গত মাসে অদ্ভুত একটা ব্যাপার নজরে আসে মারওয়া এলসেলেহদারের। সুয়েজ খালে জাপানি মালিকানার বিশাল একটি জাহাজ আড়াআড়িভাবে আটকে পড়ায় মালবাহী জাহাজ চলাচলে বিরাট অচলাবস্থা তৈরি হয়। ২৩ মার্চ ২০ হাজার কন্টেইনার ভর্তি এভার গিভেন নামের বিশাল জাহাজটির মাথা সুয়েজ খালের তীরে বালিতে আটকে যায়।
এরপর লোহিত সাগরে দুই শতাধিক জাহাজের বিশাল জট তৈরি হয়। অনেক জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। কয়েকদিনের জন্য থমকে যায় জাহাজ চলাচল। কিন্তু এলসেলেহদার তার মোবাইল ফোনে দেখতে পান, এজন্য তাকে দায়ী করে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে।
মিসরের প্রথম নারী ক্যাপ্টেন ২৯ বছরের মারওয়া বলেন, ‘আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই।’ সেই সময়ে এলসলেহডার মিসরের মেরিটাইম সেফটি কর্তৃপক্ষের আইডা ফোর নামে জাহাজে ফার্স্ট মেট হিসেবে কাজ করছেন। ঘটনার সময় জাহাজটি ছিল সুয়েজ খাল থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরে আলেকজান্দ্রিয়ায়। জাহাজটি মিসরের সমুদ্র নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন। এটি লোহিত সাগরে একটি বাতিঘরের জন্য সরবরাহ পৌঁছে দেবার কাজ করে। এছাড়া আরব লিগ পরিচালিত আরব অ্যাকাডেমি ফর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের নবীন ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের কাজেও ব্যবহৃত হয়।
এই জটিলতায় এলসেলেহদারের নাম এলো কোথা থেকে?
যে খবরটির মাধ্যমে সুয়েজ খালের অচলাবস্থার সঙ্গে মারওয়া এলসেলেহদারের জড়িত বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে সেটি একটি ভুয়া বা অসত্য সংবাদ নিবন্ধ। মূলত সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভুয়া এক সংবাদ শিরোনামের স্ক্রিনশটে ওই অচলাবস্থার জন্য এলসেলেহদারকে দায়ী করা হয়। এর সুবাদে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত।
ভুয়া যে সংবাদ শিরোনামের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে, ধারণা করা হচ্ছে সেটি আরব নিউজে প্রকাশিত কোনও প্রতিবেদন। ওই খবরে প্রকাশিত বানানো বা ডক্টরড ছবিটি নেওয়া হয়েছে আরব নিউজে ২২ মার্চ প্রকাশিত একটি আসল খবর থেকে।
সেখানে মিসরের প্রথম নারী জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে এলসেলেহদারের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। টুইটারে সেই ছবি বহুবার শেয়ার করা হয়েছে। এমনকি টুইটারে মারওয়া এলসেলেহদারের নামে থাকা অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট থেকেও ওই ভুয়া খবর ছড়ানো হয় যে, তিনি এভার গিভেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিবিসিকে এলসেলেহদার বলেছেন, তার কোনও ধারণাই নেই কে কোথা থেকে আর কেন এই ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমি এই খাতে একজন সফল নারী, সেজন্য আমাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। হয়তো আমি একজন মিশরীয় সেজন্যও হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত না কেন এমনটা হয়েছে।’
তিনি সুয়েজ খালের ওই জটিলতায় কোনওভাবে যুক্ত ছিলেন না। ঘটনার সময় তার জাহাজ ছিল সুয়েজ খাল থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরে আলেকজান্দ্রিয়ায়। তবে কাজ করতে গিয়ে এবারই প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন এমন নয়। তিনি কাজ করছেন এমন একটি সেক্টরে, যা ঐতিহাসিকভাবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের হিসাব অনুযায়ী এই মূহুর্তে বিশ্বের সমুদ্রযানগুলোতে মাত্র দুই শতাংশ নারী কাজ করছেন। মারওয়া এলসেলেহদার ২০১৫ সাল থেকে আইডা ফোর জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করছেন। নিয়োগের সময় তিনি ছিলেন সবচাইতে কম বয়সী এবং প্রথম মিসরীয় নারী ক্যাপ্টেন। এমনকি তিনি যখন আরব লীগের বিশ্ববিদ্যালয় আরব অ্যাকাডেমি ফর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টে ভর্তির আবেদন করেন, তখন সেখানে মেয়েদের পড়াশোনারও অনুমতি ছিল না। তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার পর তৎকালীন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের অনুমোদনে তিনি অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনার সুযোগ পান। ফলে যখন সুয়েজ খালে অচলাবস্থার জন্য তাকে দায়ী করা হলো তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ এটি তার কাজের ওপর প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, ‘ভুয়া খবরটি ছিল ইংরেজিতে প্রকাশিত। ফলে এটা অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমি খুব চেষ্টা করছি ওই নিবন্ধে কী আছে তা না ভাবার। কারণ এর ফলে আমার সুনামের ওপর প্রভাব পড়ছিল। আমি জানি আমার বহু চেষ্টার ফল হিসেবেই আমি আজকের জায়গায় এসেছি।’
তিনি বলছিলেন, নিবন্ধে তার সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক ও রূঢ় মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষ ও সহকর্মীদের কাছ থেকে তিনি উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যও পেয়েছেন।
মারওয়া এলসেলেহদার বলেন, ‘যত সমর্থন আর ভালোবাসা আমি পেয়েছি আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার ওপরই নজর দেব। সেজন্যই আমার সব ক্ষোভ এখন কৃতজ্ঞতায় রূপ নিয়েছে।’ সামনের মাসেই মারওয়া এলসেলেহদারের ফাইনাল পরীক্ষা, যা পাস করার পর তিনি ফুল র্যাংক ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করতে পারবেন। সূত্র: বিবিসি।