X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুশতাক-কিশোর এবং ডিজিটাল আইন বিতর্ক

আনিস আলমগীর
০৯ মার্চ ২০২১, ১২:১৮আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২১, ১৬:০১

আনিস আলমগীর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য সরব এখন বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া। বিশেষ করে জেলখানায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা এবং এরপর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে মুশতাকের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর আইনটি বাতিলের দাবি সামনে চলে এসেছে। কিশোর দাবি করেছেন, গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে বীভৎসভাবে নির্যাতন করেছে।

সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে তখনও এটি নিয়ে সাংবাদিক মহলে চরম আপত্তি ছিল। তাদের আপত্তির মূল বিষয় ছিল ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, গুজব রটনা বা সরকারের সমালোচনা করার অভিযোগে মামলা হলেই আটক করে রাখা এবং আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে এখানে। তারপর এটি নিয়ে কয়েক দফা সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের বৈঠক হয়েছে। সরকারের দাবি, সাংবাদিক নেতাদের সিংহভাগ সুপারিশ মেনে নিয়েই খসড়া আইনটিকে সংসদে পাস করানো হয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন আসে এখনও বিতর্ক থামছে না কেন আইনটি নিয়ে?

কারণ হচ্ছে, এই আইনে পুলিশের হাতে বিচারিক ক্ষমতা তুলে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাহী বিভাগের অংশ। পুলিশের হাতে বিচারিক ক্ষমতা তুলে দিলে বিচার বিভাগ তাহলে আছে কি করার জন্য? সে কারণে অনেকে মনে করছেন আইনটি সংশোধন করে, এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্পিডব্রেকার দিতেই হবে। এই আইনের প্রয়োজনীয়তা সাংবাদিকরা একেবারেই অস্বীকার করছে না।

যেকোনও আইন করা হয় জনগণের স্বার্থে, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য। কিন্তু সেই আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয় তাহলে সেটা কাল হয়ে দাঁড়ায়। সে আইন দেশে-বিদেশে বদনাম কুড়ায়। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এই আইনের ভুল-ত্রুটি ঠিক করতে আড়াই বছর খুব কম সময় ছিল না। আমরা যারা আইনটি সংশোধন বা বাতিলের দাবি করছি, তারাও যেমন সোচ্চার ছিলাম না, সরকারও কোন কোন ক্ষেত্রে আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে তার দিকে নজর দেয়নি।

মূলধারার মিডিয়ায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ইচ্ছে বলার নাম বাকস্বাধীনতা না। ফেসবুক, ইউটিউব আসার পর একশ্রেণির লোক বাকস্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। মিডিয়ার নারী, প্রগতিশীল শ্রেণি, সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে ভুয়া সংবাদ ও ঘৃণা প্রচার চালাচ্ছে একদল লোক। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক গুজব, জঙ্গিবাদ, মিথ্যাচার, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা, গণআতঙ্ক সৃষ্টি অত্যন্ত বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। অনেক শিক্ষিত লোকও স্যাটায়ার এবং ঘৃণার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন না।

সম্প্রতি ডিজিটাল মামলায় এক বছর ধরে জেলে থাকা এক শিক্ষককে জামিন দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন যথার্থই বলেছেন, “আমেরিকায় তো মানুষ ‘স্যাটায়ার’ করে। কিন্তু আমাদের এখানকার মতো কুৎসিতভাবে লেখে না। যেসব ভাষা লেখে একজন শিক্ষিত মানুষ কীভাবে এসব ভাষা ব্যবহার করতে পারে? তাহলে শিক্ষার দাম কী হলো?”

বর্তমানে ডিজিটাল আইনে প্রায় দেড় হাজার মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। যেটুকু জানি এসব মামলার নব্বই শতাংশই সরকার করেনি, করেছে সাধারণ মানুষ। তার মধ্যে বেশিরভাগই নারীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় অপদস্থ অপমান করার অভিযোগে হয়েছে। তাহলে আইনটি যে দরকার ছিল তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।

অনেকে বলতে পারেন প্রচলিত আইনেও এর বিচার করা যায়। কথা সত্য। কিন্তু ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল অপরাধে প্রচলিত আইনে বিচার করতে গেলে আইনের ফাঁকে ভুক্তভোগীর বিচার বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে যায়। সাধারণ জনগণ এই মামলা বেশি করলেও সরকারের করা মামলাগুলোই আলোচনায় উঠে এসেছে বেশি। কারণ, সরকারের ইমেজ রক্ষার নামে অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা সাংবাদিক, লেখক কিংবা অ্যাক্টিভিস্টদের ধরে নিয়ে বিনা বিচারে জেলে রাখলে আলোচনা তো হবেই।

মুশতাক এবং কিশোরের মামলা চলছে প্রায় এক বছর ধরে। তারা ছয়বার জামিন চেয়ে আদালতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। কী এমন ঘটনা ঘটেছে যে তারা ছয়বার জামিন চাওয়ার পরও আদালত তাদের জামিন দেননি! কী এমন বিষয় মুশতাক লিখেছেন, যাকে লেখক হিসেবে কেউ চিনে না বললেই চলে, তাকে সরকারের গ্রেফতার করতে হলো! কিশোর কী কার্টুন এঁকেছেন যে বিচারের আগেই প্রায় এক বছর কারাগারে থাকতে হলো! আমরা মূলধারার মিডিয়ায় তার কিছুই দেখছি না, দেখিনি। মিডিয়া কি তাহলে একপক্ষীয় আবেগ আর ভাষ্য দিচ্ছে! বা সরকার কি এখানে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে তাদের গ্রেফতার ন্যায়সঙ্গত বা ঠিক হয়েছে?

কেউ কেউ বলছেন, মুশতাক-কিশোররা একটি ফেসবুক পেইজ চালাতেন, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নোংরা ভাষায় ঘৃণা প্রচার করা হতো। মুজিববর্ষকে তারা বলতো ‘গজব বর্ষ’, ‘ধর্ষণ বর্ষ’। পরে পরিচয় পাওয়া গেল তাদের সেই গ্রুপের একজন মডারেটর সামি হচ্ছে মাস খানেক আগে আল-জাজিরায় প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে নিয়ে যে তথাকথিত তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে তার প্রধান সোর্স। আমরা আল-জাজিরার ঘটনা দিয়ে এখন দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর আগেই তো গোয়েন্দারা মুশতাক-কিশোরকে আটক করেছিল।

এখন প্রশ্ন আসে সেই সন্দেহে কি মুশতাক-কিশোরকে নির্যাতন জায়েজ? না, কোনোভাবেই জায়েজ না। গ্রেফতারের পরপরই তাকে ৬০ ঘণ্টা ধরে আদালতে সমর্পণ না করার অভিযোগ এনেছেন কিশোর। তার ভাষ্য অনুযায়ী এমনটা মুশতাকের সঙ্গেও হয়েছে। যদি হয়ে থাকে সেটি অবশ্যই আইনের বরখেলাপ। মুশতাকের মৃত্যু স্বাভাবিক হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। কিন্তু নির্যাতন এবং কারাভোগ তার এই ‘স্বাভাবিক মৃত্যুকে’ যে এগিয়ে আনেনি, সে কথা আমরা তো জোর গলায় বলতে পারছি না। রাষ্ট্র যদি কাউকে অপরাধী মনে করে বা অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছে বলে সন্দেহ করে, প্রচলিত আইনে তাকে গ্রেফতার করতেই পারে। কিন্তু সেটাও হতে হবে আইন মেনে। কিন্তু এসব দেখবে কে!

আমাদের দুঃখ হচ্ছে যুগে যুগে রাষ্ট্রের অন্যায়, আদালতের অনাচার ধরিয়ে দেওয়ার কাজটি করার জন্য সাংবাদিক ছিল না শুধু, ছিল দলনিরপেক্ষ মানবাধিকার কর্মীরা, সাহসী আইনজীবীরা। দরকার হয়েছে বিবেকবান সিভিল সোসাইটির। যথাযথ বিরোধী দলের। তারা এখন কে কোথায়? নিজস্ব ধান্দা, এনজিওর অর্থ হালালের উদ্দেশ্য ছাড়া মানবাধিকার কর্মী আমরা দেখি না। মোটা অংকের অর্থ ছাড়া নির্যাতিত মানুষের জন্য দাঁড়াতে পারে এমন আইনজীবী একেবারেই হাতেগোনা। খালেদা জিয়ার দুর্নীতি, তারেক জিয়ার সন্ত্রাসের মামলা প্রত্যাহারের দাবি ছাড়া প্রধান বিরোধী দল কোন ইস্যুতে মাঠে সোচ্চার?

ডিজিটাল আইন বাতিলের জন্য আবার এখন বের হয়েছে কিছু ‘নব্য শাহবাগী’। ইস্যু যাদের ব্যবসা, এমন লোকদের দিয়ে আরেকটি শাহবাগ তৈরি করা এত সোজা না! নির্বিচারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা লড়ে না, সাধারণ জনগণের ইস্যু যারা চোখে দেখে না, যাদের টার্গেটই হচ্ছে যেকোনও উপায়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা, তাদের কথায় সাধারণ মানুষ কেন রাস্তায় নামবে!

শেষ করবো ডিজিটাল আইনের বিতর্ক থামানোর উপায় বলে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই আইন বাতিল নয়, আইনের সংশোধন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলো ঠিক করতে হবে। এই আইন বাস্তবায়নে প্রধান দুর্বলতা পুলিশ। একজন লোক সোশ্যাল মিডিয়ায় কী অপরাধ করছে, সেটি কতটা গুরুতর, রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর এবং আরেকজনের স্বাধীনতা, মান-ইজ্জত কতটা হানি করেছে, তা বোঝার দক্ষ পুলিশ সরকারিযন্ত্রে খুব কম আছে।

দেখা যাচ্ছে, আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশের যে কর্মকর্তাকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে তাকে কারণ লিপিবদ্ধ করতে বলা হলেও পুলিশ তা করছে না। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা অজামিনযোগ্য ছিল, সেটা এই আইনের ২৫ এবং ২৯-এ জামিনযোগ্য। কিন্তু পুলিশ তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। এই আইনে বাকি অজামিনযোগ্য যেসব ধারা রয়েছে তা নতুন কিছু না। দেশের প্রচলিত পেনাল কোডেও তাই আছে। পুলিশের ভুলে বা বাড়াবাড়িতে সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট নয় শুধু, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই আইন নিয়ে আজ ভীতির সঞ্চার হয়েছে।

তাই, এই আইনে কোনও অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না, এমন একটা বিধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আইনটির ঘোলাটে বিষয়গুলো বিধি প্রণয়ন করে আরও পরিচ্ছন্ন করতে হবে, যাতে কোনও সংশয় না থাকে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ