X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’

প্রভাষ আমিন
১৮ মার্চ ২০২১, ১৫:৪১আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২১, ১৫:৪৩

যে কারও জন্মদিনই আনন্দের। হোক সেটা ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের। তবে কোনও কোনও ব্যক্তির জন্ম ব্যক্তিগত আনন্দকে ছাপিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উৎফুল্ল করে। কোনও রাষ্ট্রের জন্ম গোটা বিশ্বকেই অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু তেমনই একজন ব্যক্তি, বাংলাদেশ তেমনই একটি রাষ্ট্র। মনে হতে পারে কাকতালীয়, কিন্তু কখনও কখনও কিছু কিছু সময় মিলে যায় ইতিহাসের মোহনায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাসেই বাংলাদেশের জন্ম, কাকতাল নিশ্চয়ই ইতিহাসেরও পছন্দ। টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া মাটির গন্ধমাখা শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ বছরের মুক্তি-সংগ্রামে ধারণ করলেন একটি জাতির জন্ম আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব করলেন যৌক্তিক নেতৃত্বে।

একটি শিশুর জন্ম তার মায়ের জন্য একই সঙ্গে সবচেয়ে বেদনার এবং সবচেয়ে আনন্দের। সন্তানের মুখ দেখলে মা ভুলে যান তার পেছনের ১০ মাসের কষ্টের ইতিহাস। একটি রাষ্ট্রের জন্মের পেছনেও থাকে অনেক সংগ্রাম, অনেক বেদনা, অনেক কষ্ট, অনেক রক্ত। মা যেমন সন্তানের মুখ দেখলে সব বেদনা ভুলে যান, আমরাও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আনন্দে উদ্বেলিত হই, ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যাই পেছনের নয় মাসের জন্মযন্ত্রণা।

তবে একটি রাষ্ট্রের জন্ম অনেক বড় ঘটনা। তাই এর পেছনের কষ্টের কথা, নায়কদের কথা ভোলা যায় না। তাই উপলক্ষ যত আনন্দেরই হোক; আমি কখনোই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাঁথা, ৩০ লাখ শহীদের ত্যাগ, শরণার্থী হওয়া ২ কোটি মানুষের যন্ত্রণা, নির্যাতিত ২ লাখ নারীর বেদনা ভুলি না, ভুলতে পারি না। নত মস্তকে তাদের প্রতি সম্মান জানাই। তাদের কথা মনে করে দেশকে আরও বেশি করে ভালোবাসি। আমাদের পূর্বসূরিরা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে যে দেশটি স্বাধীন করে দিয়েছে, আমরা ভালোবেসে সে দেশটিকে এগিয়ে নিতে পারবো না? সব সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমার হৃদয়ে এক ধরনের ঈর্ষা মেশানো ভালোবাসা আর অন্তহীন শ্রদ্ধা আছে। ঈর্ষা, কারণ আমরা যত যা-ই করি, আর কখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। এখন যার অবস্থান যা-ই হোক, একাত্তরে তারা জীবনের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে। সেই ত্যাগের, সেই সাহসের কোনও তুলনা নেই, কখনও হবেও না।

সন্তান যেমনই হোক, তার মুখ দেখলেই মা ভুলে যান সব বেদনা। আমরাও শুরুতে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েই খুশি ছিলাম। কিন্তু বাবা-মা সন্তান জন্ম দেওয়ার আনন্দেই দায়িত্ব শেষ করেন না। সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করেন, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। সেই সন্তান যখন সফল হয়, সবাই যখন তার প্রশংসা করে; গর্বে বাবা-মার বুক ভরে যায়। ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আজ সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরা আজ গর্বিত দেশের নাগরিক।

আমি অনেক আশাবাদী মানুষ। আমি বাংলাদেশকে অন্তর থেকে ভালোবাসি। কিন্তু চার দশক আগেও আমি ভাবিনি, বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে আসতে পারবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন করলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। ৭৫’এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ কালো অধ্যায়। সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় দেশ ছিল অন্ধকার সময়ে। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে দেখা হতো করুণার দৃষ্টিতে। অনেকেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। হেনরি কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। ৭৫’র পর যেন সেই উপহাস আর ব্যঙ্গের বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশকের পুরোটা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শিরোনাম হতো ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস আর বন্যার কারণে।

বাংলাদেশের বাজেটের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের সময় আমরা কেউ কি ভেবেছি, বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে আত্মমর্যাদার গরিমায়?

৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার পথে যাত্রা। সেই যাত্রা এখন উন্নয়নের মহাসড়কে গতিশীল। বঙ্গবন্ধু যে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে তাঁর কন্যার হাত ধরেই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। এটা কিন্তু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, আনন্দদায়ক বাস্তবতা। কারণ, এটা আওয়ামী লীগের দাবি নয়, জাতিসংঘের স্বীকৃতি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশ হয়। ধর্মকে পুঁজি করে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছিল জোড়ারাষ্ট্র পাকিস্তান। জোড়ারাষ্ট্র কারণ পাকিস্তানের দুই অংশ মানে পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল আর মানসিক দূরত্ব ছিল অলঙ্ঘণীয়। জোড়াশিশুদের যেমন অপারেশন করে আলাদা করতে হয়, জোড়ারাষ্ট্র পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়াটা তাই ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেই সময়টা প্রলম্বিত হয়েছে ২৩ বছরে। আমি ভাবলেই শিউরে উঠি বাংলাদেশ যদি একাত্তর সালে স্বাধীন না হতো, যদি পাকিস্তানের অংশ হিসেবেই থাকতো, কী হতে পারতো! বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল পশ্চিমাদের শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্যের কারণে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে বিকশিত হতো পশ্চিম পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানই আজ ব্যর্থ রাষ্ট্র, ডুবে যাওয়া জাহাজ। একসঙ্গে থাকলে এতদিনে আমরাও ডুবে যেতাম, আমাদের না খেয়ে মরতে হতো। বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ২৩ বছর পাকিস্তানের অংশ ছিল। এই ২৩ বছর ছিল শোষণ আর বঞ্চনার। পশ্চিমাদের সকল চেষ্টা ছিল বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার। কিন্তু দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জিত হয়।

পাকিস্তানিরা সব সময় বাঙালিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো, বলতো ভুখা-নাঙ্গা। একাত্তরে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের পরও পাকিস্তানের ধারণা ছিল বাংলাদেশ টিকবে না, ভারতের সঙ্গে মিশে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। বরং হয়েছে উল্টো। বাংলাদেশ ক্রমাগত এগিয়েছে। আর পাকিস্তান ক্রমাগত পিছিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল আর পাকিস্তান প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ভারতের অংশ তো হয়ইনি, বরং কোনও কোনও সূচকে বাংলাদেশ ভারত থেকেও এগিয়ে। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি ডুবন্ত জাহাজ থেকে আলাদা করে নিজেদের মতো করে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন; মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা এনেছেন। ৫০ বছর পর অর্থনৈতিক-সামাজিক সব সূচক এবং মর্যাদায় বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্দান্ত গতিতে।

২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে দেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে পাকিস্তানের উন্নয়নে ‘সুইডেন মডেল’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়। সেদিন রাতেই পাকিস্তানের ক্যাপিটাল টিভিতে এক টকশোতে সাংবাদিক জায়গাম খান ক্ষুব্ধকণ্ঠে সুইডেন নয়,পাকিস্তানকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বানিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। তার আকুতিটা এখনও আমার কানে বাজে, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’। তবে তিনি এও বলেছিলেন, তিনি নিজেও জানেন এটা অসম্ভব। ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থায় পৌঁছতে পাকিস্তানকে ৯/১০ হারে প্রবৃদ্ধি করতে হবে, যেটা আসলে অসম্ভব। আর পাকিস্তান যখন ‘হাচড়ে-পাচড়ে’ বাংলাদেশের অবস্থানে পৌঁছাবে, তখন বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে আরও ওপরে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আসলে বাংলাদেশ সারা জীবন পাকিস্তানের আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবে। যারা ২৩ বছর ধরে নির্যাতন, শোষণ আর বঞ্চনায় আমাদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল; তারা এখন বাংলাদেশের মতো হতে চায়, তবে তারাও জানে এটা এখন আর সম্ভব নয়। জায়গাম খানের সেই অসহায় আকুতি আমার মধ্যে অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি এনে দেয়।

বলা হয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তেমনই সমৃদ্ধি অর্জন যতটা কঠিন, উন্নয়নের গতি ধরে রাখা তারচেয়েও কঠিন। দেশকে ভালোবাসার কথা মুখে বললে হবে না, ভালোবাসাটা নিছক আবেগ নয়। প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি নিশ্চিত করতে মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের আকাঙ্ক্ষা, আমরা যেন বর্তমান অর্জন ধরে রেখে দ্রুতই উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারি, আমরা যেন নিজেদের সক্ষমতায়, আত্মমর্যাদায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু রেখেই চলতে পারি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু…
নতুন সরকার, নতুন আশা
সর্বশেষ খবর
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!