X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহারের গল্পবিশ্ব

বকুল আশরাফ
১০ মার্চ ২০২১, ১০:৫০আপডেট : ১০ মার্চ ২০২১, ১০:৫০

গল্পকথক। নব্বইটির মতো গল্প রচনা করেছেন। গল্পগুলি মাটি খুঁড়ে তুলে আনেননি তিনি। নিজের অব্যাবহিত পেরিয়ে আসা জীবন, পারিপার্শ্বি¦কতা, চলার পথের মানুষগুলোর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, কিছু নিজস্ব অনুভূতি যার বাস্তবরূপ পায়নি, হয়তো তেমন সব ছোট ঘটনাবলি খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন গল্পে। এনেছেন মনস্তাত্ত্বিক উপভোগ, উপকথার প্রাচুর্য এবং উপমাকে আরো সম্প্রসারিত করে টেনে নিয়েছেন নিজস্বপাত্রে। পরিপূর্ণ এই গল্পের পাত্রের কোথাও অপূর্ণ রাখেননি তিনি। যাকে ‘তিনি’ বলছি, তিনি নূর কামরুন নাহার। আমার বন্ধু। বন্ধুর যে রূপটিতে পবিত্রতার আবেশ ছড়ানো থাকে আমি তার সে দিকটার কথাই বলছি। কেননা তার ভাবনার সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলি খুবই পরিপাটি। সাজানো। মনে হতে পারে পূর্বের কোনো গোছানো ভাবনা, ঠিক তা নয়, তার জ্ঞানার্জনের সাথে যুক্ত হয়ে কর্মজীবনের অনুষঙ্গ তাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। তাইতো কথাগুলোকে বা কাহিনীকে তিনি গল্পে রূপ দেন সিদ্ধহস্তে। গাব্রিয়েল মার্কেস বলেছেন, ‘তিনি কোনো একটা শব্দও অবাস্তব লেখেননি। তবে তার বাস্তবতা আর পৃথিবীর অনেক গল্পকারের বাস্তবতায় ভিন্নতা আছে। সাধারণ জীবনের মধ্য থেকেই আবিষ্কার করতে পারাটাই সার্থকতা’।
সৃষ্টির অনিবার্য নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে ফেরানো যায় না। বা তাকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে চালিত করা যায় না। অন্ধকারের শক্তি আরো নিদারুণভাবে উপস্থিত হয়ে আলোর সঞ্চার করে। ছোটগল্পের মধ্যে তিনি বুদ্ধির দীপ্তশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তার স্টাইল, তার ব্যক্তিত্বকে সহজ হাতে ছোঁয়া সহজতর নয়। প্রকৃতির নিষ্ঠুর রূপ অন্যদিকে মানুষের জীবনের সীমাহীন মমতা দুইই মাখামাখি তার গল্পে! কারণ এই গল্পজীবন তার নিজের চিরচেনা স্বজনদের। যে জীবন তার দেখা হয়ে গেছে। হয়তো কল্পনামিশ্রিত পারিপার্শ্বিক দোলনায় এখনো দোল খাচ্ছে। ‘দূরত’ গল্পে দেখতে পাই ‘রেবেকার সাথে শুধু একটা সন্ধ্যা জড়িত। একটা সন্ধ্যার স্মৃতি।’ কি ঘটেছিল সে সন্ধ্যায়! বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে। সেই সন্ধ্যায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রেবেকার সাথে নায়কের দেখা। যিনি এমন বহু সন্ধ্যা নিজেই তৈরি করেছেন ইচ্ছেমতো! এই গল্পে রেবেকার স্বামী আসেনি, সে গাড়িও আনেনি। তাই রেবেকাকে পৌঁছে দিতে তিনি যান (গল্পের নায়ক) রেবেকাদের বাসায়। চা পানের অনুরোধ রক্ষা করেন। এরপর অস্পষ্ট বা স্পষ্ট কোনো ঘটনা নেই। শুধু বলা হয়েছে ‘আমার আর রেবেবকার ঐ সন্ধ্যায় হয়েছিল। ব্যাস এইটুকুই। আর কিছু নয়। এ রকম একটি বিষয় আরো হয়তো গড়ায়। আমার হয়তো আরো দু’একবার যাওয়ার কথা ছিল। রেবেকার হয়তো ডাকার কথা ছিল। না আমিও যাইনি। রেবেকাও ডাকেনি।’ এভাবে আট বছর গড়িয়ে যায়। আট বছর পর আবার রেবেকার সাথে দেখা। জীবনানন্দ দাশ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় দেখিয়েছেন এক অভাগা আত্মহত্যা করে লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছে।

কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হ’লো তার সাধ;

 

বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল

কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

এবারও কমন আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে আবার আট বছর পর রেবেকার দেখা। রেবেকা তখন ‘উঠে গেল। নিরুত্তাপ উঠে গেল। আমি একটু আহত হলাম। রেবেকা একদিন কাছের ছিল। এইমাত্র আমাদের দূরত্ব তৈরি হল।’ এখানেই ‘দূরত্ব’ নামের গল্পটির যবনিকা টানা হয়েছে।
নিজস্বতা তাকে স্বতন্ত্র করেছে। তার গল্পগুলির স্বাদ ও সৌন্দর্যই হলো এগুলো একেবারেই চারপাশের ঘটনা। ২০১১ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘গুচ্ছগল্প’ চৌদ্দটি গল্পের সুফসল। বই এর ফ্ল্যাপেই তিনি লিখেছেন, ‘বাস্তবতা, সৌন্দর্য, প্রেম আর কামের যে জীবন সে জীবনের চিত্রই ‘গল্পগুচ্ছ’। বিজ্ঞজন বলেন, ‘ছোটগল্প হলো যন্ত্রণার ফসল’।
শূন্যতার আঘাতে কখনো উপকরণ ভেঙে পরে যেতে থাকে, সেই টুকরো টুকরো ঘটনার যে কৌণিক ধারালো সরু অংশ যখন জীবনকে বিদ্ধ করে, যখন বিশ্বাসের মাত্রাকে লেখক নিজের বিবেচক বিশ্লেষণে নগ্ন করে সৌন্দর্যকে বুঝিয়ে দেন, তখন পাঠকের ভাবনায় বাস্তবতার তোলপাড় শুরু হয়। যা ছিল কিন্তু ভাবনায় আসেনি। এটাই সার্থকতা। ‘ঈর্ষা’ তেমনই একটি গল্প। ‘ডুকরে কেঁদে ওঠে নসিরন—মানুষডা মানুষ নাই আম্মা।’...ঠোঁটের ফোলাটা এখনো বেশ দেখা যাচ্ছে। চা নিয়ে নসিরন দাঁড়িয়ে থাকে।’ নসিরন কাজের বুয়া, বস্তিতে তার বাস। স্বামী ঘুষি দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে দিয়েছে। নসিরন কাজ করে রাবেয়া’র বাসায়। রাবেয়ার স্বামী শাহেদ প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। দুপুরে ঘুমাবার সুযোগ নেই, বাসায় ফেরেন সন্ধ্যা বা রাতে। সারাদিনের ক্লান্তি ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেন। গল্প এগিয়ে যায়—গতকাল দুপুরের কাজে আসেনি, আজ সকালে নসিরন কাজে আসেনি। আজ দুপুরে এসেছে অনুমতির জন্য, ‘পরনে সস্তা দামের লালচে শাড়ি। মাথার চুল টেনে বাঁধা। ঠোঁটের আশেপাশে ছড়িয়ে লাল রংয়ের লিপস্টিক। চোখে কাজল। মুখটা পাউডারে সাদা। নসিরনকে হঠাৎ এ রকম বেশে দেখে রাবেয়া একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।’ নসিরন লাজুক ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘আম্মা উনায় আমারে বাইরে বেড়াইতে নিয়া যাইতেছে। বিকালে আইতে পারুম না। একটা সিনেমা দেখাইবো।’ এই কথাটুকুই রাবেয়ার সর্ব অঙ্গে ঈর্ষার আগুন ছড়িয়ে দেয়। অতৃপ্ত রাবেয়াও চায় তার স্বামীও তাকে ঘুষি দিয়ে ঠোঁট ফাটিয়ে দিক, তারপর বেসামাল উত্তাল আবেগে ভাসিয়ে দিতে দিতে সোহাগে সোহাগে ধুয়ে দিক। রাবেয়া তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী, গর্বিত নারী।
মানুষের জীবনের পুরানো মূল্যবোধ যখন অর্থহীন পর্যায়ে চলে আসে তখন ব্যক্তি-চেতনার সমাজ চেতনার সংর্ঘষ কোনো নির্দিষ্ট উপসংহার টেনে নিতে ব্যর্থ হয়। শুর হয় চারপাশটার সাথে কথকের সংঘাত। তার অধিক গল্পই ব্যক্তির সাথে ব্যাক্তির সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস। কখনো বহুমুখী আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর উপর ভাবনার টর্চ জ্বেলে দিয়ে দেখতে হয় জটিল ও সরল গহ্বর। নদীতে যেমন চর তেমনি গল্পে কখনো জেগে ওঠে লেখকের ব্যক্তিত্বেরই একটা পরিস্রুত রূপ। লেখকের চরিত্র ও মানসিকতার অপূর্ব সংবেদনা লক্ষ্য করি ‘লিনু ও আমি’, ‘দখিনা হাওয়া’, ‘ফাঁক’, ‘জীবন কখনো কাশফুল’, ‘শাড়ি’, ‘রক্তে চিনি’, ‘পাঁচবোন’, ‘ব্যবহৃত’, ‘বৃক্ষ ও প্রেমিকের গল্প’, ‘স্পর্শের দেয়াল’, প্রভৃতি গল্পের কহিনীতে। আসলে লেখকের সত্তারই প্রতীক, লেখক গল্পের মধ্য দিয়ে তার নিজেকেই প্রকাশ করেন। কখনো সম্প্রসারিত করেন নিজেকে। ‘বৃক্ষ ও প্রেমিকের গল্প’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে, গ্রন্থে রয়েছে দশটি গল্প। ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘বৃক্ষ ও প্রেমিকের (মানুষের) গল্প’ গ্রন্থ এভাবেই হয়ে উঠেছে কাছের মানুষের গল্প, নিজের গল্প আর যাপিত জীবনের গল্প। বেশিরভাগ গল্পেরই আকর্ষণীয় দিক হলো নিপাট বাস্তবতার পাশাপাশি সুক্ষ্ম কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে। অনেক গল্পই বিস্তৃত জীবন-ক্যানভাস, স্মৃতিকথন, যা প্রায়শই ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তিগত পরিসর ভেঙে, সীমারেখার পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে ঠিক ‘পাঁচবোন’ গল্পের মতো। এখানে গল্পশৈলির মতো চরিত্রের উপস্থাপনা কখনো ভিন্ন স্বাদের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করে। একদিকে পাঁচবোন ও একমাত্র ভাই ও তাদের মধ্যকার বিনিময় যেমন—উপহার, আর্থিক লেনদেন, আধুনিক জিনিসে পূর্ণ হয়ে ওঠা বাসা, অপরদিকে মা হারা বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটি’র (আমি) কাণ্ডজ্ঞানহীন চোখ অকারণে নিরবে অশ্রুপাত করে চলে। মূলত তিনি খুঁজে পান ‘পুঁজিও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটায়। কোনো কোনো ভূখণ্ডকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।’ লেখক যেকোনো ধরণের চরিত্রই তার নিজস্ব ভাবনায় আবিষ্কার করুক না কেনো প্রতিটি চরিত্রই তার নিজের বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হতে থাকে। প্রতিটি ঘটনাই তারই একান্ত নিজের দৃষ্টিকোণ। প্রত্যেক গল্পের পার্শ্বচরিত্র লেখকেরই বহুরূপী অভিব্যক্তি। যেমন আমরা, প্রতিটি মানুষ, নিজেরাই নিজের মধ্যে সংখ্যাতীত সত্তাকে পরিবহন করে চলছি। প্রত্যেক মানুষ নিজের মধ্যে অগণিত সত্তাকে বহন করে। যদিও একজন লেখক সব ধরণের গল্প লিখতে পারে না। কেননা তার নিজস্ব সীমারেখার বাইরে যাবার তার সুযোগ নেই। এ ভাবনায় ‘শীতের পাখি’, ‘আতপ চাল’, ‘জীবন কখনা কাশফুল’ পরিব্যাপ্ত। পাঁচবোন নিয়ে লেখার শেষাংশে কিছু কথা রয়েছে।
দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থে একটু ভিন্নতা পরিলক্ষিত প্রথম গ্রন্থের চেয়ে। গ্রন্থে এসেছে জটিল মনস্তত্ত্ব, জীবনের বিচিত্র বর্ণিল রূপ, সমাজ বাস্তবতা ও বিভক্ততা, শ্রেণি সংগ্রাম, বেঁচে থাকার অন্তর্নীল বেদনা ও অন্তগুঢ় রহস্য, নিরন্তর সংগ্রামের মাঝে স্বপ্ন দেখা মানুষের গল্প। এসব বিষয় নিয়ে সৃষ্ট ‘শিস দেয়া রাত’ গ্রন্থটিতে বারটি গল্প রয়েছে। রাতের শিস কখনো মানুষকে চমকিত করে না বরং নিরঙ্কুষ আবেশে আচ্ছাদিত করে, ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়’, ঝংকার তুলে হৃদয়ে, ভাবনায়, সিম্ফনি হয়ে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে। অন্ধকার গল্পটা অন্ধকারেই ঠাসা। কোনো আলো নেই। অন্ধকারে অন্ধকারের নিশানাও ঠিক রাখা যায় না। কারণ অন্ধকারের জীবন সৌন্দর্য নেই, আছে লোলুপতা। চিত্তাকর্ষ লোলুপতার মূর্তি গড়তে কথককে বেশ কষ্ট করেই উপকরণ সাজিয়ে স্তরের পর স্তর গড়ে দেবীর আদল দিতে হয়েছে। প্রতিটি অংশের এমন সুবিন্যস্ত উপস্থাপন পাঠকে ভারাক্রান্ত করে তোলে না বরং পাঠক তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হয়। প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে বর্ণময় জীবনের স্পর্শ লাভ করে যেন। আরশিতে নিজেকে যেমন দেখা যায় তেমনি গল্পের মধ্যে নিজের ভাবনা ও অভিজ্ঞতাকে বুনে দেয়া যায় শব্দ-সূতোয়। হয়তো কিছুটা পাশ কেটে যাওয়ার মতো যেন ধাক্কা না লাগে বা দুর্ঘটনা যেন না ঘটে। এই কারুকার্য ও গাল্পিক রূপময়তার ভেতরে নিজেকে যেমন চেনায় তেমনি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে পাঠককে।
লেখক যা প্রকাশ করেন তা স্থানকালপাত্র সীমারেখা পেরিয়ে লেখকের ভাবনা বা দর্শনের সুবিশাল ক্যানভাস হয়ে মুক্তিলাভ করে। গল্পকথক কি মনস্তত্ত্বের কেন্দ্র থেকে বৃত্ত এঁকেছেন? তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘মৃত্যু ও একটি সকাল’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে আটটি গল্প নিয়ে। এখানে একটি বিশেষ ব্যক্তি-চরিত্রকে বা মানব চরিত্রের কোনো একটি অপূর্বতাকে পরিস্ফুট করবার সফল চেষ্টা লক্ষ্য করি ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ গল্পে। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারীর তিনটি বিয়ে যা সমাজ ভালো চোখে দেখে না। তাই এই গল্পে সমাজের কথা নেই, তত্ত্ব নেই, রয়েছে বর্তমান কালের অজস্র জটিলতার মতোই জটিল মনস্তত্ত্ব। নারীর জীবন সংগ্রাম। মিথ্যেকে আশ্রয় করে জীবনে গতি সঞ্চার করে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী। সিদ্ধহস্তে সে কাহিনীকে গল্পে রূপান্তর করেছেন নূর কামরুন নাহার। তার সার্থকতার জায়গাটা এমন—ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতোই। বইয়ের ফ্ল্যাপেও লেখা আছে ‘জীবন আর মৃত্যুর অনিবার্যতায় বাঁধা যে জীবন, যে জীবন মুখোশের, প্রতি মুহূর্তেও সমঝোতার আর সংগ্রামের সেই জীবনের গল্প নিয়েই ‘মৃত্যু ও একটি সকাল’ গল্পগ্রন্থ।
গল্পকথক চারদিকের জীবন থেকে আরোহণ করে তাতে গতির প্রাণপ্রবাহ দিয়ে সেখানে তিনি প্রতিস্থাপণ করেন নিজেকেই। দর্শনের বিবেচনায় এই উপলব্ধির আবির্ভাব তাকে সার্থকতা এনে দেয় আবার কখনো সমালোচকদের দ্বার উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে। পরিবর্তন ঘটে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি। দৃষ্টিভঙ্গির এই চুড়ান্ত বিজয় অর্জন স্বাভাবিকভাবে আনন্দের। তবে ছোটগল্প যেমন লেখকের ব্যক্তিত্বের অভিব্যাক্তি। তাই তিনি নিজের সমাজ, পরিবেশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চারিত্রিক গঠন থেকে যা যা গ্রহণ করেন সেই বিষয়াদিই গল্পের চরিত্রে এসে ধরা দেয়। তাই সেখানে কোন ম্যাজিক রিয়ালিসম-এর জন্ম হয় না। তবে বাস্তবতা দু’চোখ মেলে দেখে যায় নিয়তি এবং সাদা-কালো-রঙিন অধ্যায়। ‘ব্যবহৃত’ গল্পের শুরুটা ঠিক তেমনি—‘দুই দালানের মাঝ থেকে তেচরা করে আসা বিকেলের হলুদ কিন্তু তেজি রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে মেয়েটা।’ অঞ্জলি রায়। শেষ ধাপে মেলাতে গেলে সরল অংকের মতো মেলে না, না কোনো কোনো ঐকিক নিয়মও খাটে না, শুধু সুদ-কষা’র মতো লাভ ক্ষতির পাল্লা দুলতে থাকে। ভারসম্য মেলাতে একবার উপরে ওঠে তো আবার নেমে আসে। একবার এ প্রান্ত আরেকবার ঐ প্রান্ত। গল্পকথক শেষে লিখেছেন, ‘এই অফিসে খুব গুঞ্জন ছিলো স্যার অঞ্জলিকে ব্যবহার করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন অঞ্জলি স্যারকে ব্যবহার করেছেন। কে ব্যবহৃত হলেন অঞ্জলি নাকি স্যার? আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না।’ সালমান রুশদি’র মতে ম্যাজিক খুঁজে লাভ নেই বাস্তবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জাদুবাস্তবতার শিকড়।
এসবই চেনা জীবনের কথা। পাঠকের চেয়েও গল্পকথক বারবার কেন্দ্রিয় চরিত্রে উঠে আসেন। পাঠকের আসন শূন্য করে মঞ্চের কেদারায় পৌঁছাবার আগেই তিনি ‘আমি’ হয়ে উঠে আসেন গল্পের টানে। ‘ওম’ গল্পটি তেমন। নিজের পারিবারিক ঘনাবলির ক্ষুদ্র একটি ট্র্যাজিক গল্প। চোখে জল এনে দেয়। বিষ পান করে মৃত মেয়েটির কম্বল বাবার শরীরে জীবন রক্ষার ওম হয়ে ওঠে আসে। মৃত্যুর শীতলতার ভেতর জীবনের ওম কে চেপে ধরে রাখে।
আবেগের খুব সহজ প্রবেশাধিকার তিনি পরিহার করতে পারেননি। তবে আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে দেননি গল্পের চরিত্রদের। এভাবেই গল্পের প্রতি সুবিচার করেছেন। পরিমিতিবোধ, নান্দনিকতা ও নিরপেক্ষ জীবনদর্শন নিয়ে তিনি বেশিরভাগ গল্পেই এক রৈখিক প্রেমের ফাঁদ তৈরি রেখেছেন অথচ আগাগোড়া একটি সুন্দর পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। লাগাম গল্পকথকের হাতেই ছিল, কারণ তিনিই তো গল্পের বৃত্তের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজেরই অজান্তে। কখনো ছায়া কখনো আবছায়া হয়ে। একবার প্রশ্ন করেছিলাম এগুলো কি নিজেরই গল্প? বলেছিলেন, ‘লেখক বিভিন্নভাবে চরিত্রে বা চরিত্রের বাইরে থেকেই গল্পে অবস্থান করে। গল্পে চেনা অচেনা দুটো দিকই আছে। আবার রয়েছে চেনা মানুষের অচেনা গল্প।’ হাসান আজিজুল হক বলেছেন ‘স্মৃতির সিন্দুকে গাদা গাদা জিনিস হয়তো ঠেসে রাখা যায়, কিন্তু সে গুলো থেকে ভালো জিনিস চিনে চিনে বের করা অত সহজ নয়।’ নূর কামরুন নাহার চেষ্টা করেছেন তা খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে। পেরেছেনও। তবে গল্পের পাশাপাশি তিনি বড় ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন একাধারে কথাসাহিত্য আবার তিনি কবিও।
অহেতুক চরিত্রের ভিড়ে সে ভারাক্রান্ত নয় যখন ছোটগল্পের সংজ্ঞাকে এভাবেই বিশ্লেষণ করতে হয় তখন কোনো কোনো কথাসাহিত্যের লেখকগণ ইঙ্গিতময় বর্ণনায় না গিয়ে বিবৃতিমুখ্য বিন্যাস ঘটান। তখন গল্প হয়েও তা ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য থেকে ছিটকে যায়। এমনটা নূর কামরুন নাহারের বেলায়ও ঘটেছে। লক্ষ্যভেদি গল্পকথক আর কথা সাহিত্যিক—এ দুয়ের মিশ্রণ ঘটে গেছে। বিশেষ করে তার প্রথম গ্রন্থের ‘পাঁচবোন’ ও ঈদসংখ্যা ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘লাউয়ের ডগা’ গল্পে।
তবে তার অনেক গল্পই শোষিত নারী সমাজের জীবন সংগ্রাম বা দৈনন্দিন বিচিত্র জীবন ধারার ইশতেহার হয়ে যেতে পারতো। তা করেননি লেখক তিনি শুধু অবিবেচক সমাজপদ্ধতির মূল্যকে নাড়া না দিলেও কলমের আশ্রয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী। কখনো মনে হতে পারে গল্পের চরিত্র আক্রান্ত অথচ কারোরই আক্রমণ করার ক্ষমতা নেই। আবার বলা যায় নূর কামরুন নাহারের গল্পে নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা নেই, তবে কাম আছে।
শেষ কথায় বলা যায় তার গল্প স্রোতশীল। কোলাহল সরিয়ে দিয়ে একটু থিতু হওয়ার চেষ্টা করেছেন গল্পে। অন্দরমহলের কথা তুলে এনেছেন বেশিরভাগ গল্পে। নারী কেন্দ্রিক দৈন্য, হতাশা, নিপীড়ন, আতঙ্ক ও ভালোবাসাকে স্বাভাবিক কথকের শৈলিতে গাঁথতে পেরেছেন। কোনো দূরহ বিষয় নেই, ভঙ্গির দুর্বোধ্যতা নেই। মনোজগতের স্বাভাবিক বিষয় কোনো জটিল ভাবনা নেই আবার কোথাও আছেও। রাষ্ট্রিক বা সামাজিক বিপুল সংঘাত তার গল্পে নেই  রয়েছে লেখকের ব্যক্তি-বেদনার ছলাৎছল জলের আলোড়ন। যা ট্র্যাজেডিতে রূপান্তরিত। তার গল্পে নারী কখনোই পরাজিত নয়। হয়তো নিজের কঠোর মনোভাবের কারণেই তা ঘটেছে। তবে অনেক গল্পে তিনি চরমরূপে নারীবাদী চেতনায় সঘোষিত ও চিত্রিত, তবে প্রকাশের মাত্রাভেদ আছে, তার নারী চরিত্ররা দৃঢ়চেতা ও ব্যক্তিত্বময়ী। আবার পাঠক যখন ভেবেছেন তিনি নারীবাদীর চরম অবস্থানে রয়েছেন, ঠিক তখনই দ্রোহ ঘোষণা করেছেন যেমন ‘শোপিস’ গল্পে। গল্পকথক কখনো নিজের অবচেতন মনে নিজেকেই যত্ন করে গড়তে গড়তে একসময় আবার ঠিক ততটা যত্ন নিয়েই ভেঙে চুড়মার করে দেন। ‘বর্ণচোরা’ গল্পটি লেখকের হাতেই চরিত্রটা গড়ে উঠেছে শেষকালে তাকে তিনি ছুড়ে দিলেন মোহের গহ্বরে হারাতে সাহায্যই করেছেন। সুপাঠ্য, দুর্দান্ত গতিময়তা সঞ্চারণ করে। তবে কখনো কখনো অতিরিক্ত মেদ ও পুনর্কথন গল্পের কাঠামোর ভেতর প্রয়োজনীয় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে বা কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়ে বরং আতিরিক্ত ভাবনায় ফেলে দেয়, তবে সেটাও একটা অ্যাভিনিউ তৈরি করে দেয় পাঠকের ভাবনায়। তার গল্পগুলো কাগুজে হয়ে ওঠেনি যদিও তার গল্পের চরিত্রে অবিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বা পটভূমি নেই। নেই পর্যাপ্ত যুদ্ধের ইতিহাস নির্ভর রোমাঞ্চকর ঘটনা, নেই ভাষা আন্দোলনের সুবিশাল পটভূমি যা এদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে সুসংগঠিত।
তার গল্পে নির্নিমেষ হাতছানি নেই, অন্তর্গত চাপা ভাবনাগুলোকে পাঠক খুলে দেখতে চাইলে পাবে। এটাও একধরণের ভঙ্গি না বলেও বলে দেওয়া। আবার কোনো কোনো গল্প যে দীর্ঘ স্বগোতোক্তি যা পাঠকের কাছে প্রেরিত হয়ে রইল। নির্মেদ নির্মোহ ভাবনায় গার্হস্থ্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের যাপনের খণ্ডছবি দক্ষতার সাথে তুলে ধরেন তিনি। তখনই বলতে ইচ্ছে করে যে গল্পের হৃদয় আছে। গল্পদেরও ভালোবাসা হয়। প্রাণহীনের প্রাণ যেমন মানুষকে বিস্মিত করে তেমনি। বিমূর্তভাবনা বা চোরাবালির হৃদয়ের মতো। খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে হয় কতটা টানে। এসবই আসলে গল্পস্রষ্টা আর পাঠকের রশি খেলা, টানাটানি। বিনোদনের খেলা। যেখানে দু’পক্ষই জয়ী। মিমাংসার বৌদ্ধিক আবেদন নেই, মনোস্তাত্ত্বিক জটিলতায় নিরীক্ষাধর্মী গল্পচর্চার তৃষ্ণার্ত পাঠককূল নিরাশ হবেন না। গল্পের এই নিরবিচ্ছিন্ন ধারাটি নিশ্চিতভাবে ধরে আছেন নূর কামরুন নাহার। শুভকামনা রইলো।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন