X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা-অসাবধানতা, মূল্য চোকাতে পারবেন তো?

রুমিন ফারহানা
২৫ মার্চ ২০২১, ১৮:০৮আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২১, ১৮:০৮
রুমিন ফারহানা
প্রতিদিন আমাকে নানা কাজে একবার হলেও বেরোতে হয়। অবাক বিস্ময়ে দেখি মানুষ হাঁটছে, রিকশায় যাচ্ছে, গাড়িতে চড়ছে, বাসে উঠছে, ভিড়ের রাস্তায় গাদাগাদি করে কোনও মতে ঠেলে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে; অধিকাংশের মুখে মাস্কের চিহ্নমাত্র নেই। যে অল্প কিছু মানুষ মাস্ক বহন করছেন তারাও সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করছে না। এ দেশের রাজধানীবাসীর স্বচ্ছ নদীর পাড়ে, পরিচ্ছন্ন সাজানো পার্কে বসে নির্মল বিনোদন লাভের সৌভাগ্য নেই। বিনোদন বা সময় কাটানো বলতে এ দেশের মানুষ বোঝে টেলিভিশন কিংবা ফেসবুক। এই দুই মাধ্যমই গত কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত কোভিডে আক্রান্ত, মৃত মানুষের তথ্য, হাসপাতালে আইসিইউ, হাইফ্লো অক্সিজেন, এমনকি সাধারণ বেড পর্যন্ত খালি না থাকার খবরে পূর্ণ হয়ে আছে। আছে নিকট আত্মীয় আর বন্ধু হারানোর হাহাকার।

গত অল্প কয়েক দিনে আমি মৃত্যুর খবরে যতবার ইন্নালিল্লাহ... পড়েছি, আমার সারা জীবনেও ততবার পড়তে হয়নি। খুব কাছের মানুষ থেকে শুরু করে কেবল মুখ চেনা, নাম জানা মানুষ পর্যন্ত আক্রান্ত এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মৃত্যুর খবরে ফেসবুক পূর্ণ। গত বছরের সঙ্গে এ বছরের খুব বড় একটা পার্থক্য হলো, এ বছর আমি বহু তরুণ, মধ্যবয়সী মানুষকে অল্প সময়ে আইসিইউতে নেওয়ার মতো অবস্থায় যেতে দেখছি, যাদের অধিকাংশই আর ফিরে আসছে না। ডয়েচে ভেলের রিপোর্ট বলছে, গত বছর যেখানে ১০ জন মানুষের মধ্যে ১ জনের আইসিইউ লাগতো এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ জনে। সুতরাং কেবল বয়স্ক বা অন্যান্য কোনও বড় অসুস্থতা আছে এমন ব্যক্তিই নন, বরং এবার ঝুঁকিতে আছেন তুলনামূলক অল্প বয়স্ক এবং সুস্থ থাকা মানুষজন।

মানুষ যদি কেবল ফেসবুক দেখে, কিংবা গণমাধ্যমের খবরটা শোনে তাহলেই খুব স্পষ্টভাবে বোঝার কথা করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। সরকার বলছে, এই মুহূর্তে করোনা শনাক্তের হার ১৪ শতাংশের বেশি। এই ১৪ শতাংশের মধ্যে একটা বড় অংশ হচ্ছে বিদেশগামী লক্ষণহীন মানুষ, যাদের করোনা নেগেটিভ আসা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়াও ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের বাধ্যতামূলক টেস্টও আছে এই সংখ্যায়।    

শনাক্তের হার উচ্চ হলেও পরীক্ষার সংখ্যা অতি অপ্রতুল। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন প্রতি ১০ লাখে ২৭ হাজার জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে; যেখানে ভারতে এই সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ৪৪ হাজার, নেপালে ৭৬ হাজার। গত বছরের মে মাসে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের পরীক্ষা হয়েছিল। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশে পাঁচ লক্ষাধিক কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগী রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পরীক্ষা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায়। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে ৪১ হাজার ৭৪৬ জনের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে শুধু আফগানিস্তানে।

ওদিকে ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের এক বছর হয়েছে। এক বছর পার হলেও ৩৬টি জেলায় নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) চালু করতে পারেনি সরকার। সরকারের পরামর্শক কমিটি নয় মাস আগে করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট চালুর সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। গত ডিসেম্বর থেকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হলেও তা একেবারেই কম। দিনে গড়ে ১০০টির মতো অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত পাওয়া করোনাভাইরাসের সেরোটাইপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। এটির সংক্রমিত করার ক্ষমতা আগেরটির চাইতে ৭০ শতাংশ বেশি। রোগীর প্রাণঘাতী জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা এটির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ বেশি। সবচাইতে বড় ব্যাপার এই ভ্যারিয়েন্ট শিশুদেরও সংক্রমিত করতে পারে। করোনা নিয়ে যাবতীয় দুশ্চিন্তার মধ্যে আমরা এতদিন অন্তত শিশু-কিশোরদের জন্য নিশ্চিন্তে ছিলাম। বর্তমানে আমাদের সেই স্বাস্তিটুকুও নষ্ট হয়েছে।

এদিকে দেশে সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটিও পাওয়া গেছে। কিছু দিন আগেই আমরা জেনেছিলাম এই ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কার্যকর নয়। এ কারণেই সাউথ আফ্রিকা এই টিকা কিনেও পরে ফেরত পাঠিয়েছে।  

বাংলাদেশে এই দুই ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস‌ই পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে দেশের মানুষ খুব বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। দেশে বর্তমানে করোনা ছড়িয়ে পড়ার অতি দ্রুতগতি, তরুণদের করোনার সিরিয়াস জটিলতায় আক্রান্ত হওয়া (যাতে অনেকেরই আইসিইউ লাগছে) প্রমাণ করে দেশে অতি সংক্রামক ইউকে ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মানুষকে জেনেশুনে এই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে সরকার।

কিছু দিন আগে এই মার্চ মাসেই আমরা জানতে পারলাম বাংলাদেশে ইউকে এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এগুলো ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসেই। অথচ এরপর সারাদেশের মানুষ যাচ্ছেতাই রকম অসতর্কভাবে চলাফেরা করেছে। গেছে নানা বিনোদন কেন্দ্রে। কক্সবাজার গিয়ে হোটেল বা অন্য কোনও আবাসিক ব্যবস্থা না পেয়ে মানুষকে সমুদ্রসৈকতে কিংবা রাস্তায় রাত কাটাতে হয়েছে– কিছু দিন আগেই এমন সংবাদ শিরোনাম আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। ২৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই মিডিয়ায় বলেন, ‘হাসপাতালে যেসব করোনা রোগী এসেছে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করে জানতে পেরেছি যে, তারা বেশিরভাগ কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিল, কেউ বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিল, কেউ কুয়াকাটা গিয়েছিল বা কেউ পিকনিকে গিয়েছিল।’ শুধু তা-ই না, এই দেশে বিয়েসহ সব সামাজিক জমায়েত ঠিক আগের মতো আছে। চলছে বইমেলাও।

ওদিকে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়নি, যা এখনও চলছে। সরকার বলেছে তারা বিলেত ফেরত লোকজনকে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং পরে বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করবে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিয়েও রয়েছে তুঘলকি কাণ্ড। করোনার ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিন কমপক্ষে ১৪ দিন করতে হলেও বিলেত ফেরতদের জন্য নানারকম কথা বলা হয়েছে। প্রথমে ১৪ দিন পরে সেটাকে সাত দিনে নামানো হয়েছে, এমনকি একবার কিছু সময়ের জন্য চারদিন কোয়ারেন্টিনের কথা বলা হয়েছে। এখন সর্বশেষ নিয়ম হচ্ছে সাতদিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের পরে বাড়ি ফিরে তারা কোয়ারেন্টিনে থাকবেন আরও সাত দিন।

এই দেশে আর সব সিস্টেমের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনকেও এক তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোয়ারেন্টিনের হোটেল থেকে বেরোনো, হোটেলে বাইরের লোক ঢোকা, হোটেল থেকে পুরোপুরি চলে যাওয়া এবং সর্বশেষ লোকসমাগম করে হোটেলে বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত হয়েছে। এই মানুষগুলো বাড়িতে গিয়ে কী করছে সে কথা বলা অপ্রয়োজনীয়।

আমরা যদি বিলেত ফেরতদের শক্তভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখার সক্ষমতা রাখতে না পারি, তাহলে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দেইনি কেন? ইউকে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হবার পরপরই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান তো যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল।

করোনার একেবারে শুরু থেকে সরকার পারেনি যথেষ্ট হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করতে; আইসিইউ তো আকাশ-কুসুম কল্পনা। চিকিৎসার পর্যাপ্ত আয়োজন করতে না পারা সরকারটি আবার দায়সারা গোছের কিছু কথার বাইরে করোনা প্রতিরোধেও তেমন কোন‌ও ব্যবস্থা নেয়‌নি। রোগ থেকে দূরে রাখার জন্য মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো দূরেই থাকুক, ন্যূনতম মাস্ক‌ও পরাতে পারেনি। আসলে শুরু থেকেই সরকার চেয়েছে সবকিছু খুলে রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরো চালু রাখা। এতে বেশ কিছু মানুষ মারা গেলে যাক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে রাখাজনিত কারণে ত্রাণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে তো অন্তত মুক্তি হবে। করোনার এই নতুন বিপদেও সরকার একই পথে হাঁটবে, এটা নিশ্চিত।

এ দেশের মানুষকে বাঁচতে হয় নিজের স্বার্থে, নিজের আয়োজনে, নিজের মতো করে; সরকার কিছুই করবে না তাদের জন্য। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজের সঙ্গে নিজেই সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে তরুণদের উচিত হবে অনেক বেশি সতর্ক থাকা। এতদিন তারা মূলত রোগটি বহন করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রবীণদের ওপরে, কিন্তু এখন নিজেদের ওপরেই আছে মৃত্যুঝুঁকি। আর এখন সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবারের ছোট্ট সদস্যটিকেও রোগটি ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা। তাই এখনও যদি সাবধান না হন তাহলে তার যে চড়া মূল্য, পারবেন তো সেটি পরিশোধ করতে? নিজের ভুলের মাশুলস্বরূপ স্বজনের লাশ কাঁধে তুলতে? 
 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ