X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাটা জিভের উচ্চারণ

মোস্তাক আহমাদ দীন
১১ মার্চ ২০২১, ০০:০০আপডেট : ১১ মার্চ ২০২১, ০০:০০

শেলী নাজের জন্ম ১১ মার্চ হবিগঞ্জে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। পরবর্তীকালে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর বর্তমানে তিনি মেলবোর্নের সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। তার গবেষণার বিষয় বাংলাদেশে পুরুষতন্ত্র এবং যৌন নির্যাতন ও বাণিজ্যিকায়নের শিকার কন্যাশিশুদের post-traumatic stress disorder and secondary victimization। কবিতার বই ৮টি। 
............................................................................................................................

 

উৎসর্গ

বাবাকে

চির প্রস্থানের পর আমি যার কবরের মাটি

স্পর্শ করতে পারিনি

নারী বলে

উৎসর্গলিপি পড়ার মধ্য দিয়ে এ-আলোচনা শুরু করার প্রথম কারণ, এর মধ্যেই তাঁর কবিতার—অন্তত এ-বইয়ের—বীজসূত্র নিহিত, দ্বিতীয় কারণ, আরজ আলী মাতুব্বরের মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছবি তুলতে না-পারার ঘটনাটিকে আবারো সকলকে মনে করিয়ে দেওয়া। এই দুটি ঘটনাকে এককাতারে দাঁড় করালে প্রতিবন্ধ হিসেবে একটিতে দেখতে পাই পুরুষ, অপরটিতে ধর্ম—অবশ্য আরো খোলাসা করে বলতে গেলে দুটি ঘটনারই প্রতিবন্ধ ধর্ম, ঠিক ধর্মও নয়, (ধর্ম)আচার। পরে আরজ আলী শাস্ত্র তন্ন-তন্ন করে বিধিনিষেধের উৎস ও কারণ খোঁজেন, প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন, শাস্ত্রীদের অস্বস্তিতে ফেলেন এবং তাদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠেন। আর শেলীকেও, অন্যভাবে, ঠিক তা-ই করতে হয়েছে, খুঁজে দেখতে হয়েছে নারী হিসেবে তাঁর অসহায়ত্ব ও নির্ভরতার আনাচকানাচ—এই তদন্তে তার সরেজমিন/পাঠ/মাধ্যম হলো শরীর : কামনা বাসনা, এতে তার মুখোমুখি প্রতিনিয়তই পুরুষ, সব সময় ধর্ম নয়, অথবা, হয়তো ধর্মই—ধর্ম ও পুরুষের যুগলরূপ। অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্ব নয় কোনোভাবেই, এই সূত্রে আবারো স্মরণ করতে বলি শেলী নাজের বইয়ের নাম : ‘সুচের ওপর হাঁটি’, এতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যে একরোখা নয়, রয়েছে নানা দ্বন্দ্ব-অনুষঙ্গের উপস্থিতিও, নামটি সেই দিকটিরই ইঙ্গিতবহ। 

সাধারণত যে-কোনো কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কবির বিশেষ বিবেচনা থাকে, যদি ধরি এ-বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, তবু বলব, এর বক্তব্যই এ-বইয়ের মূল প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে না; কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বইয়ে এই প্রবণতাই গুরুত্ব পেয়েছি বেশি। বইয়ের প্রথম কবিতা ‘মাংসাশী’তে রয়েছে এক নারকীয় শহরের বর্ণনা, যেখানে শহর নিজেই ক্ষুধার্ত, মাংসাশী, আদিম, সবুজ রোমশে ভরা যার টালিছাদ, যার রাস্তা, শপিংমল, মাথার উপরের চাঁদ, হা-করা দরোজা, গলি, যানজট, মাদ্রাসার গোলটুপি, রাত্রির পুলিশ ভ্যান, প্রেমিক (বিষয়ের বৈভিন্ন্যই বলে দিচ্ছে তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারত) —এরা সকলেই নখ প্রদর্শন করে, সাঁড়াশি অভিযানের পরে যেখানে ধরা পড়ে ‘রক্তাক্ত পালকে ঢাকা/দুই বুক, দুই ছিন্ন নদী মিসৌরি ও মিসিসিপি’, যেখানে পাদরি-পুরুত ধর্মান্ধ ও রক্তলোলুপ, পুরুষেরাও মাংসাশী, চায় আগ্নেয় চুম্বন, মাংস, নগ্ন এভিনিউ, রঙিন আঙরাখার নিচে মারণাস্ত্র, হরিয়াল, রাধার বুকের শাঁস, অন্তর্বাস, উত্তরীয়—এখানে প্রেম হচ্ছে ‘অচল মিথ’; তবু শেলীর উক্তি:

এই তো মাংসের রেণু, বেণুবনে কাঁদছি একা, পুড়ে যাচ্ছি জ্বরে

মাংস বিক্রি করে কিনি প্রেম, প্রাণবায়ু মাংসাশী শহরে!

বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা ‘ঝাঁঝরি’র শুরুও হয়েছে জল কামনা করে, কিন্তু ‘প্রেম’-এর দু-চোখ থেকে ঝরে পড়ে লবণ, ‘তাহাদের সুতীব্র লাঙল’ মাটি ফুঁড়ে কর্ষণে যায়, ঝাড়বাতি ভেঙে চুরমার হয় আলো, রক্তে ভাসে সমুদ্র তরী; দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে সেই পুরুষের কথা, যে কিনা চৌকাঠে আগুন থাকা সত্ত্বেও, উত্তুঙ্গ মাস্তুলে গ্রহণের কালে নিরক্ষরের মতো কোনো কিছু না পড়েই ‘একটা খাদক হয়ে ঢেউগুচ্ছ প্লেটে তুলে...’ নেয়; ফলে, শেষ স্তবকে অন্য রূপে পাই প্রেমার্থীর আকুলতা :

আমার বাগান ছিল ফুল্ল, বাগানী ছিল না প্রেমেতে প্রণত

অথচ চেয়েছি জলের ঝাঁঝরি দিয়ে তপ্ত মাংসকুঞ্জ নয়

কেউ যদি সারারাত হৃৎপিণ্ড ঠাণ্ডা করে দিত!  

কিন্তু এই ‘প্রেম’ ব্যাপারটা কী, যা উপরের দুটি কবিতা ছাড়াও এসেছে বইয়ের অন্যান্য কবিতায়ও, এবং পুরুষের কাছে যা চেয়েও বারবার ব্যর্থ হতে হয়েছে তাঁকে/নারীকে? মধ্যযুগের পর থেকে আপাত-অশরীর চেতনাই যে ‘প্রেম’-এর ধারণায় পরিণত হয়েছে, বাঙালী জীবনে রমণী  বইয়ে দুই কবির দুটি কবিতার দৃষ্টান্তসহ তার  বর্ণনা দিয়েছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী—শেলীর ‘প্রেম’-এর ধারণা সেরকম নয়, তাঁর কবিতায় যখনই প্রেমের প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানে এসেছে শরীরের প্রসঙ্গও। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে পারেন, স্বর্গে তার কাজ নেই, সেখানে পুরুষ হয়তো পাবে ‘অযুত অপ্সরী’, তাতে তাঁর কী? তাঁর ঘোষণা : ‘আমি চাই ভেলভেটে তোমার সুঠাম বাহু দক্ষ জহুরীর’; তাহলে, সুঠাম বাহুর অধিকারী যে দক্ষ জহুরী, তাকে তাঁর প্রেমিক বলে কি ধরে নেওয়া যায়?  শুধু এতেই কাউকে পূর্ণপ্রেমিক বলে ধরে নেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। করি আরও কিছু চান, সেরকম কিছু, যার অভাবে কবিকে লিখতে হয় নিম্নোক্ত কবিতাটি:        

পিপাসা বেড়েছে বলে নিদাঘ অঞ্চলে ত্বকে খাড়ি ওঠে

পুরুষের মধ্যে প্রেম পাব বলে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছি

জলহীন, পতঙ্গ ও অন্ধকার পাচ্ছি, প্রার্থিত বৈকুণ্ঠে

 

পুরুষই নিমন্ত্রণ করে, ডেকে আনে জাপানি চা-পর্বে

অরণ্য প্রস্তুত রাখি, সপ্তঋতু পাব, জাফরান মাখব শরীরে

ভাবি তুন্দ্রাঘাসে অসহ্য তূণীর থেকে বিশল্যকরণী ঝরবে

 

যখন জ্বলছি, পম্পেই নগরী, চেয়েছি ভেষজ পুরুষের

নিশিন্দা পাতার তেতো আর ক্ষারে ভরেছে কলস

সামান্য দিতেই সাড়া, শঙ্খিনী লতার মতো বেঁধেছে কুরুশে

 

পুরুষের মধ্যে বাসা পাব ভেবে তার দিকে গেছি

দেখি তার বুকে কারাগার, ভ’রে আছে রঙিন তন্তুতে

সমস্ত শিখর ভুলের মাধুর্যে রেখে উড়ে গেছে চতুর  

এ-কবিতার ভাবের সঙ্গে সাদৃশ্যময় আরো কবিতা রয়েছে এ-বইয়ে, যেখানে প্রেম খুঁজতে গিয়ে অন্যভাবে প্রতারিত হতে হয় নারীকে, (অন্য অনুষঙ্গে) ‘নিশিন্দার তেতো আর ক্ষারে’ কলস ভরে যায়, পুরুষের বুকে দেখতে পায় কারাগার।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে প্রতিনিয়ত এমন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আসতে হয় বলেই তাকে কখনো-কখনো আত্মরক্ষার আশ্রয় নিতে হয়, তপ্ত বালুকার নিচে লুকিয়ে রাখতে হয় ঝরনাকে, নুপুংশক শূকরেরা যাতে কাদা ফেলে নাভিমণ্ডলের নীল রতি জোছনায় উঠে না আসে, সেজন্য নিজের ঝরনাকে নিজেকেই পাহারা না দিয়ে উপায় নেই তার। কিন্তু এরকম আত্মরক্ষামূলক প্রবণতার পরিচয় বইয়ের অন্যান্য কবিতায় বেশি নেই, বরং বেশ কয়েকটি কবিতায় তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে প্রেমের অভাবের কারণে, আগ্রাসী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং এটিই হচ্ছে বইয়ের অন্যতম (প্রধান) প্রবণতা। ‘হরিণী’ কবিতায় কবি প্রশ্ন করেন, সবুজাভ পাহাড়ের ভাঁজে হরিণী কেন নিজেকে লুকিয়ে রাখবে; লেখেন ‘হরিণীর হতে পারে ইচ্ছে, মরে যেতে যেতে/নিষাদের তীর কেড়ে নিতে/ব্যঘ্র শাবককে গাঁথতে পারে সে আকাঙ্ক্ষার কিরিচে/...তীব্র ও গরম তীর, বাতাসকে চিরে ছোটে বাঘের মাংসে/হরিণীও খেতে ভালোবাসে তাজা রক্ত আর প্রেম বহুলাংশে!’ এ-হলো পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধের তীব্র প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টান্ত। তাঁর ‘উদ্যাপন’ কবিতাকে সরাসরি নারীজাগরণী কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যার  শুরু হয়েছে এমন উল্লিখনের মাধ্যমে যে : ‘ওগো পান্থনারী ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে?/লাঞ্চনার কাঁটাভরা গ্রহে, কারাকুঞ্জে জানলাবিহীন’, এই  স্তবকের শেষ পঙ্ক্তি দুটি একেবারে সরাসরি ও স্পষ্ট:

খুলে দাও কেশদাম, ফেলে এসো বিষধর বর ও কবর

এবার ওঙ্কার, ধ্বংসের চূড়োয় আজ ধ্বজা ওড়ানোর দিন

কবিতাটির শেষ হচ্ছে এই কথা বলে যে, পান্থনারী যেন তার খসে-পড়া মস্তক কুড়িয়ে এনে তাতে রঙিন মুকুট পড়ে নেয়। তবে তাঁর ‘মাতৃমূর্তি’ কবিতায় জগৎ-বাস্তবতার কারণে প্রতিবাদের ধরন বদলে গেছে। এমনিতে কবিতাটির শুরু হয়েছে চলতি ধারণার বিপরীত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে, যেখানে কবি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘মাতৃত্বে নারীর পূর্ণতা, কোন মূর্খ বলেছে তা?/আমি ঘৃণা করি এই স্তুতি, সর্বংসহা মুখ ও মমতা/যা ভাত মাখছে, খেতে দিচ্ছে আমাদের, নিজ পাতে নিচ্ছে বিষ’, কিন্তু  দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তবকে উঠে আসে সেই বাস্তবতা, যে-কারণে একজন নারী পুরুষনির্মিত প্রতিমাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি লেখেন, যদি জরায়ু উচ্ছেদ করে গর্ভিনী না হন, পাশবিক বৈকল্য, প্রসূতির ব্যথা ও ক্ষরণ, মেধা অপচয় ও জীবনমরণ উৎসর্গের ভূমিকা মেনে না নেন, যদি ছুঁড়ে ফেলে দেন রত্নগর্ভার মুকুট? যদি অস্বীকৃতি জানান ত্যাগে, ‘জীব’পালনে, যদি অস্বীকার করেন ‘বাৎসল্যের বেদিমূলে গলা পেতে দিতে’, তাহলে কী হবে? তাঁর ভাষায়:

জানি পুরুষসভ্যতা আমাকে কখনো করবে না ক্ষমা

কেননা প্রজন্ম টিকে থাকে প্রতিদিন একটু একটু করে আমার মৃত্যুতে!

কবি জানেন পুরুষসভ্যতা নারীর ক্রমমৃত্যুর মধ্য দিয়ে টিকে থাকে, এ-কথা জেনেও  পুরুষ নারীকে আত্মত্যাগে বাধ্য করে বা একটু-একটু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু এ-কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না যে বাৎসল্যের প্রতি নারীর এ-আত্মত্যাগের ভূমিকায় পুরুষের সক্রিয়তা যেমন আছে প্রাকৃতিক সম্বন্ধও সেখানে কম নয়। এ-কারণেই হয়তো অন্য কবিতায় কবিকে প্রকৃতি বা লিঙ্গ-পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করতে দেখা যায়, বলছি ‘রাধালীলা’ কবিতার কথা, যেখানে কবির (বিপরীত) কল্পনা : রাধার যোলশ কৃষ্ণ, সে এখন কালিন্দীর কূলে বাঁশি বাজাবে, তার নিভৃত ও লীলায়িত অগ্নি বঙ্কিম সুষমায় ছড়িয়ে দেবে আর পুড়তে থাকবে কৃষ্ণ—কবি আরও কল্পনা করছেন—শরীরপোড়ানো জ্বরে আর ঘোরে ছটফটাচ্ছে বিরহী কৃষ্ণ, ঘাস পুড়ছে, কৃষ্ণকে প্রেমের বিষম যাঁতাকলে পিষে দু-পায়ে মাড়িয়ে মথুরায় যাচ্ছে রাধা—বড়ু চণ্ডীদাসকে বলছেন কবি—এখন লেখো শ্রীরাধাকীর্তন, রাধাপূজা হবে, শোণিতে ও দ্রোণফুলে ভরে উঠবে কৃষ্ণের অঞ্জলি, এখন জগতের সবচেয়ে কাঙাল হবে কৃষ্ণ, রাধা এখন আর কারও একার নয়, শতজনের সঙ্গে হোলি খেলবে সে, আর—

রঙভরা বৃন্দাবনে ষোলশ গোপের অঙ্গে রাধার তাড়না

চিরকাল ভগবান কৃষ্ণই খেলবে রাধা বুঝি খেলবে না?

কবির এ-প্রশ্নে পাঠকের মনে পড়বে রাধাকে নতুনরূপে-উপস্থাপনকারী জ্ঞানদাসের সেই পদের কথা, যেখানে সে কৃষ্ণের বেশ ধারণ করতে ব্যগ্র:

তোমার পীতধটি আমারে দেহ পরি।

উঁচু করি বাঁধ চূড়া আউলাইয়া কবরি।

কৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ তাকে কতটা বিচলিত করে, কুল-মান-সমাজ-সংসার ভুলিয়ে উন্মাদিনী করে তোলে, তা কি কৃষ্ণ বোঝে? বোঝে না বলেই—বুঝিয়ে-দেওয়ার জন্যই—এই বেশধারণ। কিন্তু বেশধারণই তো শেষ কথা নয়, এর মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই কোথাও পৌঁছুতে চায় রাধা। জ্ঞানদাসের অন্য দুটি পঙক্তি পড়লেই বুঝতে পারব রাধার চাওয়াটা আসলে কী:     

এক রন্ধ্রে ফুঁক তবে দেয় রাধাকানু।

রাধাশ্যাম দুটি নাম বাজে ভিনু ভিনু ॥

উদ্ধৃত পঙক্তি দুটি পড়ে নিলে বাঁশির একরন্ধ্রে ফুঁ-দেওয়া আর একসঙ্গে রাধাশ্যাম উচ্চারিত হওয়ার মাধ্যমে সুচের ওপর হাঁটতে-থাকা কবির/নারীর/সুচকন্যার আকাঙ্ক্ষা/বাসনার প্রতীকায়ত রূপের পরিচয়টুকু পেতে পারি আমরা। স্বীকার করছি, তাঁর বইয়ে রয়েছে প্রতিরোধ/অভিযোগ/সন্দেহমূলক বাক্য : ‘ও তক্ষক পুরুষ সকল, দরজাকে বিরক্ত করো না’, ‘বোকা মেয়ে, ফের তুই খাল কেটে কুমির ডাকলি?’, ‘মুহুর্মুহু ঝরবার পর/বলো, তুমি তার শরীরের প্রতিটি টুকরোতে/এঁকে দেবে তোমার সিলমোহর?’, তবু  তাঁর কবিতায় আছে (উপরিউদ্ধৃত ‘রাধা’-ভাবী) প্রেমকাতরতা ও আহ্বান, এ-আহ্বান/প্রেমকাতরতা (সহৃদয় কি না জানি না, কিন্তু) হৃৎপিণ্ড-শান্তকারী, এবং অশরীর নয়, সশরীর; এ-আহ্বান/প্রেমকাতরতা কবির/নারীর জন্য বা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সদর্থ ও সম্ভাবনাময়:

১.

ধানিরঙ ওড়নায় ঢাকা জোড়ামমি কতো আর থাকবে ঘুমিয়ে?

বর্ষাফলা বুকে নিতে মোম জ্বেলে বেসে আছি একাকিনী তীর্থভূমি

শরীরে আসবে কবে সেসব ডাকাত বৃষ্টি, সহস্র বল্লম নিয়ে!

[তীর্থভূমি]

২.

জেলেনি জ্বালেনি দীপ, নির্জন মন্দিরে রাত্রি আষাঢ়স্য

শহর জেলেনি খুঁজিতেছে ঝড়-জলে তার পুরুষ-মৎস্য!

[জেলেনি]

৩.

চলে যাবে ভেবে নীল ওড়নায় বেঁধে রাখি শিকারির দুই চোখ

আমি যাচ্ছি রসাতলে, তোমার অতলে আর

মধুরঙে ভরে যাচ্ছে আমার সমস্ত ঊর্ধ্বলোক!

[আধার]

৪.

তৃষ্ণার ভেতরে যত ডালপালা চন্দনপ্রলেপ মাখা

যেখানে যা ছিল বহুদিন অক্ষত ও ঢাকা

সেসব ভূমিতে তুমি হে অপরূপ কুহক

খুলে দাও তাহিতির জল, অশান্তির কিনারে কিনারে

শান্ত দুধের বাটিরা ছলকে উঠুক

সে বলুক,

হে ঈশ্বর, বাঁচতে কে চায়, যদি মরে যেতে এত সুখ!

[মৃত্যুর মাধুরী]

আরও একাধিক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে—এ-নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না, প্রশ্ন উঠতে পারে বইয়ের সকল প্রবণতারই কেন্দ্রস্থল হিসেবে শরীরব্যাপারের উপস্থিতির তীব্রতা নিয়ে; এতে রয়েছে উপমা-উৎপেক্ষা-প্রতীক-অলংকারের ভিন্নতা, আছে প্রবণতাগত ভিন্নতাও, তবু বিষয় এক—সেই শরীর, যার মূলে দূর/অদূরবর্তী অচরিতার্থ কামনা; কিন্তু এর বাইরেও তো পুরুষপ্রাধান্যের আরো বহু দিক/ব্যাপার রয়েছে যে-কারণে নারী কথা বলতে পারছে না, দাঁড়াতে পারছে না, যার বড় প্রমাণ তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্র—এই সব প্রসঙ্গ ও পরিপ্রেক্ষিত উঠে আসতে পারত তাঁর কবিতায়। এমনিতে বইয়ের ফ্ল্যাপে যে আছে ‘নানা অভিঘাত ও অভিলাষে চূর্ণবিচূর্ণ হতে হতে তার কবিতায় নারীর মন ও মাংস কথা বলে উঠেছে এমন এক ভাষায়, যা শোনার জন্য এখনো প্রস্তুত নয় পুরুষতন্ত্রের শ্রবণেন্দ্রিয়’, এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে লিঙ্গ-বিচারে, পুরুষ হিসেবে, আমার নিজেকে এতটুকু অপ্রস্তুত মনে হয়নি, খনার অক্ষত জিভের বচনে বাস্তব-জ্ঞান হয়তো বেশিই থাকবে, কিন্তু কাটা জিভের উচ্চারণ তো ঝাঁঝালো আর অসংযমী হবেই। আশা করছি, তাঁর ঘরানার পূর্ববর্তী কোনো-কোনো কবির কবিতা যে-অসংযম, পরিপ্রেক্ষিত-সামগ্র্যের দৈন্য ও দর্শনগত অস্বচ্ছতার কারণে বিগারগ্রস্ত ও ব্যর্থ হয়েছে, সেই প্রবণতা যেন তাঁর কবিতায় স্থায়ী না হয়। কারণ, তাঁর রয়েছে শব্দ-চেতনা, পুরোনো শব্দ ভেঙে বাজিয়ে নতুন-করে-তোলার ক্ষমতা, ছন্দবোধ আর পুরাণ-জ্ঞান—শেলীর এই ক্ষমতা এখনি তুল্য হতে পারে সিন্ধু দ্রাবিড়ের মেয়ে ও চল্লিশ চাঁদের আয়ু-পর্যায়ের মিতবাক ও সফল কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের সঙ্গে।

সুচের ওপর হাঁটি। শেলী নাজ। বেঙ্গল পাবলিকেশনস, ঢাকা, জানুয়ারি, ২০১৩।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ