X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

একই সময়ে দুই বিদ্যালয় থেকে সরকারি টাকা উত্তোলন!

জসিম উদ্দিন মজুমদার, খাগড়াছড়ি
০৯ এপ্রিল ২০২১, ২২:০৬আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২১, ২২:০৬

খাগড়াছড়িতে এক শিক্ষক একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠানের নামে এমপিওভুক্তি দেখিয়ে দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে সরকারি টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া আরেক শিক্ষককে পাঁচ বছর আগে নিয়োগ দেখিয়ে করা হয়েছে এমপিওভুক্ত। এই অভিযোগ উঠেছে জেলার মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।

২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসে। এরপরই ওই বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্ত করা হয় সহকারী শিক্ষক সজল দে (হিসাব বিজ্ঞান) ও সহকারী শিক্ষক লিটন দাশকে (বিজ্ঞান বিভাগ)। জানা যায়, সজল দে ইতোপূর্বে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নুনছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ে সনাতন ধর্ম বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত ছিলেন। আর পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন লিটন দাশ।

নুনছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মংসাপ্রু মারমা বলেন, ‘২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর যোগদান করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৫ বছরেরও বেশি সময় আমাদের বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন সজল দে। প্রতি মাসে এই বিদ্যালয় থেকে সরকার প্রদত্ত ১৭ হাজার ৩৭৬ টাকা উত্তোলন করেছেন তিনি।’

হিসাব করলে ৫ বছরে সজল সরকারি তহবিল থেকে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৫৬০ টাকা বেতন উত্তোলন করেছেন। তবে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নুনছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা এবং নিয়মিত বেতন উত্তোলন করলেও নিজ বাড়ির পাশের স্কুল মানিকছড়ি বালিকা বিদ্যালয়ে সজল দের নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল। মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর। নিয়োগের সময় থেকে প্রতি মাসে ১৩ হাজার ৩১২ টাকা হিসাবে একসঙ্গে পেয়েছেন প্রায় চার বছরের বকেয়া বেতন। কথিত নিয়োগের পর এপ্রিল ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭২ মাসে সর্বমোট ৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬৪ টাকা উত্তোলন করেছেন।

মানিকছড়ি মুসলিমপাড়ার আবুল হোসেন, গচ্ছাবিলের আবুল কালাম আজাদসহ স্থানীয় বিভিন্ন পেশার লোকজন এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানান, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সজলকে তারা মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে দেখেছেন। সজল দে ২০১৪ সাল থেকে টানা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন খাগড়াছড়ি সদরের নুনছড়ি হাইস্কুলে। এছাড়াও সজল দের বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ, তিনি মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর পৃথক দুটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রতি মাসেই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার প্রদত্ত ভাতা উত্তোলন করতেন।

একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় মাসের সরকারি ভাতা উত্তোলন করেছেন বলে প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারও করেছেন সজল দে। তবে মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগের ব্যাপারে কোনও কথা বলতে রাজি হননি তিনি। সজল দে বলেন, ‘আমি কয়েক মাস দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি ভাতা উত্তোলন করেছিলাম। তবে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব বিজয় চক্রবর্তীর সহায়তায় ট্রেজারির মাধ্যমে বাড়তি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়ে দিয়েছি।’

অপরদিকে পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর যোগদান করে ২০২০ সালের ৩০ মে পর্যন্ত ওই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন লিটন দাশ। অথচ মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্তিতে লিটন দাশের নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল। ২০১৫ সালে নিয়োগ দেখানো হলেও ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন না তিনি।

অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক লিটন দাশ বলেন, ‘মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি আগে নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যন্ত এমপিওভুক্ত ছিল। আমি পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে মানিকছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত হয়। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক বিপ্লব বিজয় চক্রবর্তী আমাকে ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করার পরামর্শ দেন। তার সহায়তায় আমি মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করি এবং পরে এমপিওভুক্ত হই।’

মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব বিজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘বিদ্যালয়ে দীর্ঘ বছর ধরে অনুপস্থিত থাকার পরও ওই দুই শিক্ষককে এমপিওভুক্তির জন্য সহযোগিতা করাটা আমার ভুল হয়েছে। তবে আমি এর জন্য কোনও আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করিনি। কেবলমাত্র মানবিক কারণেই আমি তাদের সহযোগিতা করেছিলাম।’

মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শফিকুর রহমান ফারুক বলেন, ‘নিয়োগপত্র পযালোচনা করে দেখা গেছে ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ পরিচালনা কমিটির সভায় অভিযুক্ত এই দুই শিক্ষকের নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সময়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য আব্দুল জব্বার। অভিযুক্তদের নিয়োগের ব্যাপারে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’

মানিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান সদস্য আব্দুল জব্বার বলেন, ‘সজল দে এবং লিটন দাশকে আমার দায়িত্বকালীন সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। আর আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও আমার জানা নেই। যদি এতে কোনও অনিয়ম হয়ে থাকে তবে তার দায় প্রধান শিক্ষকের।’

খাগড়াছড়ি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম খীসা বলেন, ‘অভিযোগটি গুরুতর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষকরা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে ম্যানেজ করে এমনটা করে থাকে। নিয়োগে কোনও অনিয়ম হয়ে থাকলে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’ অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হবে এবং এর সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সুদর্শন দত্ত বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে এক প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করতেন, বেতন নিতেন। আবার আরেক বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি উত্তোলন, এটি অনিয়মের মধ্যে পড়ে। এখানে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া একই সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি ভাতা উত্তোলনও গুরুতর অপরাধ।’ বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’
বিএনপির নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’