X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইন্টারনেটের এই দশা কেন?

রেজা সেলিম
২৯ মার্চ ২০২১, ১৩:০৫আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২১, ১৫:৪৮

রেজা সেলিম মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট কী অবস্থায় আছে বা সেবার হাল হকিকত কী– এই নিয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি পরীক্ষা পরিচালনা করে। টেলিকমিউনিকেশনের ভাষায় এই পরীক্ষাকে কিউওএস ড্রাইভ টেস্ট বা Quality of Service Drive Test বলা হয়ে থাকে। মনিটরিং করার যন্ত্রপাতি দিয়ে সুসজ্জিত একটি মোটরগাড়ি চলতে চলতে প্রাপ্ত ইন্টারনেট সেবা আর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে আর তাতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শহরের উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট সেবা কাঙ্ক্ষিত বা প্রতিশ্রুত সেবার মান নিশ্চিত করতে পারছে না। বিটিআরসি'র এই ড্রাইভ টেস্ট পরিচালিত হয়েছে প্রায় ১১২১ কিলোমিটার জুড়ে আর তাতে দেখা যাচ্ছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তাতেই লাল কালি দিয়ে বিটিআরসি তাদের অসুন্তুষ্টির উল্লেখ করে দিয়েছে। বিটিআরসি রিপোর্টের নিচে প্রতিবেদনের চিহ্নিত স্থানে লাল কালি দেওয়ার অর্থ ব্যাখ্যা করেছে এই বলে যে, সেগুলো ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ বা ইংরেজিতে এর ব্যাখ্যা হলো- failing to act in accordance with a command বাংলায় যার অনুবাদ- কোনও কাজে একমত হওয়া আদেশের সাথে কাজ করতে ব্যর্থ।

আমাদের জানামতে বিটিআরসি ইতোমধ্যে দেশের ৩০০টি উপজেলায় মোবাইল সেবার ভয়েস কল ও ডাটা সেবার মান যাচাইয়ে ছয় মাসব্যাপী ড্রাইভ টেস্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছে গত জানুয়ারিতে। ২১ জানুয়ারি বাংলা ট্রিবিউন এই মর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদও ছেপেছে। সেই ড্রাইভ টেস্ট কাজের শুরুতেই যে ঢাকার টেস্ট করা হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারছি ও ২৪ মার্চ ২০২১ তারিখে বিটিআরসি ঢাকার ১১২১ কিলোমিটার ড্রাইভের যে টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ফোর-জি ইন্টারনেট সেবার মান লাল কালিতে ঢাকা পড়েছে। এই টেস্টে দেখা হয়েছে গ্রামীন ফোন, রবি, বাংলা লিংক ও টেলিটক কী সেবা কী মানে দিচ্ছে। দেখা গেল- থ্রি-জি ইন্টারনেট সেবায় ডাউনলোডের গতিসীমা সর্বনিম্ন ২ এমবিপিএস থাকার কথা কিন্তু এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে টেলিটক (১ দশমিক ৭৪) আর ফোর-জি ইন্টারনেটে কারও গতিই নির্ধারিত মান অনুযায়ী নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন গতি হওয়ার কথা ৭ এমবিপিএস, যা গ্রামীণফোনের আছে ৫ দশমিক ৭২, রবির ৫ দশমিক ৭২, বাংলালিংকের ৪ দশমিক ৯৪ ও টেলিটকের ২ দশমিক ৮২!

এই ড্রাইভ টেস্টে কল ড্রপ, কল সংযোগের মান নিয়ে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিবেচনা করা হলেও সেগুলোর মধ্যে কল সংযোগে টেলিটকের দুর্বলতা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে বাকিরা উৎরে গেছে। এটা ভালো খবর বটে কিন্তু আমাদের প্রশ্ন ইন্টারনেটের এই দশা হলো কেন? বিটিআরসি-র হিসাবমতে, দেশে এখন মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক (সাবস্ক্রাইবার) সংখ্যা মিলিয়নের হিসাবে ১০৩ (১০ কোটিরও বেশী)। এই গ্রাহকের সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা সবাই আবার নিয়মিত ব্যবহারকারী নন, যারা গত তিন মাসে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন তাঁরাই গ্রাহকের তালিকায় আছেন। সে হিসাবের সূত্র ধরে দেশে মোবাইল ফোনের নিয়মিত ইন্টারনেট ইউজার বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত সে হিসাবটা বের করে ফেলা জরুরি। যদি ক্যাটাগরি অনুযায়ী এই প্রকৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা আমরা জানতে পারি তাহলে বুঝতে পারবো এই মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট আদৌ আমাদের কোনও কাজে লাগছে কী না।

ইন্টারনেট বিজ্ঞানে প্রকৃত ব্যবহারকারীদের সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়- এক. প্রাইমারি বা খুবই সাধারণ কাজের জন্যে যারা ইন্টারনেট নিয়ে থাকেন; দুই. কনফিডেন্ট ইউজার বা আত্মবিশ্বাসী ব্যবহারকারী যিনি জানেন কী কাজে তার ইন্টারনেট দরকার ও তিন. যিনি অ্যাডভান্স লেভেলে বা অগ্রগামী পর্যায়ের কাজের জন্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দুনিয়ার কোথাও শেষের দুই পর্যায়ের জন্যে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয় না– কারণ এই দুই পর্যায়ে ইন্টারনেট গতির কার্যকর ব্যবহার করতে কম্পিউটার বা অন্য কোনও ডিভাইস নিয়ে বসতে হয়। আমাদের দেশের কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল সক্রিয় ব্যবহারকারিদের এই ইন্টারনেট কোনই কাজে আসে না কারণ তা ব্যয়বহুল ও গতির দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত। শুধুমাত্র প্রাইমারি কাজের জন্যে মোবাইলে ইন্টারনেট বাজার ছেড়ে দিয়ে আমরা যে 'হুলুস্থুল' তৈরি করেছি তা বেদনাদয়ক কারণ তা ফলদায়ক নয়। বিটিআরসি যদি সেই গবেষণাটি একবার অন্তত করে তাহলে আমরাও তা ‘সত্যি অনুমান’ কিনা বুঝতে পারতাম।

বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদ পড়ে আমরা বিটিআরসি-র কর্মকর্তাদের যে অঙ্গীকার দেখছি তা এতকালের নানা রকম অঙ্গীকারের চেয়ে অনেক আলাদা ও উৎসাহজনক- ‘বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) বিটিআরসির চেয়ার‌ম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার ড্রাইভ টেস্টের উদ্বোধনকালে আধুনিক প্রযুক্তি ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাহককে কোয়ালিটি অব সার্ভিস বা মানসম্মত সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি গ্রাহক স্বার্থের সঙ্গে কোনও ছাড় না দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন’। একই সংবাদের সূত্রে আমরা আরও তিনজন কর্মকর্তার বক্তব্য উল্লেখ করে আশাবাদী হতে পারি- ‘কমিশনের স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মো. শহীদুজ্জামান ড্রাইভ টেস্টের প্রতিবেদন জনসাধারণের অবগতির জন্য কমিশনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করার কথা জানান। কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের কমিশনার প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ড্রাইভ টেস্ট যাতে কেবল আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে গ্রাহকের স্বার্থ নিশ্চিত হয়, সেদিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি ফলোআপ অব্যাহত রাখতে হবে।’ কমিশনের স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে গ্রাহকের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে গাইডলাইন বা রেগুলেশন তৈরি হয়। তাই গ্রাহকের অভিজ্ঞতার আলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এই উদ্ধৃত আলোচনা থেকে আমরা শুধু একটি বিষয় পাচ্ছি না তা হলো গ্রাহক ও ব্যবহারকারীদের পার্থক্য ও চাহিদা নিরূপণের কাজ যা আজও হয়নি। ১৯৯৭ সালে ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর থেকে আমরা বলে এসেছি দয়া করে একে সহজলভ্য করুন ও সকলের জন্যে অবারিত করুন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী (যিনি আজকের প্রধানমন্ত্রীও) শেখ হাসিনা যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগ না নিতেন তাহলে ’৯৭ সালেও আমরা ইন্টারনেট পেতাম কীনা সন্দেহ আছে। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পরামর্শে নীরবে বাদ সাধে আমাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো কারণ তারা ‘ভ্যালু অ্যাড সার্ভিসে’র নামে ইন্টারনেট বাজার দখল করে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল সেটা ষোল কণায় পূর্ণ হয় জোট সরকারের আমলে। আর আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবসায়ী সমাজ বুঝতেই চায়নি একটু কষ্ট করে ব্রডব্যান্ড দাবি নিয়ে ধীরে ধীরে বাজারে এলে তাদের কোনই অসুবিধা হতো না। ফলে যা হবার তা-ই হলো, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দেবার দাবি জোরদার হলেও কিন্তু সেই সংযোগ এসেছে অনেক পরে। সি-মি-উই চতুর্থ সংযোগ এলো ২০০৬ সালের ২০ মে কিন্তু সবাই মিলে যথেষ্ট চেষ্টা করেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নীতিমালাটা করাতে পারলাম না। ইন্টারনেট কোথায় কার কাছে দেওয়া হবে, কত দাম হবে কিছুই করা নাই। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে একটা কিছু করার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রবেশ করেও আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ওই যে শেষের দুই ধাপের ব্যবহারকারীদের জন্যে যেই উচ্চ গতির ও মানের ইন্টারনেট দরকার তা নিশ্চিত করতে পারলাম না। এখন থ্রি-জি ছাড়িয়ে ফোর-জি ছাপিয়ে আমরা ফাইভ-জি করতে যাবো কিন্তু বিটিআরসি হিসাব দিয়েছে দেশে এই দুই ধাপের জন্যে প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা দশ মিলিয়নও নয় অর্থাৎ বেশি গতির, নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন নব্বই লাখ বায়ান্ন হাজারের মতো। এই সংখ্যার মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারকারীগণও আছেন কিন্তু তাদের সংখ্যা হিসাবের অভাবে আমাদের অজানা। সতেরো কোটি মানুষের দেশে মাত্র নব্বই লাখ ব্রডব্যান্ড গ্রাহক? শতকরা হারে পাঁচ ভাগ?

এখন তাহলে উপায় কী? করোনাকালে এই যে স্কুলে স্কুলে, বাড়ি বাড়ি আমরা ইন্টারনেট দিয়ে শিক্ষার্থীদের বই পড়াতে বাধ্য হলাম তাদের কি মোবাইলে ফোনের ইন্টারনেট-ই ভরসা? ওই ছোট্ট স্ক্রিনে জুম দেখে আর পড়া তুলে তাদের কতদিন কাটবে? ক’টা বাবা-মা এই খরচ দিতে পারছে বা পারবে? কতদিন দেবে? আর হাতে মোবাইল পেয়ে ছোট শিশুটি কী শিখছে, দেখছে বা গেমের নামে কোন সহিংস জগতের কাছে আত্মসমর্পণ করছে কে তার খবর রাখছে?

কেন আমরা এখনও সর্বত্র ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দিতে ভাবছি না? গ্রামে গ্রামে যেসব ছেলেমেয়ে পড়াশুনা শেষ করে কাজের আশায় বসে আছে সে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দিয়ে কী আয় করবে? আমরা বলছি ইউনিয়নে ইউনিয়নে ইন্টারনেট চলে গেছে। আমি বলি, দয়া করে আমাকে একটা ইউনিয়নে বা গ্রামে সংযোগ দিন –একটা ডিমান্ড নোট জোগাড় করতে সেই ইউনিয়ন-উপজেলা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে জেলা, বিভাগ হয়ে ঢাকার মগবাজার পর্যন্ত আসতে হবে কতবার, যারা সেসব কথা বলেন তাদের কাছে এই হিসাব নেই! একমাত্র ভরসা গ্রামের কাদামাখা মানুষ মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আর বিটিআরসি-র দেশপ্রেমিক দায়িত্ববান কর্মকর্তাগণ, যদি তারা একটু মুখ তুলে দেখেন আর মোবাইলওয়ালাদের কথা না শুনে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া আমাদের কথাটা একবার শুনেন তাহলে একটা উপায় হবে। ড্রাইভ টেস্টে তো তারা সে প্রমাণ তো কিছুটা হলেও পেলেন। ৩০০ উপজেলার ড্রাইভ টেস্টের ফলাফল যখন হাতে পাবেন তখন আমরা যে লজ্জা পাবো মুখ লুকাবো কোথায়? সময়ের দাবী সময়ে শুনে, সময়ের কাজ সময়ে করতে অসুবিধা কোথায়?

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প

ই-মেইলঃ [email protected]  

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ