X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জসীমউদ্দিনের প্রাসঙ্গিকতা-অপ্রাসঙ্গিকতা

ফেরদৌস মাহমুদ
১৪ মার্চ ২০২১, ১৫:১৫আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২১, ১৫:১৫

পত্রিকাতে পড়েছিলাম, কোনো এক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জসীমউদ্দিনের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে ‘কবর’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত একজন বাঙালি কবির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার কবিতা পাঠ করছেন ভাবতেই রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবছিলাম, তিনি কি জসীমউদ্দিনের কবিতা ঠিকঠিক অনুভব করতে পেরেছিলেন? জসীমউদ্দিনের কবিতায় এদেশের গ্রামীণ লোকজ জীবন, আবেগ ও অনুভূতি যেভাবে উঠে এসেছে, এক আমেরিকানের পক্ষে কি তা পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব? আমেরিকানরা তো ভাত খায় না, লুঙ্গি পরে না, দুর্বল গরু আর কাঠের লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করে না; আমেরিকানরা চিন্তায় ও জীবনযাপনে পরাশক্তি, তাদের পক্ষে কি বাঙালির আবেগ বোঝা সম্ভব? একজন আমেরিকানের বাংলাদেশ দেখতে আসা আর একজন বাংলাদেশির আমেরিকা দেখতে যাওয়া—দুইয়ের মধ্যে নিশ্চয় বিস্তর ফারাক। বাঙালি আমেরিকান হতে চায়, কিন্তু আমেরিকান কখনও বাঙালি হতে চায় না!

কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে একদিন জানতে পারি, মৃত্যুর ৪-৫ দিন বা সপ্তাহখানেক আগে জসীমউদ্দিন বাংলাএকাডেমির লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন—

‘আমার কবিতা ইন্দোনেশীয় ভাষায় অনুবাদ হইল না, জাপানি ভাষায় হইল না। কী হইল—চেক ভাষায়, রুশ ভাষায় হইল—ওরা কি ভাত খায় যে ওরা আমার কবিতা বুঝবে? যারা ভাত খায় তারা আমার কবিতা বুঝবে, যারা ভাত খায় না তারা তো আমার কবিতা বুঝবে না।’

আমার কাছে মনে হয়েছে জসীমউদ্দিনের এমন কথা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক। তিনি যখন কবর কবিতায় লেখেন ‘গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনোপথে যেত ঝরে,/ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।/ পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,/ চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।’—তা পশ্চিমা কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ নয়। আর যদি পশ্চিমা কেউ তা উপলব্ধি করতে চান, তা হবে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি। আর এই দৃষ্টিকোণটাই আমি দেখতে পাই জসীমউদ্দিনের কবিতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে হুল্লোড় সৃষ্টি করা কতিপয় নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত কবিদের মধ্যে।

জসীমউদ্দিনের একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘ধানক্ষেত’। আজকের সময় কবিতার বইয়ের এমন নাম রাখার কথা কি আদৌ ভাবা যায়? গত কয়েক দশক ধরে একটি কথা খুব শুনতে পাচ্ছি, জসীমউদ্দিন ছিলেন আমাদের শিকড়ের কবি। অনেকেই শিকড়ে ফেরার নামে জসীমীয় ভঙ্গিতে লিখতে চাইছেন। এদের কবিতাকে আমার কাছে হাইব্রিড কবিতা মনে হয়। এরা বোঝে না শিকড়ে থাকা আর শিকড়ে ফেরা দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। শিকড়ে ফেরা মানে শিকড়ে থাকা নয়। দুপেয়ে প্রাণী মানুষের শিকড় কখনও এক জায়গায় আটকে থাকে না। তারা হচ্ছে বটগাছের মতো, যেখানে যায় সেখানেই সে শিকড় বিস্তার করতে পারে। তার অতীতে ফেরার চেষ্টা ভ্রমণমাত্র, কিংবা পশ্চিমাপদ্ধতিতে নস্টালজিয়ায় ভোগা। একবেলার জন্য গ্রামে গিয়ে ভাবা খুব ফেরা হলো শিকড়ে। এই ফেরার প্রবণতা আমার কাছে কৃত্রিম মনে হয়, কৃত্রিমতা কখনই উপভোগ্য কিছু হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যে শিকড়ে ফেরার বিষয়টি যেভাবে সরলীকরণ করা হয়েছে, তা অনেক অপসাহিত্যের জন্ম দিচ্ছে। আমার মনে হয়, যে-যেই শ্রেণি বা ভূমিতে অবস্থান করছেন, বেড়ে উঠেছেন তা শহরের ফুটপাতে থাকা গাছের মতো নড়বড়ে হলেও সে উপলব্ধিই লেখা উচিত।

সম্প্রতি শিকড়-শিকড় বলে শ্লোগান দেওয়া এক তরুণের কবিতা পড়তে গিয়ে কিছুটা হতাশ হলাম, তিনি গ্রামবাংলাকে কবিতায় তুলে ধরতে চেয়েছেন আবার ভেতরে-ভেতরে লালন করা ওয়েস্ট্রার্ন কালচারটাকেও ফেলতে পারছেন না। ফলে তিনি ধানখেত আর ধানচাষের কথা বলেছেন তার কবিতায়, কিন্তু তাতে সমস্যা থেকে যাচ্ছে। লক্ষ করলাম—তার কবিতায় কৃষক ঘোড়া নিয়ে ধানখেতে যায়, তার রাখালের কোমরে থাকে পিস্তল। আমি এমন ঘোড়ায় চড়া পিস্তলধারী রাখাল এই বাংলার কোথাও দেখিনি। মনে পড়ল মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতার একটি লাইন, ‘বাঙালি স্বভাবে নেই ঘোড়া নিয়ে ফসল পাহারা’।

বুঝলাম, ওই কবি বাংলার মাটির সঙ্গে ওয়েস্টার্ন স্মার্টনেস মেলাতে চেয়ে বাংলাকে প্রকারান্তরে বিকৃত করে এঁকেছেন। কবিতাটি পড়তে গিয়ে জসীমউদ্দিনের একটি কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন—অনুভূতির সততাই ভালো কবিতার প্রাণ। নকল অনুভূতির কবিতা বেশি দূর এগুতে পারে না। 

শিকড়ে ফেরার নামে নকল অনুভূতি পাঠ করতে চাই না। জসীমউদ্দিন ঢাকায় থেকেও তৎকালীন ফরিদপুরের জীবনই যাপন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই জসীমউদ্দিনের কবিতায় এদেশের লোকজ জীবন, প্রকৃতি ও মানুষের বৈশিষ্ট্য যেভাবে পাওয়া যায় তার তুলনা নিঃসন্দেহে দুর্লভ। এক্ষেত্রে গত শতকের বাঙালি মুসলমানদের গ্রামীণ জীবনকে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর কবিতা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবে আজকের আমাদের নাগরিক জীবনের যে জটিলতা, ব্যক্তির ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব বা প্রতিনিয়ত নাগরিকদের যে লড়াই তার সঙ্গে এ কবিতার বড় বেশি দূরত্ব। এ প্রসঙ্গে এসেই তিনি যেন আমাদের কাছ থেকে কিছুটা দূরের হয়ে ওঠেন। আর এ জায়গাটাতেই জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আধুনিক কবিদের বড় দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি তাঁর অনুজ শামসুর রাহমান বা সে সময়ে আধুনিক কবিদের খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন না। যদিও আধুনিক কবিরা তাঁকে সম্মানের চোখেই দেখতেন, কেননা—জসীমউদ্দিন বাংলা কবিতায় নিজেই এক অকৃত্রিম ধারা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আমার বাবা শিশুসাহিত্যিক মাহমুদউল্লাহর পরিচয় ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার জন্মের আগের বছর জসীমউদ্দিন মারা যান! তাঁর ছেলে খুরশীদ আনোয়ার বাবাকে ‘সুচয়নী’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন। একদিন বইটির মাঝখান থেকে ওল্টাতেই চোখে পড়ে— 

কালো মেঘা নামো নামো, ফুল-তোলা মেঘ নামো

ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো,

কানা মেঘা টলমল বার মেঘার ভাই,

আর ফুটিক ডলক দিলে চীনার ভাত খাই!

কাজল মেঘা নামো নোমো চোখের কাজল দিয়া,

তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া!

আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,

নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি!

কৌটা-ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,

আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!

‘নক্সীকাঁথার মাঠ’-এর এ অংশ পড়ে মেঘগুলোকে যেন নতুনভাবে দেখতে শিখি। আকাশে মেঘ জমলেই বোঝার চেষ্টা করি, কোনটা আড়িয়া মেঘ, কোনটা হাড়িয়া বা কুড়িয়া বা সিঁদুর মেঘ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, নিজের প্রাণের মধ্যে, পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিবার ক্ষমতাকেই বলে কবিত্ব। জসীমউদ্দিনের কবিতাপাঠে এ কথাগুলো খুব সত্য মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, জসীমউদ্দিনই কি হতে পারতেন না আমাদের জাতীয় কবি। তাছাড়া জাতীয় কবি দুজন হলেই-বা দোষের কী!

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন