X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা : বিষয়বিন্যাস

বিপ্লব রায়
১০ এপ্রিল ২০২১, ১১:২২আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২১, ১১:২২

ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬) এক স্বতন্ত্র স্বর। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ খ্যাত আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে দ্বন্দ্বমুখর ও বহুধাবিভক্ত। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্র-সান্নিধ্য ও ত্রিশের মধ্যচেতনার দ্বৈত টানাপড়েনে অস্থির অমিয় চক্রবর্তী বরাবরাই বদলে নিয়েছেন তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র। কবিতার ভাব ও আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ এই কবি সমকালের অন্যান্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং সাবলীল।

অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যজীবন শুরু হয়েছিল ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, সেই সময়ের বিপুল সংখ্যক কবির মতোই তাঁরও কাব্যজীবনের প্রারম্ভে ছিলো রবীন্দ্রানুসরণের সর্বগ্রাসী চর্চা। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রবৃত্তে থেকেও ক্রমশ তিনি রবীন্দ্রবলয় অতিক্রমী এক স্বতন্ত্র কাব্যধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যের নাম খসড়া (১৯৩৮)। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো : একমুঠো (১৯৩৯), মাটির দেওয়াল (১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩), দূরযানী (১৯৪৪), পারাপার (১৯৫৩), পালাবদল (১৯৫৫) প্রভৃতি।

অমিয় চক্রবর্তীর প্রথমদিকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকায় তাঁকে রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর কবিতার ভেতরে লুকায়িত ‘অধাত্মচেতনা’ কে টেনে বের করে তা রবীন্দ্রকবিতার পরিণতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাপুষ্ট অমিয় চক্রবর্তী ক্রমান্বয়ে কবিতা থেকে কবিতায় নিগূঢ় নিরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে বাংলা কবিতার এক অনিবার্য কবিরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার সাযুজ্যের একটি বড়ো কারণ হয়তো গীতিপ্রবণতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতোই অমিয় চক্রবর্তীর নানা কবিতায় রোম্যান্টিক গীতিময়তার সন্ধান মেলে। কিন্তু কবিতার দৃঢ় গাঁথুনি, ছন্দনিরীক্ষা, শব্দনির্মাণের অভিনবত্বেও দরুণ তা রাবীন্দ্রিক নয়, আধুনিক। তাছাড়াও রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যজনিত বৈষম্য, অভিজ্ঞতা স্নাত অভিনবত্ব। বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে : ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার প্রধান গুণ তার হার্দ্যগুণ। তিনি যেন সকলের আত্মার আত্মীয়।’

রবীন্দ্রনাথের উপনিষদীয় ঈশ্বর চেতনায় মুগ্ধ না হলেও প্রবাদপ্রতিম কবিপ্রতিভার সান্নিধ্যে এসে কদাচিৎ উচ্চারণ করেছেন :

‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর

পোড়ো বাড়িটার

ঐ ভাঙা দরজাটা।

মেলাবেন।’         (সংগতি)

 

রবীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তীর পার্থক্য প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য :

আসলে রবীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তীর জগৎ মূলত এক নয়, তাঁদের মনোভঙ্গি ও রচনাপদ্ধতির মধ্যে স্বভাবতই দুস্তর ব্যবধান। রবীন্দ্রনাথ যেমন উপনিষদের ঋষি অথবা কালীদাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েও তাঁদের জগতের অধিবাসী নন, অমিয় চক্রবর্তীও তেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুপ্রেরণা পেলেও রবীন্দ্রনাথের জগতের বাসিন্দা নন।

তাঁর কবিতায় আস্তিক্যবাদের নিদর্শন থাকলেও অমিয় চক্রবর্তীর ঈশ্বর রাবীন্দ্রিক ভাবাদর্শপুষ্ট নয়। ‘পারাপার’ কাব্যের ‘বৈদান্তিক’ কবিতায় উপনিষদিক ব্রহ্মরহস্যের পরিচয় মিললেও তা কোনোভাবেই কাব্যের মূলসুর হয়ে ওঠেনি। কেবল প্রকরণের স্বার্থেই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণের ব্যবহার করেছেন কবিতায়। কেননা, ঈশ্বর সম্পর্কিত আরেকটি কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন :

ঈশ্বর মুখে নিয়ে দামি সিগারেট

বসে বসে দেখছেন স্বর্গে।

নতুন জুতো-পরা পা দুটো রেলিঙে

উঠিয়ে, আরাম করে, ভালো খেয়ে দেয়ে,

মাটির পৃথিবীটাকে কৌতুকে করুণায়

ঈশ্বর দেখছেন স্বর্গ থেকে।

 

প্রচলিত ধর্মবোধের বাইরে এসে মানবতাবাদী ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস রেখেছেন অমিয় চক্রকর্তী। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় কাল্পনিক নয়, বরং মানবতাবাদী ঈশ্বরই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে :

দুঃখ সুখে শোকে ক্ষুধায় অভাবে আজ

আরো বেশি কাছে জানি সবারই জীবনে তাঁকে,

বাঁচবার অধিকারে প্রাণে প্রাণে এই তিনি

মানুষের ঈশ্বর, মানুষের ঈশ্বর।

 

তাঁর প্রেমচেতনাও সমকালীন কবিদের থেকে স্বতস্ত্র। রবীন্দ্রনাথের মানসীর মতো যেমন অলীক নয়, তেমনি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার নায়িকাদের মতোই তার নায়িকারা রক্তমাংসের, প্রবৃত্তিতাড়িত নয়। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় প্রেম কেবল হার্দিক সংঘটন নয়, বরং তার পারিপার্শ্বের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তা প্রকটিত। যেমন :

ক.

ধক্ করে লাগে বুকে—

  —তুমি—

খুঁজি চারিদিকে।

আমি

রোদ্দুরে দরজা-খোলা ঘরে।

উঠোন, আকাশ,

একেবারে

ধুয়ে মোছা শেষ।

খ.

কান্না ঝাউ বসাতে হলো

       মেঘের তলাটিতে

চীনে তুলিতে বুলিয়ে শাদা

        শূন্যে বকের ফিতে,

লুকানো সোনা ছোঁয়ানো পাখার তল,

         বেশির ঝলমল—

কাছে সে নেই বলে।

 

এই প্রেমচেতনার সাথে সম্পৃক্ত মনোজাগতিক নানা রহস্যময় অভিজ্ঞান। ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের নিরঙ্কুশ প্রয়োগ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় দুর্নিরীক্ষ নয়। মনোজগতের নানা পর্বের উন্মোচনে কবি ফ্রয়েড-ইয়ুং প্রভৃতি মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হয়েছেন। যেমন :

ডুবন্ত মনের ছবির পরে ছবি

মৃন্ময়ী বাড়ি গোলক চাঁপা গোড়া-বাধানো

হারানো

পাঠায়

আমার মেঘের কোঠায়

ওঠে জ’মে

নীল আদ্যন্ত হাওয়া

তরী নাক্ষত্রিক

চেতনা

ছোটে কোন্ এরোড্রামে।

 

রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ থেকে বস্তুচেতনা ও গতিচেতনার বোধ জন্ম নিলেও অমিয় চক্রবর্তীতে এসে তা যেন আরো সংহত রূপলাভ করেছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুবিশ্বের উল্লেখ কবিতাকে আরো ঋদ্ধ, প্রাসঙ্গিক ও বহুকৌণিক করে তোলে।

জনজীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকার প্রমাণ মেলে এসব কবিতায় :

ক.

নীল কল। লক্ষ লক্ষ চাকা। মর্চে পড়াশব্দের ভিড়ে

পুরোনো ফ্যক্টরি ঘোরে।

নিযুত মজুরি খাটে পৃথিবীকে

বালি বানায়, গ্রাস করে মাটি, ছেড়ে দেয়, দ্বীপ রাখে

খ.

দূরে গনগন কেটে চলে পাখা

           কোন অনন্যকেন্দ্র

 ঝোড়ো জেট-এ কাঁপা নীল জানলায়

ঝলকের প্লেনে পৃথিবী হারায়।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবে পর্যুদস্ত জনজীবনের হাহাকার, হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভ, দারিদ্র্য প্রভৃতি প্রকাশলাভ করেছে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায়। সমজলগ্ন এসব কবিতা হয়ে উঠেছে সমকালীন জীবনভাষ্যের বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। মধ্যবিত্তের দুঃসহ জীবনালেখ্য হয়ে উঠেছে এক একটি প্রতিস্পর্ধী কবিতা। যেমন :

ড্রেন, ধুলো, মাছি, মশা, ঘেয়ো কুত্তোর

আড়ৎ বেঁধে আছ, বাঁচো (কিমাশ্চর্য বাঁচা) এবং

যমের কৃপায় মরা,

অমৃতস্য অধম পুত্র, বন্দী স্যাঁৎসেতে গলির ঘরে ইঁদুর ভরা।

 

পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায়। বিপন্ন মানুষের আর্ত স্বরে ভরপুর এসব কবিতা রূঢ় বাস্তবতাকে প্রকটিত করে :

আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা

মাঢ়ী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,

বন্যার জল, তবু ঝরে জল,

প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল।

 

বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার ভিতরও তিনি ‘শান্তির ললিত বাণী’ প্রত্যাশা করেন। স্বার্থান্ধ মানুষের দুর্বৃতায়নে কলুষিত পৃথিবীতে যুদ্ধের দামামা থামিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ প্রতিস্থাপনের স্বপ্ন লালন করেন কবি। তাই তো যুদ্ধবিধ্বস্ত জানালায় তিনি সুখী মেয়েটির মুখ অঙ্কিত করেছেন :

বোমা-ভাঙ্গা অবসান। শহরে বিদিক্ সোজা পথে

পদাশব্দ। শূন্য পাশের গলির জগতে

চূর্ণ চূর্ণ বেলা। তারি মধ্যে ম্লান হাসিমুখ

মেয়ে জানলার কাঁচে একান্ত উৎসুক

চুল আঁচড়ায় যত্ন করে; ইটস্তূপে ছেলে শুয়ে

প্রাণ পুনর্বার চলে অগণ্য মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

 

জীবনযাপন ও মননে বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় এনেছেন এক ভিন্নতর স্বর। তাঁর কবিতায় উদ্বৃত :

‘ডানজিগের মেয়ে’ অথবা ‘জর্জিয়ার বোন’ মুহূর্তেই আমাদের বিশ্বনাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অখণ্ড বিশ্বজনীন অনুভূতিস্নাত এসব কবিতার ভূগোল সীমাবদ্ধতা মানে না, সারা পৃথিবীর ক্রন্দন ধ্বনিত হয় এসব কবিতায়।

 

ত্রিশের কবিতার প্রাণবীজ ধারণ করে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা হয়ে উঠেছে সমকালীন জীবনভাষ্যের অনন্য দলিল। কবিতার পরতে পরতে কবি রেখে গেছেন অত্যাশ্চার্য চাবিকাঠি, যার মাধ্যমে প্রবেশ করা যায় এক জাদুকরী, অতলন্ত কবিতাবিশ্বে। পঞ্চপাণ্ডবের যে দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী বাংলা কবিতায় নান্দনিক সৌধ, অমিয় চক্রবর্তীর নাম সেখানে চিরস্থায়ীভাবে খোদিত থাকবে, এ কথা অযুক্তি নয়। গবেষণাক্ষেত্র থেকে সাধারণ মানুষের চর্চা অবধি তাঁর সদর্প উপস্থিতি থাকুক, তাঁর নিরীক্ষার সূত্র ধরে বাংলা কবিতা আরো এগিয়ে যাক, আপাতত এটাই প্রত্যাশা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
বন ডাকাতদের জন্যই পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়: জিএম কাদের
বন ডাকাতদের জন্যই পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়: জিএম কাদের
ঢাবির জগন্নাথ হলে বসে প্রাথমিকের প্রশ্নের সমাধান!
ঢাবির জগন্নাথ হলে বসে প্রাথমিকের প্রশ্নের সমাধান!
চেন্নাইয়ের হয়ে খেলাটা আমার কাছে ছিল স্বপ্ন: মোস্তাফিজ (ভিডিও)
চেন্নাইয়ের হয়ে খেলাটা আমার কাছে ছিল স্বপ্ন: মোস্তাফিজ (ভিডিও)
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা