X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উঠছে নতুন ঘর

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
৩০ মার্চ ২০২১, ১৭:১২আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২১, ১৭:১৬

রহস্যময় আগুনে জেরবার কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের একটি ব্লকে আগুন লাগার ঘটনায় ৪৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে এরপরেও কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পের এখানে সেখানে যেভাবে আগুন লেগেছে তাতে তাদের সন্দেহ এই আগুন ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়েছে কিনা। এ কারণে চলছে রাতভর পাহারা, সরকারি তদন্তও শেষ হয়নি এখনও। এমন পরিস্থিতিতেই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ঘরপোড়া কয়লা সরিয়ে আবারও রোহিঙ্গারা বাঁধার চেষ্টা করছেন নতুন ঘর। মিয়ানমার সেনাদের গণহত্যা ও বর্বরতা থেকে পালিয়ে বাঁচতেই তারা বাংলাদেশে এসেছেন, যাই ঘটুক বাঁচতে তো হবে। তাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ সরকার, ক্যাম্পগুলোতে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা। 

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাংশ আগুন লেগে এখন ধ্বংসস্তূপ।

ঘটনাস্থলে গিয়ে উখিয়ার বালুখালী ৮নং ক্যাম্পের ধ্বংসস্তূপে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা রোহিঙ্গা নারী ফরিদা বেগম (৪৫) এর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ‘আমি এখন নিঃস্ব। আগুন সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। আমার এক ছেলে শফিউল্লাহ আগুনে পুড়ে আহত। সে এখন হাসপাতালে। তাকে হাসপাতালে রেখে ক্যাম্পে এসেছি কিছু পাওয়ার আশায়। আমার ঘরের কিছু নেই। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। একবেলা রান্না করা খাবার পেয়েছি। কিন্তু, নেই থালা-বাসন, হাঁড়ি পাতিল। নেই খাওয়ার জন্য জগ-গ্লাসও।

একই ক্যাম্পের বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দুল জব্বার জানান, মিয়ানমারের দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারি নাই এখনও। এরমধ্যে আবারও মানবিক বিপর্যয় ঘটলো।

উখিয়া বালুখালী ৯নং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত আবুল কালাম জানান, ‘সবকিছু আগুনে পুড়ে একাকার। কোনও জিনিসপত্র, টাকাপয়সা নেই। আসবাব পুড়ে মাটিতে মিশে গেছে। সেসবের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে এনজিওদের কাছ থেকে পাওয়া বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে ঘর তৈরির চেষ্টা করছি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন

গত সোমবার কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ৮ ও ৯ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুন লেগে নিঃস্ব হয়ে যায় ৯ হাজার ৩শ’ পরিবারের ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা প্রাণে বেঁচে গেলেও আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় ১১ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষের। আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণ যায় তাদের। এসময় আহত হন অনেকেই।

ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে এরইমধ্যে সরকারের পাশাপাশি ‘ইউএনএইচসিআর’, ‘আইওএম’, ‘রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’, ‘ডব্লিউএফপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশি এনজিও সংস্থা নিঃস্ব এসব রোহিঙ্গাকে তাবুসহ জরুরি সহায়তা দিচ্ছে। আশ্রয় সরঞ্জামাদি, খাবার পানি, রান্না করা খাবার, মাস্ক, সাবান, কম্বল, সোলার লাইট, মশারি এবং জেরিক্যান পৌঁছে গেছে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে। পাশাপাশি ত্রিপল ও বাঁশ টানিয়ে কিছু শেডও নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে নিঃস্ব অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প আবার নতুন করে গড়ে উঠছে। তবে খাবার পানি ও সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

ছেলে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে। তারপরও খাবার আর পানির দরকারে আর ঘরের জায়গাটা যেন ঠিক থাকে সেজন্য ক্যাম্পে এসে বসে আছেন ফরিদা নামের এই রোহিঙ্গা নারী।

এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসী ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত।’ সাধারণ রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ‘আত্মঘাতী।’ তবে এসব রোহিঙ্গা এ বিষয়ে তেমন একটা মুখ খুলতে রাজি নয়। যারা এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে বলে সন্দেহ করছে তারা ক্যাম্পটিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। তাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে পারছে না। সাধারণ রোহিঙ্গাদের এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জিম্মি করে রেখেছে। গত তিন বছরে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এ পর্যন্ত ৬০ জনেরও অধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইয়াবা চোরাচালানেও জড়িত বলে ক্যাম্পের অনেকে ইশারায় জানান।

পুড়ে যাওয়া ঘর মেরামতের সময় ঘটনা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন রোহিঙ্গা আব্দুল জব্বার।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশি যুবক মুবিনুল হক (২৫) জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন কোনও দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ও আত্মঘাতী আগুন। ক্যাম্পের আধিপত্য নিয়ে একটি উগ্রবাদী রোহিঙ্গা গ্রুপ কেরোসিন ও পেট্রোল দিয়ে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিজেদের ক্যাম্পে নিজেরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী এবং আমার চোখে দেখা এটি একটি আত্মঘাতী ঘটনা।’

কারণ জানতে চাইলে মুবিনুল আরও জানান, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করায় কিছু রোহিঙ্গা অসন্তুষ্ট। এছাড়া ক্যাম্পের আধিপত্য নিয়ে গ্রুপিং রয়েছে। এসব রোহিঙ্গা চায় ক্যাম্পের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তৃত্ব না থাকুক। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প ওই গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করুক’।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান,‘ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের যাতে অন্ন ও বাসস্থান নিয়ে কোনোপ্রকার সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের আশ্রয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাবুসহ প্রয়োজনীয় আশ্রয় সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে।’

আবুল কালাম নামের এই রোহিঙ্গার দাবি, রোহিঙ্গাদেরই একটি অংশ এখানে নিজেদের স্বার্থে আগুন লাগিয়েছে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত জানান, ‘অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিকভাবে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে খোলা আকাশের নিচে না থাকে সেজন্য বাঁশ ও ত্রিপলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নগদ টাকাসহ  সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ফিরছে এবং নতুন করে ঘর তৈরি হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বরাবরের মতো সহযোগিতা দিয়ে আসছে।’

অপরদিকে, ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে থানায় নিয়মিত মামলা হওয়ার কথা থাকলেও কোন ধরনের মামলা হয়নি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনার পরেও এখনও মামলা না করা হলে বা বিলম্বে মামলা করা হলে সঙ্গত কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের চোখে সন্দেহের মধ্যে থাকে। তাই দ্রুত মামলা রুজু করা উচিত।’

রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরি করে দিচ্ছে বিডিআরসিএস ও সিসিপি’র কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘সোমবারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে হতাহত এবং সম্পদহানি বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত কেউ মামলা নিয়ে থানায় আসেনি। তাই এ ব্যাপারে কোনও নিয়মিত মামলাও রুজু করা হয়নি।’

গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ছয়টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারই আগুন ভয়াবহ রূপ পায় এবং প্রাণহানির সংখ্যাও বেশি। আগের সব ঘটনায় গ্যাস সিলিন্ডার বা রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও সোমবারের ঘটনা পরিকল্পিত বলে দাবি করছে রোহিঙ্গারা। তবে হতাশার কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাগা কোনও অগ্নিকাণ্ডেরই তদন্ত হয়নি।’

/টিএন/
সম্পর্কিত
জাতিসংঘের রোহিঙ্গা ডাটাবেজ ব্যবহার করতে চায় সরকার
ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে তিন রোহিঙ্গা শরণার্থীর লাশ উদ্ধার
ইন্দোনেশীয় উপকূলে নৌকাডুবি: ৭০ রোহিঙ্গা নিহতের আশঙ্কা
সর্বশেষ খবর
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়