছতা অনেক বেশি নিশ্চিত করা যেত। যেখানে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ পথ দেখানোর কথা কারণ তাদের সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা সবকিছুই রয়েছে সেখানে তারা আসলেন না, কেন আসলেন না? আমার তো মনে হয় একটাই সমস্যা, সেটা ‘ইগো’।

বুয়েট বলুন বা অন্য বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথাই বলুন, ‘ইগো’ই যদি হয়ে থাকে আমাদের মূল সমস্যা তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এভাবে আর কতদিন চলবে?

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ কারণ তারা সবচেয়ে নতুন স্থাপিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাথে নিয়ে গত বছর থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করার মাধ্যমে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। আমি সর্বদাই মনে করি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের উন্নয়নে যে পরিমাণ ভূমিকা রেখে চলেছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পর্যন্ত সেই পর্যায়ের ভূমিকা রাখতে পারছে না। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবারও দেখিয়ে দিয়েছে তাদের অগ্রণী ভূমিকা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার ক্ষেত্রে ভর্তি প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য বিষয়গুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলেও একটি বিভাগে সর্বোচ্চ কতজন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করবে সে  ব্যাপারে যথাযথভাবে নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন। একটি বিভাগে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে বিভাগের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করা উচিত এবং এ বিবেচনার ভিত্তিতে যত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভর্তি করলে তাদেরকে যোগ্য গ্র্যাজুয়েট হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, ঠিক ততজন জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা উচিত, কোনোভাবেই এর বেশি নয়। দেশের কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে নাকি ৫-৬ হাজার এমনকি আট হাজার পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে। বিষয়টি যদি সত্য হয় তবে তা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার ক্ষেত্রে ইউজিসি প্রদত্ত নীতিমালা অনুসরণ করছে না তাদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরকে গুরুত্ব প্রদান করে এবং তার ভিত্তিতেই তারা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে। বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কারণ তারা দেশের পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি এবং এইচএসসির ওপর আস্থা রেখে তার ভিত্তিতে মেধা তালিকা প্রণয়ন করেন এবং ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে।

আমাদের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে চিন্তা করতে পারে। আমি মনে করি আজ হোক, কাল হোক আমাদেরকে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি কার্যক্রমের দিকে অগ্রসর হতে হবে। এতে করে ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি সংশ্লিষ্ট কাজের ঝামেলা থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাবে এবং আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর মানোন্নয়নের জন্য সবাই অনেক বেশি মনোযোগী হবে।

সমন্বিতভাবে বা আলাদা আলাদাভাবে যেভাবেই হোক না কেন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ভর্তি পরীক্ষার মান নিশ্চিতকরণ যাতে প্রকৃত মেধাবীরা ভর্তির সুযোগ পায়।

জাতির জনকের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ আমার, আপনার সকলের, এখানে কোনও ভেদাভেদের সুযোগ নেই। এ দেশের উন্নয়নে মূল ভূমিকা খেটে খাওয়া মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ মেহনতী মানুষের। এই মেহনতী মানুষদের কথা চিন্তা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করছিলেন।

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। এর জন্য শিক্ষাকে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ যে সমস্ত দেশ একসময় আমাদের মতো অবস্থায় ছিল তারা শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান, তার জন্য যথাযথ বিনিয়োগ এবং সেই বিনিয়োগের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আজ উন্নত দেশের কাতারে। দেশে বর্তমানে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান। এ  স্থিতিশীল অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার এবং সর্বপ্রকার ‘ইগো’ বাদ দিয়ে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। তাহলে নির্দিষ্ট সময় তথা ২০৪১ সালের পূর্বেই আমরা উন্নত বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ