X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মশতবর্ষে শাহির লুধিয়ানভি

দিলওয়ার হাসান
১২ মার্চ ২০২১, ০২:০৯আপডেট : ১২ মার্চ ২০২১, ০২:০৯

৮ মার্চ, উপমহাদেশের খ্যাতনামা কবি ও গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২১ সালের এই দিনে তিনি পাঞ্জাবের লুধিয়ানার করিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

তার আসল নাম আবদুল হাই। বাবা ধনাঢ্য জমিদার চৌধুরী ফজল মোহাম্মদ আর মা সর্দার বেগম। স্বামীর সঙ্গে তার মায়ের তিক্ত সম্পর্কের কারণে শাহিরের জন্মের ছ-মাস পরই মা তাকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়েন ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে। ১৯৩৪ সালে তার বাবা আবার বিয়ে করেন আর তার মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তারপরও ছেলের ভরণপোষণের জন্য স্বামীর সহায়তার প্রয়োজন হয় তার মায়ের। শতকষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যেও তিনি ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে কোনো আপস করেননি। শাহির সারাজীবন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন তার মাকে আর হৃদয় দিয়ে ঘৃণা করেছেন বাবাকে।

তিনি পড়াশোনা করেছেন লুধিয়ানার খালশা হাই স্কুল ও সতিশচন্দ্র ধাওয়ান সরকারি কলেজে। কলেজে তিনি অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ ফেডারেশনের সংস্পর্শে আসেন ও একজন উদ্দীপ্ত কমিউনিস্টে পরিণত হন। তখন থেকেই তার কাব্যচর্চা শুরু। কলেজে প্রথম এক সহপাঠীর প্রেমে পড়েন। তারপর প্রেম হয় আরো দুজনের সঙ্গে, বিয়োগান্তক পরিণতি ঘটে দুটি প্রেমেরই।

গজল ও নজমের জন্য তখন তিনি কলেজে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। উর্দু ও হিন্দি দু-ভাষাতেই লিখতেন তিনি। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় অধ্যক্ষের দফতরের লনে এক সহপাঠীর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে আলাপের অভিযোগে কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সেটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা। বাধ্য হয়ে তিনি লাহোরের দয়াল সিং কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। ওই কলেজে তিনি ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৪৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তালখিয়া’ (তিক্ততা) প্রকাশিত হয়। শাহির শুরু থেকেই এমন এক কবি যিনি তাজমহলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার গুণগান না-করে লেখেন: ‘এক শাহেনশাহ নে দৌলতকা সাহারা লেকার হাম গরিবো কি মোহাব্বত কা উড়ায়া হায় মজাক!’

তিনি সেই সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্বাক্ষর’, ‘আদব-ই-লতিফ’ ও ‘সাভেরা’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তখনই তিনি প্রগতি লেখক সংঘের সদস্য হন। কমিউনিজমের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করায় পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে।

১৯৪৯ সালে তিনি লাহোর থেকে দিল্লি চলে আসেন। অচিরেই তিনি স্থানান্তরিত হন মুম্বাইয়ে। আন্ধেরিতে বাসা ভাড়া করেন। ওই এলাকায় তার প্রতিবেশী ছিলেন আর দুই মহারথী, স্বনামধন্য কবি ও গীতিকার গুলজার এবং বিশিষ্ট লেখক কৃষণ চন্দর। ১৯৭০ সালের দিকে মুম্বাইয়ের একটা বাংলো কিনে সেখানে উঠে যান তিনি। বাংলোর নাম দেন পরছাইয়া। আজীবন ওখানেই ছিলেন।

১৯৪৪ সালে শাহিরের সঙ্গে এক মুশায়রায় পরিচয় হয় পাঞ্জাবি সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক অমৃতা প্রীতমের। বিবাহিত ও অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী এই নারী শাহিরের প্রেমে পড়েন প্রবল আবেগে। স্বভাবতই এই সম্পর্ক অবৈধ ও পরকীয়া অভিধা লাভ করে। শাহিরের জন্য তিনি ছেড়ে আসেন স্বামীর ঘর।

শাহির অমৃতার প্রথম প্রেম। অনেকেই বলেছেন, নিছক প্রেম ছিল না তা, ছিল এক প্রবল আবেশ। এই প্রেমকে পূর্ণতা দিতে অমৃতার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু শাহিরকে তেমন একটা উজ্জীবিত হতে দেখা যেত না। তিনি আসতেন তার বাড়িতে, একটার পর একটা সিগারেট টানতেন। নিরবে বসে থেকে চলে যেতেন একসময়। অমৃতা তার আত্মজীবনী রসিদি টিকেটে লিখেছেন, অ্যাসট্রে ভরে উঠত সিগারেটের অবশিষ্ঠাংশে। সেখান থেকে তা তুলে নিয়ে টানতাম। মনে হতো শাহিরের স্পর্শ লাভ করছি। এভাবেই ধূমপানে আসক্ত হয়েছিলাম এক সময়।

শাহিরের ভালোবাসা জারিত বই ‘সুনহরের’ জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান অমৃতা। তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি ওই সাহিত্যকর্মটি পৃথিবীর মানুষের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্ত একটা সৃষ্টি হিসেবে পৌঁছুক তা তিনি চাননি। যার জন্য এই বই লেখা সেই শাহির লুধিয়ানভির কাছে তা পৌঁছুল কিনা সেটাই তাকে ভাবাতো।

শাহিরকে না-পেলেও অমৃতার জীবনের পেয়ালা পূর্ণ করে দেন খ্যাতিমান শিল্পী ইমরোজ। তারই ছায়াতলে অতিবাহিত করেন চল্লিশ বছর—বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ না-হয়ে, সমাজ ও সংসারের  নিয়মকানুন না-মেনে। ইমরোজের ভাষায়: শাহির অমৃতার অপূর্ণ তৃষ্ণা, যাকে উপেক্ষা করা যায় না, যার দৃষ্টিভ্রম অস্থির করে রাখে সারাজীবন, আর আমি অমৃতার অবশ্যম্ভাবী শান্তি, পরিপূর্ণ বাস্তব, যাকে ছাড়া জীবন চলে না।

কৃষণ আদিব শাহিরের ওপর লেখা তার বই 'খাবান দা শাহজাদায়' লিখেছেন, 'তিনি অমৃতাকে ভালো বাসতেন পাগলের মতো, যদিও তা ছিল অল্প সময়ের জন্য। শাহির প্রতিটি নারীকেই পাগলের মতো ভালোবাসতেন। তার জীবনে অসংখ্য নারী এসেছিল। অমৃতা প্রথমও ছিলেন না, শেষও না।'

শাহির অভিনেত্রী ও গায়িকা সুধা মালহোতরার প্রেমেও পড়েছিলেন। একবার নাকি মাকে বলেছিলেন, ও অমৃতা প্রীতম। ও আপকি বধূ বন সাকতি থি। ওই পর্যন্তই, কাউকে বিয়ে করতে উদ্যোগী হননি—সারাজীবন থেকে গেছেন অকৃতদার।

কবিতা ছাড়াও শাহির লিখেছেন অসংখ্য গান। যার অনেকগুলোই আলোড়ন তুলেছে বলিউডের চলচ্চিত্রে: তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনে গা, আল্লাহ তেরা নাম ঈশ্বর তেরা নাম, ম্যায় পল দো পল কা শায়ার হু, চলো একবার ফিরছে আজনবি বন জায়ে হাম দোনো, কভি কভি মেরা দিল মে খ্যায়াল আতা, আয় মেরে জোহরাজাবিন, মেরা দিল মে আজ কেয়া হায়, আভি না যাও চোকদার।

১৯৪৯ সালে আজাদি কি রাহ পার ছবির জন্য চারটি গান লিখে চলচ্চিত্র-সঙ্গীত রচনায় তার যাত্রা শুরু। তিনি কাজ করেছেন এস. ডি. বর্মনের মতো খ্যাতনামা সব সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে।

প্রিয় কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের মতো তার কবিতা ও গানে থাকতো বুদ্ধিবৃত্তিক বৈদগ্ধের ছাপ। ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পয়সা’ ছবিতে শাহিরের লেখা গানে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু।

সমসাময়িক কোনো কবি বা গীতিকারের লেখার সঙ্গে মিল ছিল না তার লেখার। শাহির লুধিয়ানভিই একমাত্র গীতিকার যার কবিতা একেবারে শুদ্ধভাবে চলচ্চিত্রের গান হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বিশেষ কোনো সিনেমায় ব্যবহারের জন্য গান রচনা করেননি তিনি, বরং প্রযোজকগণ তার গান বা কবিতা তাদের চলচ্চিত্রের জন্য খাপ-খাইয়ে নিয়েছেন। শাহির এমনই আত্মম্ভরী ছিলেন যে, তিনি দাবি করতেন—যখন যে সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করবেন তারচেয়ে এক টাকা হলেও বেশি পারিশ্রমিক দিতে হবে তাকে।

শাহির কখনোই মগ্ন হননি ঈশ্বর, সৌন্দর্য বা মদ্যপানীয়র স্তবগানে। নিরীশ্বরবাদ আর মুক্তচিন্তা সব সময়ই তাকে এক ভিন্ন পথে চলতে শিখিয়েছে। তাকে বলা হতো নিয়ত লাঞ্ছিতদের কণ্ঠস্বর। শেষ জীবনে এসে তিনি মদ ও সিগারেটে প্রচণ্ড আসক্ত হয়ে পড়েন।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শাহির ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান কয়েকবার। লাভ করেন পদ্মশ্রী খেতাব। তার নামে প্রচলন করা হয় স্মারক ডাকটিকেট। বিশিষ্ট লেখকগণ রচনা করেন তার জীবনীগ্রন্থ।

১৯৮০ সালের ২৫ অক্টোবর মাত্র ৫৯ বছর বয়সে মারা যান ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা কবি ও গীতিকার শাহির লুধিয়ানভি। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহাসমারোহে উদযাপিত  হবে তার জন্মশতবার্ষিকী।

 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক