X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মজিদ মাহমুদের সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : হারুন পাশা
১৬ এপ্রিল ২০২১, ১০:২৫আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১০:২৫

মজিদ মাহমুদ কবি, জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধেও রয়েছে তার অতুলনীয় স্বকীয়তা। লিখছেন আশির দশক থেকে। তার কবিতায় পাওয়া যায় জীবন ও জগতের উৎসের সন্ধান, নারী-পুরষের প্রেম, বৃক্ষ-বিহঙ্গের পারসিনিফিকেশন, মানবমনের সব ভাবনা, কুটিলতা, জটিলতা, কল্যাণ করার আকাঙ্ক্ষা, ইউটোপিয়া, মিথ, দ্রোহ ও রাজনীতিসহ নানা বিষয়। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান। এর আগে পেশাগত জীবনে ছিলেন সাংবাদিক ও শিক্ষক। জন্মগ্রহণ করেছেন পাবনায়। জন্মদিন উপলক্ষ্যে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো। 

 

 

হারুন পাশা : মজিদ ভাই, আপনার সঙ্গে আলাপ শুরু করতে গেলে ‘মাহফুজামঙ্গল’ দিয়েই শুরু করতে হয়। এই গ্রন্থটি তো আপনার কাব্যচর্চায় বড়ো প্রাপ্তি। বড়ো ঘটনা। এটি লেখার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল তা যদি বলেন।

মজিদ মাহমুদ : বলা চলে কবিতা দিয়েই জীবন শুরু করেছিলাম। যখন থেকে চেনা-জগৎ স্মৃতিতে ধারণ করতে শুরু করেছি, কিছুটা অনুভূতি ও উপলব্ধির ব্যাখ্যা করতে শিখেছি তখন থেকেই আমার কবিতা লেখার সূচনা। অনেকটা শৈশব থেকে, এই ধরুন ৮-৯ বছর বয়স থেকে। অনেকেই মনে করেন, ‘মাহফুজামঙ্গল’ আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং বয়সেও তখন যথেষ্ট নবীন। অনেকের দৃষ্টিতে এই বয়সে এ ধরনের একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা অনেকটা আকাশ থেকে পাওয়া। প্রকৃতপক্ষে ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রকাশের আগে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি কাব্যচর্চায় বুঁদ হয়েছিলাম। ইতোমধ্যে কবিতা লেখার সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে প্রকাশ-শৈলীও কিছুটা রপ্ত হয়েছিল। সেরা কবিতা লেখার জন্য বাইশ-তেইশ বছর বয়স কম নয়।

অস্বীকার করা যাবে না, এই গ্রন্থের প্রাথমিক স্ফূরণ ঘটেছিল—এক মানবীর প্রেম থেকে। তার মায়া আমায় এতটাই ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল যে—আমার অতীত শিক্ষা, পাঠের জগৎ—সব তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমার কাছে এমন একটি সত্য এসে ধরা দিয়েছিল সেই সময়ে—যা নানা রূপে, নানা প্রতীক ও ব্যঞ্জনায় গেঁথে না তুলে আমার উপায় ছিল না। অবশ্য এই অবস্থা খুব বেশি দিন চলেনি, তারপর কিছুটা পরিকল্পনার ওপর ভর করে এগুতে হয়েছে।

কবিতাগুলো লেখার পরে বেশ দ্বিধায় ছিলাম। এ ধরনের কবিতার ব্যাপারে পাঠক খুব অভ্যস্ত ছিল না। বিশেষ করে ভাষার কিছুটা পবিত্র বোধের সঙ্গে নিজের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিকে মিলিয়ে দেওয়া। লেখার পরে কবিতাগুলো বেশ কিছুদিন ঘনিষ্ঠ কবি বন্ধুদের শুনিয়েছিলাম। তারা বিস্মিত হয়েছিল, আনন্দিত হয়েছিল। ভেবেছিল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। অনেকে খারাপ আশঙ্কা করেছিল। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। মনের জোর ছিল। তাদের কাছে যা সাংঘর্ষিক মনে করছিল, তা ছিল অপরিচয়ের সংকট। কারণ আমি এমন একটি সত্য প্রকাশে ব্রতী হয়েছিলাম—যা আমার এবং সবার।

অবশ্য প্রকাশের পরে তেমন কিছু হয়নি। সবাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। ব্যক্তিগত বিস্ময় হয়তো অনেকেই প্রকাশ করেছে—এ ধরনের একটি কাব্যগ্রন্থ যা ভবিষ্যতে এই কবির জন্য এবং সাহিত্যের জন্য কিছুটা উল্লেখ্য হবে—সেকথা অনেকেই বলেছেন। অনেক পাঠক, এমনকি কবিদেরও কেউ তখন বলেছিলেন, তাদের বিগত জীবনে এমন একটি কাব্যগ্রন্থ পড়েননি। তাদের অনেকে এখনো জীবিত, অনেকে এখনো সাক্ষী। কিন্তু বাস্তবতা হলো যেসব পত্রিকা অফিসে বইটি রিভিউ করতে পাঠানো হয়েছিল, সেইসব সাহিত্য সম্পাদকগণ তার পাতা উল্টিয়েও দেখেননি। আসলে ‘মাহফুজামঙ্গল’ সময়ের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে পরিচিতি পেয়েছে। তার কারণ আমার কোনো সংঘ বা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। এটি ধীরে ধীরে পাঠক ও পাঠক রুচির কাছে গৃহীত হয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।


হারুন পাশা : ‘মাহফুজা’ কি বাস্তবে পাওয়া কোনো চরিত্র?

মজিদ মাহমুদ : লেখকের সৃষ্ট যেসব চরিত্র চরম অবাস্তব বা অতিবাস্তব মনে হয়, তারও উৎস বাস্তবতার গর্ভে। মাহফুজাও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সূচনাতে তার নাম মাহফুজা ছিল কি আফরোজা ছিল তার আজ আর কোনো অর্থ নেই। কারণ ‘মাহফুজা’ তিরিশ বছরের প্রেক্ষাপটে আজ অনেকটা মিথ। বাস্তব এবং কল্পনার জগতের মিশেল। হয়তো এর একটি শঙ্কা ও সম্ভাবনা কবির জীবনে ঘনিভূত হয়ে উঠেছিল। মাহফুজা যদি থাকত তাহলে সেও হয়তো আজ বিশ্বাস করতে পারত না, তাকে নিয়েই এসব কথা বলা হয়েছে। অনেকটা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর মতো। চণ্ডীদাসের একজন মানসী ছিল বলেই আমরা ধরে নিয়েছি। কিন্তু তারা আজ অর্থহীন; রাধাকৃষ্ণের বাস্তবতাই মুখ্য। এখন কেউ আর কবির নিজস্ব দুঃখের কথা জানতে চায় না। কবির দুঃখ প্রেম আনন্দ হয়তো চরাচরে ব্যাপ্ত। রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্র যখন সাহিত্যে, তাদের প্রেম বিরহ যখন আমাদের কল্পনা বা অধরা জগতে আলোড়িত করে তখন তার বাস্তব উপস্থিতি আমাদের বিরক্ত করতে পারে। ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর বিস্তার রূপ-কল্পনা সবটাই কবির সৃষ্টিশীল মনের কাজ। কোনো একক মানবীর মধ্যে এ ধরনের চরিত্র বিকশিত হতে পারে না। এটি আসলে আমরা যে জগতে বাস করি তার সঙ্গে মহাকালের ইতিহাস চেতনা আর টুকরো আকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতার মিশেল দিয়ে তৈরি হয়।


হারুন পাশা : নামকরণ কেন এমন হলো? মধ্যযুগীয়? এই কাব্যটি কি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনাম যুক্ত না করে টানা লিখে যাওয়া যেত না?

মজিদ মাহমুদ : মধ্যযুগ বলে আসলে আমার কাছে আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখন থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কেন এই মধ্যযুগ? কাউকে যদি বলা হয়, আপনি তো মধ্যযুগীয়, তাহলে একটি গালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় হতে চায় না; সবাই আধুনিক হতে চায়। কিন্তু সাহিত্যে বা আমাদের ইতিহাসে আধুনিকতার ধারণাই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বাঙালি জাতিকে তার ইতিহাসচ্যুত করেছে; পূর্বপুরুষের ভোজের টেবিল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। যুগের এই রাজনৈতিক বিভাজন না হলে আমাদের সাহিত্যচিন্তা নিজস্ব ভূমি থেকে অনেকটা রস নিতে পারত। এই কাল বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে মনের উপরেও একটি ছেদ পড়েছে।

আমার মনে হয়, মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য না থাকলে হয়তো আমার এই কাব্যগ্রন্থটি অন্য রকম হতে পারত। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো শিরোনামবিহীন লেখার সুযোগ ছিল না। যদিও এতে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র আবর্তিত হয়েছে; তবু কবিতাগুলো এসেছে খণ্ডিতভাবে; বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সম্পূর্ণতা নিয়ে। একটি কবিতার সঙ্গে আরেকটি কবিতার বড়দাগের মিল নেই। এই গ্রন্থে আটাশিটি কবিতা আছে, প্রত্যেকটি কবিতা আলাদা বিষয় ও ভাব ধারণ করেছে; অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্মাণশৈলীরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া রচনার শুরুর দিকে আমি যে একটি মঙ্গলকাব্য লিখতে যাচ্ছি, তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। রচনার মাঝপথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এই চরিত্রটি মধ্যযুগের চণ্ডী, মনসা, অন্নদার মতো কবির নিজস্ব কল্পনার সৃষ্টি হতে পারে। সেই থেকে আমি এটিকে একটি আধুনিককালের কিংবা বলা চলে উত্তর-আধুনিককালের মঙ্গলকাব্যরূপে দেখতে চাইলাম। আর তখনই আমি ‘মাহফুজামঙ্গল’ নামের সনেটগুলো লেখার পরিকল্পনা নিলাম। সনেটগুলোতে খেয়াল করবেন, মঙ্গলকাব্যের বিষয় ও আঙ্গিকের একটি ইঙ্গিত এখানে অনুসরণ করা হয়েছে। যেমন, উপক্রমণিকা, কেন কবি এ ধরনের একটি কাব্য লিখতে উদ্যত হলেন, কবির বংশ পরিচয়, বারোমাস্যা এবং মূলভাব—এসবই এখানে আছে। আর সেদিক থেকে বলা চলে এটি উত্তর-ঔপনিবেশিককালের মঙ্গলকাব্য। উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যের মূল প্রবণতা—বর্তমানকে অস্বীকার না করেও, ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষের সৃষ্টি ও কৃষ্টিকে স্পর্শ করা।


হারুন পাশা : এই কাব্যে সাতটি সনেট আছে। ‘সোনালি কাবিন’ এর কবিতার বই সাজানোয় এই প্যাটার্ন আছে। মানে শিরোনামযুক্ত কবিতা। আবার কিছু সনেট। আবার ‘পরানের গহীন ভিতর’ও সনেটে লেখা। বাকি দুটি বই ও আপনার সনেট কীভাবে আলাদা বিষয়, তাৎপর্য ও গঠনে?

মজিদ মাহমুদ : এই সনেটগুলোর কিছু প্রকাশ আমি আপনার পূর্বের প্রশ্নের মধ্যেই দিয়েছি। আসলে আমার এই সনেটগুলোই মূলত তার মঙ্গলকাব্য হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। কারণ এই কবিতাগুলোকে আমি সাজিয়েছি বৃহদায়তনের মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকের অনুরূপ। এটি মূলত মঙ্গলকাব্যের বিবর্তনের ইনডেক্স হিসেবে কাজ করেছে। মাহফুজা এখানে দেবী প্রতীকে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মোটেও কল্পিত নয়—যা আধুনিক মানুষের যুক্তিশীলতা ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে আঘাত করে।

এখানে আমার একটি অজ্ঞতার কথা বলি—‘মাহফুজামঙ্গল’ রচনার কাল পর্যন্ত আমি অনেকটা মফস্বলবাসী ছিলাম; পদ্ধতিগত পড়াশোনার সুযোগ খুব কম ছিল। বাংলা কবিতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ও ব্যাপক পরিচয় থাকলেও আল মাহমুদ বা সৈয়দ হকের কবিতার সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না। তবে যতদূর মনে হয়, আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ তখন পড়েছিলাম; কিন্তু ‘পরানের গহীন ভেতর’ তখনো পড়া হয়নি। ফলে তারা আমার এই কাব্যের সনেট পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—তা হয়তো ঠিক নয়। আল মাহমুদের সনেটগুলো পরিকল্পিত হলেও আমি যে একটি সীমিত চিন্তার অনুগামী ও নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশের জন্য এগুলোকে ব্যবহার করেছি, তার কারণ মঙ্গলকাব্যের ব্যাপকতা একটি সীমিত পরিসরে ধরার জন্য।

সনেটের আঙ্গিক তো প্রায় সবারই এক। মাইকেল-উত্তর উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল কবিই কিছু সনেট লিখেছেন। বিষয় এবং শব্দ প্রয়োগের অনিবার্যতাই তাকে আলাদা করেছে। উল্লিখিত দুটি গ্রন্থের সার্থক সনেটের পাশাপাশি আমার প্রচেষ্টা একান্ত আমার মতো করে আমার দেবী বন্দনায় সীমিত—যার সঙ্গে আর কারো কোনো সম্পর্ক নেই, অন্তত বিষয়শৈলীতে।


হারুন পাশা : আপনার কবিতায় দুই ধরনের মিথ পাওয়া যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। মুসলিম মিথও এসেছে। মিথের ব্যবহার নিয়েও জানতে চাচ্ছি।

মজিদ মাহমুদ : কবিতা লিখবার সময় মিথ আলাদাভাবে আমার মাথায় থাকে না। এমনকি আমি অনেকদিন ভুলে থাকি—আমার কবিতায় কি ধরনের মিথ ব্যবহার হয়েছে। আসলে মিথ আমার কবিতায় এসেছে জনজীবনের ভাষা হিসেবে। মিথ হলো মানবজাতির পরীক্ষিত ভাষা—দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট জনপদ কিংবা সেই জনপদ থেকে অন্য জনপদে অভিবাসিত শব্দ এবং কাহিনিরাজি—যার সঙ্গে মানুষের একটি ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। যখন সে এমন বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হয়ছে কিংবা নিজের বা অন্য কারো সৃষ্ট পরিস্থিতি বর্ণনার জন্য একটি তুল্য অবস্থার আশ্রয় নিয়েছে তখনই তা মিথের মর্যাদা পেয়েছে।

একইসঙ্গে আমরা অনেক ধরনের মিথের উত্তরাধিকার লাভ করি। যে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বসবাস করি তার একটি নিজস্ব যাপনের ভাষা আছে, তা যে কেবল প্রার্থনা কিংবা উপাচারের সঙ্গে যুক্ত তা নয়, তার একটি প্রায়োগিক তীব্রতা আছে, এমনকি পবিত্রতা ও অশুদ্ধতাও আছে, যা সহজেই ওই জনগোষ্ঠীর সকল মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়। সেই ব্যাবহারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমার কবিতাতে মিথের আগমন। বাংলা ভাষার উত্তরাধিক বেশ ব্যাপক ও গভীর—একইসঙ্গে ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণে এখানে হিন্দু বৌদ্ধ ও ইসলামি মিথ বা পারিভাষিক শব্দরাজির ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়াও ব্যুৎপত্তিগত কারণে সংস্কৃত এবং ভারতের অন্যান্য ভাষার মিথও এখানে সমানভাবে প্রবেশ করেছে। এশিয়াতে বাংলা তথা ভারতবর্ষ এমন একটা দেশ যেখানে সমগ্র প্রাচ্য বা ওরিয়েন্টাল মিথের আত্তীকরণ হয়েছে।

পাশাপাশি পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় মিথ আমার কাছে এসেছে পঠনের পথ ধরে। মিথের একটি বড় গুণ তার জার্নি। যেমন, সেমেট্রিক অনেক মিথ ইউরোপীয় মিথের অংশ হয়ে গেছে। আর সব মিথই আমার ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে কাজে লেগেছে। কবিতা যেহেতু স্বল্প পরিসরে লিখতে হয়, সেখানে মিথ দারুণভাবে অর্থ সম্প্রসারণে ক্রিয়া করে। তবে মিথ সংকটও তৈরি করতে পারে, মিথের তীব্রতা কিংবা অপরিচিত মিথ পাঠককে কবিতাপাঠের আনন্দ থেকে বিরত করে। ফলে মিথের ব্যবহার যথাযথ না হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। আমার কবিতার ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে মনে হয়। অবশ্য একেবারে হয়নি তাও বলা যাবে না, কারণ ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর দুই একটা ইসলামি শব্দ আমাদের কোলকাতার কবিবন্ধুরা নিতে পারেননি। কারণ তারা রুকু, সেজদা, জায়নামাজের মতো অতি পরিচিত মুসলমানি শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন। আর এটি এই জনপদে বসবাসকারী দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বড় সংকট; তারা পানি ও জলের উপরে নিজেদের কমই ওঠাতে পেরেছেন।


হারুন পাশা : আপনার কবিতা নিয়েও আলোচনা হয়। ব্যক্তি আপনাকে নিয়েও। এনজয় করেন?

মজিদ মাহমুদ : কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়, আর আমায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুটোই হয়। আসলে লেখকের ভাগ্য অবিমিশ্র নয় যে, আপনি শুধু প্রশংসাই শুনবেন। লেখা আর লেখকের জীবন যখন কিছুটা পাঠকের হয়ে উঠতে চায়, তখন আত্তীকরণের একটি সংঘাত তৈরি হয়; আমার ক্ষেত্রেও সেই সংঘাত আছে। প্রকৃতপক্ষে লেখা যদি লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সামর্থ্য অর্জন করে তখন কেবল প্রশংসাই নয়; সমালোচনাও প্রচারে দারুণ কাজে লাগে। নিঃসন্দেহে এসব উপভোগ্য। তবে সমালোচনায় যে কাতর হই না, তা নয়। কারণ আমার কাছে মনে হয়, অহেতুক একটু ভুলবোঝাবুঝির ঢেউ কোথা থেকে এসে কিছুটা লন্ডভন্ড করে দেয়। তখন ভাবি, তুমি তো এমন কিছু করছ যা গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে না গেলে মানুষ কিভাবে বুঝবে এটি খাঁটি। তবে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনা আমায় আরো সতর্ক ও সৃষ্টিশীল করে তোলে। আমায় নিয়ে আলাপ আলোচনায় আনন্দিত হই বটে, তবে খুবই সাময়িক; অতৃপ্তি আর অপ্রশংসা আমায় লেখক হিসেবে আরো তীব্রতর করে।


হারুন পাশা : আপনার কাব্যভাষা সহজ। কবিতা বা কথাসাহিত্যে সহজ ভাষার ব্যবহার আমার পছন্দ। আমি নিজেও গল্প-উপন্যাসে সেভাবে লিখতে চাই। আপনার কবিতায় সহজের সাথে জটিল ভাবও উঠে এসেছে। আমরা সুকান্ত ভট্টাচার্য বা শঙ্খ ঘোষ, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজেও তাই পাই। আপনার ও সিনিয়রদের কাব্যভাষার সহজতা ও তাৎপর্য কেমন?

মজিদ মাহমুদ : ব্যাপারটা কি, সাহিত্যে কঠিন ভাষা বা সহজ ভাষার আলাদা কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যেমন, লালন ফকির সহজে বলেছেন, বিশেষ করে মরমি কবিগণ; কিন্তু তাদের ভাবের বিস্তার এতটাই বেশি—যা ভোক্তার নিজস্ব ব্যাখ্যা এবং ভাবনার উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কবিতা বলুন আর সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যম বলুন সবটাই লেখক পাঠকের যৌথ সম্পর্কের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ, কবি শুধু যা বলেন পাঠক যে কেবল তার সঙ্গে থাকেন তা নয়, একটি কবিতার অভিঘাত পাঠককে তার নিজস্ব জগত নির্মাণে কতটা সহযোগিতা করছে সেটিই বড় কথা। যেটাকে আমরা বলি সর্বজনীনতা অর্থাৎ কিসের উপরে ভর করে একটা লেখা মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে; যেমন সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার সুর, চিত্রকলার ক্ষেত্রে তার রঙের ব্যবহার, এমনকি কবিতার ক্ষেত্রে তার যথাযথ শব্দ—যেটি ঠিক পাঠকের হৃদয়ে শব্দের অতীত অর্থের তাৎপর্য তৈরিতে সক্ষম হয়।

আমার পূর্ববর্তী যেসকল কবির কথা উল্লেখ করেছেন, তারা আমার নমস্য; তবে আমার কবিতার বিষয় বা শৈলী মোটেও তাদের মতো নয়। অবশ্য উল্লেখ্য কবিগণ কেউ কারো মতো নন; তবে ধরনের দিক থেকে সুকান্ত তার বিষয় গৌরবে অনন্য; শঙ্খ ঘোষ শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আপাত সরল হলেও ভাবে ততটা সরল নন; হেলাল হাফিজের কাব্যিক কর্মকাণ্ড তার একটি মাত্র গ্রন্থের মধ্যে সীমায়িত—যাকে বহুমাত্রায় তুলে ধরার সুযোগ তিনি দেননি। আবুল হাসান স্বল্পায়ু হলেও ষাট দশকে নতুন কবিতা রচনায় যথেষ্ট দক্ষতা ও হৃদয়গ্রাহিতার পরিচয় দিয়েছেন।

ব্যক্তিজীবনেও আমার গুরুপাক খাবার সহ্য হয় না, সহজ প্রাপ্য ও সহজপাচ্যের প্রতি দৃষ্টি থাকে। কবিতা লেখাও রান্নাশিল্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়, আপনার হাতের কাছে যে শব্দরাজি ও ভাষাভঙ্গি আছে—তার সঙ্গে যদি আপনার চিন্তার যুক্ততা তৈরি করা যায়, তাহলে সেটি বেশি উপাদেয়। শব্দ বা বাক্য একটি আধারের বেশি নয়, চিন্তা ও প্রয়োগের নতুনত্বই মুখ্য।


হারুন পাশা : ভাষা প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলি। আশির পরে নব্বইয়ে কাব্যভাষা একটু জটিল হলো। শূন্যে তা পুরোপুরি। বর্তমানেও তাই। এই ব্যাপারে আপনার বিবেচনা জানতে চাই। কেন এটা হয় বা হচ্ছে?

মজিদ মাহমুদ : কবিতার ভাষার জটিলতা নিয়ে অভিযোগ বেশ পুরোনো। রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে / সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ বুদ্ধদেব বসু পাঠকের উপর কিছুটা দোষ চাপিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পাঠকের স্থবিরতাও কবিতার জটিলতার জন্য দায়ী। আসলে দশকে দশকে কবিতা খুব বেশি কিছু পাল্টে যায়—এমন নয়; আমরা খুব কাছ থেকে দেখি বলে তেমনটি মনে হয়। আবার একই দশকে উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে দেখবেন, তাদের কবিতার ভাষা-শৈলী আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আশির দশকের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়েছে। যেমন, আশির দশকের কবিদের মধ্যে ভেরিয়েশন বেশি। একজন থেকে আরেকজনের পার্থক্য অনেক। লক্ষ করবেন, এই দশকের কবিদের বয়স, রুচি ও পেশাতেও ব্যাপক পার্থক্য। এমনও হয়েছে ষাটের দশকের কবিদের কেউ কেউ আশির দশকে ঢুকে পড়েছে। আমার ক্ষেত্রে পরিবেশটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি আশির শেষপাদে ঢাকায় এসে অনুভব করলাম, আগেই আশির দশক পূর্ণ করে কবিরা বসে আছেন; পত্রিকা করছেন, নিজেদের নাম বিধৃত করছেন। এমনকি ছদ্মনামে নিজেদের কীর্তন করছেন। আমি শুধু ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর কারণে আর অব্যাহত লেগে থাকার জোরে এই দশকে জায়গা করে নিয়েছি।

নব্বই হলো সবচেয়ে হোমোজিনিয়াস গ্রুপ। অধিকাংশ কবির বয়স এবং রুচি বেশ কাছাকাছি। এমনকি তাদের মধ্যে সম্পর্ক, পারস্পরিক বোঝাপড়া; এমনকি গ্রহণ ও খারিজ করবার প্রবণতাও সবচেয়ে বেশি ছিল। একটা সময় এই দশকের কবিরা কেবল এই দশকের কবিদের কথাই বলেছে; অন্য দশকের কবিরা তাদের কাছে খুব কমই পাত্তা পেয়েছে; একান্ত প্রয়োজন ছাড়া। এ দশকের বেশ কিছু প্রতিভাবান কবি আছেন; তবে দলবদ্ধতার কারণে তাদের প্রাতিস্বিকতা ততটা স্বীকৃত নয়।

কবিতার জটিলতার আমদানির জন্য অনেক ক্ষেত্রে বোধের অস্পষ্টতাও কাজ করে। একজন মানুষের কাছে জীবন জগতের অভিজ্ঞতা যত ব্যাপক হবে তার প্রকাশভঙ্গি তত সহজ হবে বলে মনে করা যায়। তরুণদের কবিতার ক্ষেত্রে সর্বদা একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ লক্ষ করা যায়—এটা দোষের নয়। জীবনের অনেক অস্পষ্টতা, অ্যাম্বিগুইটি, রহস্যময়তার প্রকাশ আপাত জটিল মনে হলেও কবিতার জন্য তা খারাপ নাও হতে পারে। আর কবিতা তো অনেক রকম। তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত কবিদের কবিতা দেখেন, কিভাবে তারা আলাদা—এমনকি এ সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো আরো কবি যারা এই আইডেন্টিফিকেশনের বাইরে—তারাও আলাদা। তাদের অনেকে এখন আর নিত্য পাঠ্য তালিকায় নেই, আবার অনেকের ক্ষেত্রে মনে হয়—এই তো চির নিত্য।


হারুন পাশা : জটিল শব্দ আর বাক্য কতটা পাঠককে যুক্ত রাখতে সক্ষম? শিল্পগুণ কতটা রক্ষিত?

মজিদ মাহমুদ : জটিলতার মধ্যে পাঠক কেন ঢুকতে যাবে। পাঠকের কাছে যদি জটিলই মনে হয়, তাহলে তো সহজে সেই সাহিত্যের কাছে যাবে না। তবে যদি নারকেল বা তালশ্বাসের খ্যাতি তৈরি হয়, তাহলে অনেক পাঠক পরিশ্রমের পথে আসবে। জটিলতা প্রধানত দুই ধরনের—একটি হলো ভাষার, আরেকটি বোধের—এই দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, মেঘনাদবধের শব্দ প্রয়োগ বেশ সংস্কৃতঘেঁষা—যা প্রাত্যহিক পাঠকের কাছে অপরিচিত, কিন্তু শব্দের অর্থ আয়ত্ত করলে ভাব ও বিষয় বেশ সরল। পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশের ভাষার জটিলতা না থাকলেও পাঠক অর্থের দ্ব্যর্থবোধকতার সম্মুখীন হন।

আসলে কবিতার কাছে পৌঁছানোও পাঠকের জন্য কবির মতো নিরন্তর প্রচেষ্টা। চর্চা, অভ্যাস, শ্রেণি ও শিক্ষা—সবটারই প্রয়োজন হয়। কবি ও পাঠকের ভাষা রুচি একই মাত্রার না হলে সেই কবিতা পাঠকের মনোজগতে নাড়া দিতে সক্ষম হয় না। কবির মতো পাঠকেরও একটি স্পর্শকাতর মনের দরকার হয়; যেখানে পাঠক বলে উঠবেন, ‘যেই নহে এই সেই।’


হারুন পাশা : এবার দর্শনবিষয়ক দুটি প্রশ্ন। একটি হলো আপনার জীবনদর্শন। আরেকটি কাব্যদর্শন। দুই দর্শন নিয়ে সংক্ষেপে বলবেন?

মজিদ মাহমুদ : মানুষ আগে দার্শনিক পরে কবি। দর্শনের উপলব্ধি ছাড়া প্রকৃত কবিতা সৃজন সম্ভব হয় না। কাব্য-দর্শন মূলত জীবন দর্শনের অনুরূপ। আমি যখন লিখি তখন আমি অনেক কিছুর কাছে ঋণী থাকি। ধরুন, বাংলা ভাষা—যা আমি বা আমার সময়ের মানুষেরা তৈরি করেনি। আবার আমার সময়ের মানুষ ছাড়া এই ভাষার কোনো অর্থ নেই। তাহলে ভাষার মাধ্যমে একজন কবি যুক্ত থাকে তার জাতিসত্তার সঙ্গে। তার অতীতের সকল মানুষ তার মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে অতীত মানুষের কালচালিত অভিজ্ঞতা এবং পুস্তকে লিপিবদ্ধ জ্ঞানের একটি মিশেল ক্রিয়া করে। সেইসঙ্গে আমার চারপাশের জগৎ পরিবেশ, বৃক্ষ, নদী, সমুদ্র, বৃহঙ্গ—এক অসীম বিস্ময়ে ধরা দেয়। নিজের ভাষা সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক মানবসম্প্রদায়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, টিকে থাকার লড়াই—সবটাই আমার কবিতার অংশ হয়ে যায়। আমি আসলে বিশেষ কোনো চেতনার দ্বারা অধিকৃত নই। লক্ষ করে থাকবেন, আমার অসংখ্য কবিতাতে জনপ্রিয় অনেক দার্শনিক মতামতকে প্রশ্ন করা হয়েছে, স্যাটার করা হয়েছে, উইট আছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেই। কারণ পৃথিবীতে শেষ বলে কিছু নেই, ধ্রুব বলেও কিছু নেই। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, প্রাণজগতের অংশ হিসেবে তাকে বেঁচে থাকতে হয়, সেই সহমর্মিতা—পারসোনিফিকেশনের দ্বারা অন্যের জন্য জীবনকে সহজ করে দেওয়ার চেতনা আমার দর্শনের অন্যতম উদ্দেশ্য।


হারুন পাশা : ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ নামকরণের গল্পটা কেমন?

মজিদ মাহমুদ : ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ আসলে তথাকথিত আধুনিক ধারার কবিতা নয়। এই কবিতার প্রেরণাতে কাজ করেছে মধ্যযুগের পারস্য কবিদের চেতনা। বিশেষ করে পারস্যের মহান সাধক কবি হাফিজ এই কবিতার মৌল প্রেরণা। কবিতাগুলোর অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে চিরাচরিত সাকি, সুরা, গোলাপ, প্রেম ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব—এগুলো সবই প্রতীকি। এই গ্রন্থ রচনাকালে আমি এক পরমার্থিক আনন্দময় রোম্যান্টিক চেতনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কবিতা রচনা এবং তার জন্য নিজস্ব অনুষঙ্গের মধ্যে বসবাস আমাকে এক স্বর্গীয় অনুভূতির মধ্যে নিয়ে এসেছিল। পৌঢ় প্রেম আর সমকালীন কবিদের ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ক্ষুণ্ণিবৃত্তি এই কাব্য লেখার সূচনা ছিল। বোরহেস যেমন খৈয়ামের ইংরেজি অনুবাদ ফিটজেরাল্ড সম্বন্ধে বলেছেন, হঠাৎ একদিন একটা লোক লন্ডনের রাস্তায় খৈয়াম হয়ে গেল; খৈয়াম তার উপরে ভর করল, আর তার ভাষার ও সময়ের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি খৈয়ামে পরিণত হলেন। ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ লেখার সময় আমার দশাও তেমনি হয়েছিল; মনে হচ্ছিল, আমি যেন হাফিজে পরিণত হয়েছি। অবশ্য এর আগে নানা অনুবাদে হাফিজ পড়া, বিশেষ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাফিজের কবিতা ভেতরে একটি পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল। ফলে গ্রন্থটির নাম ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।


হারুন পাশা : কবিতায় সমাজ-জীবন থাকে। রাজনীতি থাকে। সমাজের নানাচিত্রের উপস্থাপন কবিতার ভারত্ব বাড়িয়ে দেয়। সমাজ ও রাজনীতির উপস্থাপনটা কেমন আপনার কবিতায়?

মজিদ মাহমুদ : মানুষ মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রাণী। রাজনীতি মানুষকে যতটা আঘাত ও আনন্দ দেয়—আর কোনো কিছুই ততটা দিতে পারে না। কারণ রাজনীতি হলো তার বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। অর্থাৎ, একজন মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবেন—স্বাধীনভাবে না দাস হয়ে; রাজনীতি নির্ধারণ করে দেয়—একটা সমাজে তার মর্যাদার মাপকাঠি। রাজনীতি তাই বাঁচার কৌশলের সঙ্গে যুক্ত।

সুতরাং, একজন কবির জন্য রাজনীতি অপরিহার্য উপাদান। যাদের কবিতাতে দৃশ্যত রাজনীতি নাই বলে মনে হয়, তারা হয় রাজনীতির শিকার কিংবা প্রচল রাজনীতির প্রোডাক্ট। আবার যাদের কবিতায় একটি নির্দিষ্ট দলীয় রাজনীতি, সংঘ বা ধর্মের প্রতি অব্যাহত আস্থা লক্ষ করা যায়, তারা মূলত আংশিক মানবসত্তার প্রতি আস্থাশীল ও নিজস্ব লাভালাভের ওপর নির্ভর। কবির রাজনীতি হওয়া উচিত সর্বদা অসঙ্গতি, বৈষম্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্বল ও সংখ্যালঘুদের পক্ষে। যে কবির হৃদয় দুর্বলের প্রতি আঘাতে কষ্ট পায় না, কেবল দুর্বলের দোষ খুঁজে বের করে, সে হৃদয় কবির না হওয়াই ভালো।

আমার কবিতাতে রাজনীতি এসেছে—সর্বদা প্রতিপক্ষ হিসেবে; ইংরেজ কবি পি. বি. শেলি যেভাবে বলেছেন—কবি হলেন ‘আনএকনলেজড লেজিসলেটস অফ দ্য ওয়াল্ড’। আমার কবিতার মূল প্রবণতা জীবন জগতের উৎসের অনুসন্ধান, নারী-পুরুষের প্রেম, বৃক্ষ বিহঙ্গের পারসনিফিকেশন, মানবমনের রোম্যান্টিক চেতনা, ইউটোপিয়া এবং দ্রোহ ও রাজনীতি সমানভাবে এসেছে।


হারুন পাশা : প্রেমও কম যায় না...

মজিদ মাহমুদ : প্রেম মানবজীবনের প্রধান প্রধাবনা। অধিকাংশ প্রেমের কবি বিদ্রোহী প্রকৃতির হয়। অর্থাৎ, প্রেমে ও সৌন্দর্য চেতনায় বাঁধাগ্রস্ত হলে তিনি দ্রোহী হয়ে ওঠেন। এটি এক ধরনের রোম্যান্টিক চেতনাও বটে। আমার কবিতায় প্রেম একটি প্রধান অনুষঙ্গ। তবে আমার কবিতায় নারী-পুরুষের প্রেমের একরৈখিকতা কম। কেবলই নারী প্রেম দুষ্কর। যেখানেই নারীর প্রতি আমার প্রেম আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে, তখনি সে রক্ত মাংসের মানবীর অধিক চেতনা ধারণ করেছে। ‘মাহফুজামঙ্গলে’ও লক্ষ করবেন, এর খুব কম কবিতা পাওয়া যাবে, যেখানে চৈতী হাওয়া, কিংবা ঝুলনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রায় নেই। অথচ, কবিতাগুলোর অবয়ব আবার ধারণ করে আছে প্রেম। সেদিক থেকে প্রেমকে আমার কবিতা থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়।


হারুন পাশা : আপনার সমসাময়িক কবিদের থেকে আপনার কবিতা কীভাবে আলাদা? নিরীক্ষাটা কেমন?

মজিদ মাহমুদ : আমার কবিতা সমসাময়িককালে তুলনায় একদা প্রচণ্ডপ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিষয় এবং আঙ্গিক কারো সঙ্গেই মিলবে না। তার কারণ আমি যা নিয়ে যেভাবে কবিতা লিখতে শুরু করেছি, সেটা ঠিক রাজধানী ও দশককেন্দ্রিক কাব্যচেতনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ধরুন, আজ সহজ মনে হলেও তিন চার দশক আগে একজন কবির কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘মাহফুজামঙ্গল’, ‘বল উপাখ্যান’, ‘আপেলকাহিনি’, ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ কিংবা ‘সিংহ গর্দভের কবিতা’। বিশেষ করে এইসব গ্রন্থ নামে প্রমাণ হয় না—এসব কবিতার বই। নামে মনে হয় উপাখ্যানধর্মী রচনা। অথচ, সেসময়ে আশির দশকে প্রবলভাবে কবিতা করে তোলার একটা প্রবণতা চলছিল। যেমন, সেসময়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’, ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’, ‘ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল’। অর্থাৎ, নাম থেকে পার্থক্যের সূচনা হয়েছিল আমার, সুতরাং, এই সব খাঁটি কবিতার সঙ্গে আমার মিশ খাচ্ছিল না। অবশ্য এসবই আমার সচেতন প্রয়াসের বাইরে ছিল; মনোগঠনের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কোনো বইয়ের নাম নির্বাচন কখনো আমার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না; বিষয়ের কারণে নাম অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক একইভাবে যেসব বিষয় আমি কবিতা করে তুলেছি, তার অনেকখানিই তৎকালে কবিতার পদবাচ্য ছিল না। এখন তার কিছু কিছু সেসব অনুসরণ করা হলেও অধিকাংশ এখনো আনকোরা রয়েছে।


হারুন পাশা : কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লেখার শুরু কীভাবে? আপনি কি কবিই হতে চেয়েছিলেন?

মজিদ মাহমুদ : হ্যাঁ, জ্ঞানত কবিই হতে চেয়েছিলাম। যেহেতু খুব শৈশব থেকেই এই কর্মটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম আনন্দে আর নিজেকে প্রকাশের লক্ষ্যে, সেহেতু আর কিছু হওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। যা হয়েছি কিংবা যা হতে চেয়েছি তা কেবলই লেখক হওয়ার প্রয়োজনে। তবে কবি হতে চাইলেও আমার কাছে লেখার সামগ্রিক বিষয় ও শৈলী প্রায় একইভাবে ধরা দিয়েছে। আসলে আমি লেখক বলতে শৈশবে যাদের জানতাম কিংবা যাদের মতো হতে চাইতাম তাদের অধিকাংশ, একইসঙ্গে কবিতার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ সমানভাবে রচনা করেছেন। আর তাদের দেখাদেখি আমিও প্রলুব্ধ হয়েছি। তাছাড়া একজন লেখকের কাজ নিজেকে এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কিছু নিজের চিন্তন ও কল্পনার সঙ্গে নির্মাণ করা। কবিতা কবির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও উপন্যাসে যা প্রকাশ করা সম্ভব তা কবিতাতে সম্ভব নয়। আমার গল্প গ্রন্থ হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়নি; হয়েছিল ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ নামে একটি গল্পের বই ১৯৮৬ সালে। যদিও দ্বিতীয় গল্পের বই বেরিয়েছে প্রথমটি প্রকাশের বত্রিশ বছর পরে, ২০১৮ সালের বইমেলায়। গল্প-উপন্যাস যতই কম লেখা হোক, আমি সর্বদা এই দুটি শাখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকতে চেয়েছি। সম্প্রতি ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ নামে আমার একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছে—ভোরের কাগজ প্রকাশন। প্রায় বাইশ বছর ধরে উপন্যাসটি লিখেছি—যেটি নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। আর প্রবন্ধসাহিত্য তো আমি কবিতার পাশাপাশি সমানভাবে রচনা করেছি। কারণ এই দুটি ক্ষেত্রে আমার বলা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।


হারুন পাশা : আপনার কবিতায় টুইস্ট আছে। এখন অনেকেই এ রকম করে লিখছে। এটাকেই তারা প্যাটার্ন বানিয়ে ফেলেছে। আপনার কবিতার টুইস্ট আর বর্তমান প্যাটার্ন নিয়ে জানতে চাচ্ছি।

মজিদ মাহমুদ : কবিতাতে আমি আসলে সময়কে ধরতে চেয়েছি; যেসব ঘটনারাজির মধ্যদিয়ে সময় হারিয়ে যাচ্ছে—কবির কাজ তার ইতিহাস রচনা করা। মানুষ না লিখলে সময়ের আর কি মূল্য থাকত! সময় তো একই রকম, ঘটনাই তাকে আলাদা করে দেয়। আমার কবিতার ক্ষেত্রেও তাই, একই বিষয় দ্বিতীয়বার ফিরে খুব কমই এসেছে। ফলে বহু রকম কবিতা আমি রচনা করেছি। সমাজ, ধর্মে, রাজনীতি কিংবা মানবচরিত্রে এমন সব বিষয় আছে, যা সরসরি ধরা যায় না। কিংবা ধরার অন্য কোনো হ্যাপা আছে, সেসব ক্ষেত্রে অ্যাম্বিগুইটি, শ্লেষ, প্যারাডক্স কিংবা স্যাটায়ার-উইটের আশ্রয় নিতে হয়। আপনি আমার প্রায় দেড়-দুই দশক আগে প্রকাশিত ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’ কিংবা ‘অনুবিশ্বের কবিতামালা’ গ্রন্থে লক্ষ করে থাকবেন, পুরো কবিতা খুবই সংক্ষিপ্ত অবয়বে সমাজ রাজনীতির নানা অসঙ্গতিগুলো প্রকাশ করছে স্মিতহাস্যে। এখন তরুণদের অনেকের কবিতায় টুইস্ট দেখবেন, অনেকেই টুইস্টকেই তাদের প্রধান উপজীব্য করে তুলেছে, আমার জন্য তেমনটি হয়নি। তবে এখানে আমার একটি উত্তমর্ণ আছে, যা তুলনামূলক আলোচনায় বেরিয়ে আসবে। তাদের কবিতা আমার কবিতা থেকে খুব কমই আলাদা।


হারুন পাশা : বর্তমান প্রজন্মের প্রবণতা...

মজিদ মাহমুদ : কবিতা সর্বদা তরুণদের হাতে। তরুণরা আছে বলেই কবিতার ধারাবাহিকতা বজায় আছে। তরুণদের পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। কেননা তারা নিজেরাই তাদের নিয়ন্তা। তাদের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা, আস্থা ও সমর্থন। তবে যারা এটি মনে রাখবে যে কবিতার এই পথটি বেশ পুরোনো, বর্তমান থেকে অতীত ইতিহাসের গর্ভে প্রবাহিত হয়েছে। অতএব, তাদের এই বিষয়গুলো জানতে হবে। তবে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ সাম্যের যুগ তাদের গড়ে ওঠার সময় দিচ্ছে না। আমি যদিও তরুণদের সর্বদা বই প্রকাশের ব্যাপারে তাগিদ দেই, তবু বলতে হবে আমার বই তারুণ্যে প্রকাশিত হলেও লেখা শুরুর এক দশকের মধ্যে কেউ জানতেই পারেনি, এমনকি লেখার শুরুর প্রায় দুই দশক পরে পত্রপত্রিকায় কিছুটা প্রকাশের সূচনা হয়। এখন কি এটা ভাবা সম্ভব একজন লেখক লেখা শুরুর প্রায় দুই দশক ছাপাখানার বাইরে থাকবে! আজ আপনি যখনই লিখবেন তখনই ফেসবুকে প্রকাশ। এমনকি শিশুকবি বা শিল্পী যারা নিজে পারে না, তাদের অভিভাবকগণ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপুষ্ট রচনা সামনে আনছেন। এটি খুব অন্যায়, তার কারণ পাঠকরা আর কখনো তাকে পরিণত হিসেবে দেখতে চাইবে না।

তবু বর্তমান প্রজন্মই আমাদের ভরসা। তাদের প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক জ্ঞান আমাদের কাল থেকে তাদের এমনিতেই আলাদা করে দেবে; কালের উপযোগী করে প্রকাশ করবে।


হারুন পাশা : অনেক ধন্যবাদ মজিদ ভাই আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।

মজিদ মাহমুদ : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা