X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক্তার, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বাহাসে কে জিতলেন?

আমীন আল রশীদ
১৯ এপ্রিল ২০২১, ২২:২৭আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২১, ২২:৩১

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া এবং মুভমেন্ট পাস ইস্যুতে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের ঝগড়ার যে ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনিও সেটি দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, এই ঝগড়ায় কে জিতলেন এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা কী শিখলাম?

যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে ভিডিওর খণ্ডিত অংশ। সুতরাং পুরো সময়ে সেখানে কী ঘটেছিলো তা জানা কঠিন। যিনি ভিডিও করেছেন তিনি ভালো বলতে পারবেন। ভিডিওটা দেখা যাচ্ছে মাঝখান থেকে। শুরুর অনেকখানি কেটে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ভিডিওর ক্ষেত্রেও যেটি করা হয়। অর্থাৎ যার যেটুকু প্রচার করলে সুবিধা হয়, তিনি সেটুকু প্রচার করেন। তবে সেই বিতর্ক বাইরে রেখে যতটুকু দেখা গেছে তা নিয়েই আলোচনা করা যাক।

রবিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার পথে ওই নারী চিকিৎসককে বাটা সিগন্যাল মোড়ে থামায় পুলিশ। সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও উপস্থিত ছিলেন। গাড়ি থামালে ওই নারী নিজেকে চিকিৎসক বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তিনি জানান সঙ্গে পরিচয়পত্র নেই। পুলিশ তখন মুভমেন্ট পাস চায়। এ সময় চিকিৎসক বলেন, ডাক্তারদের মুভমেন্ট পাস লাগে না। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে চিকিৎসক গাড়ি থেকে নেমে আসেন এবং পুলিশের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হন। এ সময় ওই নারী চিকিৎসক নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দেন। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দেন।

চিকিৎসক বলেন, ‘আমি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি বলে আমি ডাক্তার, আপনি চান্স পাননাই বলে আপনি পুলিশ।’ -এটি খুবই অশোভন কথা। মেডিক্যালে চান্স না পেয়ে যারা ডাক্তার হতে পারেননি, তারা সবাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, বিষয়টা এমন নয়। ডাক্তারদের চেয়েও অনেক মেধাবী লোক অন্য পেশায় আছেন। আবার অনেক মেধাহীন, অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ ডাক্তারও আছেন। সুতরাং ওই চিকিৎসক বারবার যেভাবে চিৎকার করে বলছিলেন ‘আমি ডাক্তার ডাক্তার ডাক্তার’—সেটি খুবই কানে লেগেছে। পুলিশকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলাটাও সঙ্গত নয়। 

ডাক্তারদের অনেক বেশি সংবেদনশীল, সহনশীল ও সহমর্মী হতে হয়। কিন্তু তিনি রেগে গিয়ে হোক আর অহঙ্কারের বশেই হোক, যেভাবে বারববার নিজেকে ‘ডাক্তার’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ বলে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে ‘ডাক্তার’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’র মতো দুটি পবিত্র শব্দই অসম্মানিত হয়েছে বলে মনে হয়। সেইসঙ্গে পুলিশও ম্যাজিস্ট্রেটও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দেন। প্রশ্ন হলো এই তিনজনই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে কী বোঝাতে চাইলেন? মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলেই রাস্তায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা যায়? পুলিশকে পরিচয়পত্র দেখানোর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ের কী সম্পর্ক? এর দ্বারা মনে হতে পারে তারা বাবার পরিচয়ে চাকরি পেয়েছেন। নিজেদের যোগ্যতায় নয়। বরং রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বাবার পরিচয় দিতে থাকলে নিজেকেই ছোট করা হয়।

এবার ঘটনাটিকে এবার উল্টোভাবেও দেখা যায়। সেটি হলো, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে মুভমেন্ট পাস নিয়ে পুলিশের অতি উৎসাহের কারণে। সরকার এই লকডাউন বা সাধারণ ছুটিকালীন যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেখানে মুভমেন্ট পাসের কোনও উল্লেখ নেই। বরং পুলিশ এটি চালু করেছে। সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে পুলিশ কী করে এই মুভমেন্ট পাস চালু করলো? এই এখতিয়ার আইনত তাদের আছে কি না? 

পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেছিলেন, ‘মুভমেন্ট পাস নিতেই হবে এমন নয়। আমরা কাউকে বাধ্য করছি না। এখানে আইনগত কোনো বিষয় নেই।’ প্রশ্ন হলো, যে জিনিসের আইনগত ভিত্তি নেই, পুলিশ সেটি জনগণকে মানতে বাধ্য করে কী করে এবং জরিমানা করে কীভাবে? জরিমানা তো আইনি বিষয়। আবার এই জরিমানা ও মামলা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ফেসবুকে লিখেছেন: ‘যে ধারায় একজন চিকিৎসককে জরিমানা করেছে তা কোথাও খুঁজে পেলাম না। ডিএমপি অর্ডিন্যান্স এর ৯২(১) ধারা বলে কিছু নেই। ৯২ ধারা হল রাস্তায় জুয়া খেলার অপরাধ। কিসের আইনে জরিমানা করছে তা তারাই জানেন।’

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিকদেরও মুভমেন্ট পাসের নামে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ কাদের মুভমেন্ট পাস লাগবে না, সে বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সেই তালিকায় চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা রয়েছেন। সুতরাং ওই নারী চিকিৎসক যখন হাসপাতলের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে যাচ্ছিলেন এবং তার পরনে অ্যাপ্রোন ছিলো এবং তিনি নিজেই যখন বললেন যে আইডি কার্ড সঙ্গে নেই, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত ছিলো।

এটা ঠিক যে, যখন চলাচলে বিধিনিষেধ আছে, তখন বাইরে বের হলে পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তারপরও কেউ এটি সঙ্গে নিতে ভুলে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ নিয়ে স্যরি বললে বা বিষয়টি নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে কথা বললে ঝগড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতো না। পক্ষান্তরে আইডি কার্ড সঙ্গে নেই বলার পরও তাকে যেতে না দিয়ে পুলিশ তাকে যেভাবে অনবরত জেরা করছিলো, সেটিও অযৌক্তিক ও ও অন্যায্য। বরং এরকম পরিস্থিতিতে পুলিশের উচিত কোনও চিকিৎসকের যদি বাহন না থাকে তাহলে তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, লকডাউন বা সাধারণ ছুটির প্রথম দিন থেকেই মুভমেন্ট পাস নিয়ে একাধিক চিকিৎসক হাসপাতালে যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হয়েছন। কারো কারো পরিচয়পত্র ছুড়ে ফেলা, গাড়ির নামে মামলা দেয়া এমনকি ডাক্তারকে ‘কসাই’ বলে পুলিশ গালি দিয়েছে—এরকম সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে—যা এই অতিমারিরকালে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

প্রশ্ন হলো, রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশের কাছে কি মুভমেন্ট পাসের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই নাকি কেউ কেউ দায়িত্ব পালনের নামে বাড়াবাড়ি করছেন? বাস্তবতা হলো, দুঃসময়ে চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক—সবাই নিজেদের জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং এখান ক্ষমতা বা দম্ভ দেখানোর সময় নয়। এরকম দম্ভ ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ দেখে মানুষের মনে যেন রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলোর সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা তৈরি না হয়। মানুষ যেন মনে না করে যে, এগুলোই আমাদের স্ট্যান্ডার্ড।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

/এফএএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ