X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: সেক্যুলার ফতোয়া ও মৃত্যুর শ্রেণিবিন্যাস

মাকসুদুল হক
০২ মে ২০২১, ১২:৪০আপডেট : ০২ মে ২০২১, ১২:৪০

মাকসুদুল হক
“মানুষে মানুষ গাঁথা দেখ না যেমন আলোকলতা
জেনে শুনে মুড়াও মাথা জাতে ত্বরবি” - ফকির লালন শাহ

২০২০-এর ৬০ দিনের লকডাউন কিছু অপ্রিয় সত্য চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, আমাদের নির্বুদ্ধিতা সহ অহেতুক ভয় ও আতঙ্কের তীব্রতা। করোনাভাইরাস ও তার উপসর্গ কোভিড-১৯-এর সঙ্গে ভাইরাল হওয়া শুরু করে কিছু ‘বাজ ওয়ার্ড’ বা ‘চালু শব্দ’ যা শিক্ষিত এমনকি ‘সামাজিক সচেতনতায়’ ভরপুর জনগণ কোনও রকম যাচাই-বাছাই, চিন্তাভাবনা ছাড়াই ব্যবহার করা শুরু করলো প্রকাশ্যে - ও করে তুললো ‘ফ্যাশনেবল’।

কেবল আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ এসব শব্দ ব্যবহার করছে– তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে সব দেশের সরকার প্রধান, সকল মিডিয়া-প্রিন্ট মিডিয়া, সমগ্র বিশ্বের টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম- আমরা শব্দগুলো মস্তিষ্কে ‘কপি পেস্ট’ করলাম চোখের এক পলক না ফেলে।

অনস্বীকার্য যে, এই দুর্বিষহ প্যানডেমিক একটা ‘ইমার্জেন্সি’ বা অঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’। এমত অবস্থায় যা হুকুম করা হয়, তাই মানতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যে তার ব্যতিক্রম চিন্তা করবে সেই ভাবনা বোকাদের স্বর্গে বাস করার মতোই হতো।

শব্দযুগল ছিল ইংরেজি ভাষায় ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ যা আমরা বাংলায় তর্জমা করলাম ‘সামাজিক দূরত্ব’ যা এখনও চালু রয়েছে - শাবাশ! অনেকে হয়তো ভাবছেন এই শব্দযুগল এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ করলো?

আমার কিছু প্রশ্ন: আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ‘সমাজ’ বলতে যা বুঝি তার সঙ্গে কি কোনও উন্নত দেশের সমাজের তুলনা চলে? আছে কি আমাদের সমাজে শ্রমের কোনও মর্যাদা? আমাদের সমাজে এই অবধি সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে সমতা নিয়ে আসতে পেরেছি? আমরা কি খাদ্য নিরাপত্তার বেষ্টনীতে সমগ্র শ্রেণিপেশার মানুষদের আবদ্ধ করতে পেরেছি? সর্বোপরি স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কি সামাজিক কল্যাণের রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি?

যতই সাম্যবাদ, ‘বিপ্লব’ বামপন্থার ফাঁকা বুলি ছুড়ি, যতই মুখের ‘লালা লচলচিয়ে’ মাটিতে ফেলে মোল্লাতন্ত্রের ‘ইনসাফ’ (ইদানীংকালের আরেক ‘চালু’ শব্দ) এর হুংকার তুলে বলি ‘আল্লাহ ব্যক্তি দরিদ্রতা বরদাশত করে না, এ কারণে আমরা মুসলিম উম্মাহ - এক দেহ, এক মন, এক ভাগ্য’ - তাতে কি এই দেশের হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের কোনোরকম পরিবর্তন হয়েছে?

হয়নি এবং হবার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। আরেকটা জঘন্য অবিচার আমরা করি যখন বলি ‘গরিব তো মরবেই’ - বা ‘ইস্ ....দেখো দেখো গরিবরা কীভাবে মরছে’।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে এসব স্থূল ও অপমানকর কথাবার্তায় হতদরিদ্র খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী ধার ধারে না এবং তাতে তাদের কিছুই আসে যায় না। তাদের ভাগ্য তারা মেনে নিয়েছে। তারা বেঁচে থাকার জন্য অকল্পনীয় মেহনত করে বেঁচে আছে ও থাকবে। তবে আমরা ভুলে যাই তারাই বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বা তার ঊর্ধ্বের নাগরিক। তাঁরাই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা না। তাদের শ্রমেই আমাদের অর্থনীতি বেগবান থাকে। আর আমরা কি করি?

তাদেরই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘাম ঝরে পড়া শ্রমে আমরা গড়ি আমাদের অশ্লীল অহংকারের প্রাসাদ আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই ‘ধুর ধুর’ করে তাড়িয়ে দেই   ‘ভিখারি’ অপবাদ দিয়ে। বেহেশতে যাবার সওয়াবের টিকিট ‘অগ্রিম ক্রয়’ তো করতেই হবে! সে কথা মাথায় রেখে কালেভাদ্রে আমাদের অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে দুই-চার পয়সা মানুষ দেখানো দান খয়রাত করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য উদ্বুদ্ধ হই। বাহ্, দেখো .....কি সাচ্চা দানবীর এক ‘ধার্মিক’ মুসলমান, মাশাল্লাহ!

আর আমার মতো কিছু পাবলিক যারা যখন-তখন এসব অসঙ্গতির বিষয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন তুলি, আমাদের তথাকথিত ‘সুশীলতন্ত্রের’ বা ‘কুল অ্যান্ড সেক্সি সামাজিক যোগাযোগতন্ত্রের’ কাছে বরাবরের মতো, হয় ‘পাগল’ বা ‘ভন্ড’ বলে গালি শুনি। আরও কিছু ‘ম, চু, খ’ সূচক গালি আছে যা শালীনতার খাতিরে এই লেখা থেকে বাদ দিলাম। যুক্তির লড়াইতে ফেইল করলে মুখের ডগায় গালি ও খিস্তি আমাদের একমাত্র সম্বল....তাই হোক.....মূল আলোচনায় ফেরত আসি।

যে মুহূর্তে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার আকুল আবেদন এলো এবং তথাকথিত ‘সচেতনতা’ ও এই দুঃসময়ে বেঁচে থাকার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় অলংকার বলে বিবেচিত হলো, আমরা পড়ে গেলাম বিপাকে।

কে বা কারা, কোন মাথামোটা বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবী এই ‘সেক্যুলার ফতোয়া’ জারি করলো তা আমাদের অজানা। তবে লক্ষণীয় এই ঘোষণার ঠিক পরেই যে প্রথম কাজটা আমরা করলাম তা হলো আমাদের গৃহপরিচারিকা-সহ ড্রাইভার, দারোয়ান ইত্যাদিদের ‘ছে ছে দূর হ’ বলে রীতিমত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কি কারণে তাদের সঙ্গে এই অবিচার হচ্ছে তার পক্ষে ‘শক্ত যুক্তিগুলো’ ছিল এ রকম:

১. তারা গরিব বস্তিবাসী ও নোংরা। বস্তি যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ এই রোগ তাদের সবার আগে ধরবে। তারা আমাদের বাসায় ‘ছুটা’ বা পার্টটাইম কাজ করে আর সন্ধ্যায় আবারও বস্তিতেই ফেরত যায়। এই যাওয়া আসার ভেতরে ওরা সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হবে, আমাদেরও করবে, ও আমরা মরবো। তাই যা- ছে ছে দূর হ!

২. মাসের বেতনটা তো হিসাব করেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে আর সমস্যা হলে আমরা এসব ‘পুওর পিপল, ডার্টি পিপল, লেংটা পিপলের’ জন্য সব সময় আছিই। আফটারঅল আমরা তো অত ‘ক্রুয়েল’ না। তাই যা- ছে ছে দূর হ!

৩. কপালে নামাজের কড়া দাগ থাকা অতি ধার্মিক এক আত্মীয় বললেন ‘জান বাঁচানো ফরজ’ এ কথা কোরআনে আছে। তাই যা- ছে ছে দূর হ!

আর আমাদের ‘সুউচ্চ সমাজে’ ভবিষ্যৎ বাণী করা হাইপার পাবলিকের তো কোনও কমতি নেই। ‘অতো গরিবের দোস্ত হইতে যাবেন না, একটু ওয়েট করেন ভাই - কদিনের ভেতরে দেখবেন রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। দাফন কাফন তো হবেই না বরং সেভেন্টিওয়ানের মতো লাশ পচবে, বাতাসে লাশের গন্ধ ছড়াবে, চিল, শকুন ও কুকুর এসব লাশ ভক্ষণ করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

অবাক করার মতো কান্ড – গরিবের হক মেরে তাদের বিরুদ্ধে জুলুম করার জন্য যত রকম অদ্ভূত যুক্তি ও অজুহাত সবই দেখি রেডি! এই ‘সামাজিক দূরত্বের’ ফতোয়া ধনী-গরিবের সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের দিকে আমাদের ঠেলে দিতে পারে, তা কিউ মাথায় রেখেছিল কিনা তা নিয়ে আমার আছে ঘোরতর সন্দেহ।

মানুষ নামের জীবের এই মানসিক অধঃপতন, মনুষ্যহীনতা দেখে আমার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাবার উপক্রম। তার কারণ আমি ১৯৭৪-৭৫-এ ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের সাক্ষী।

বন্যা, খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছাড়াও আরও অনেক কারণ ছিল এই বিপর্যয়ের নেপথ্যে। তবে মূল কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ওপরে খবরদারি না মেনে নেওয়ার কারণে আমাদেরকে ‘ফুড এম্বারগো’ বা খাদ্য সাহায্যের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো। ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ খাদ্য অনাহারে পিষ্ট মানুষের ঢাকাতে আগমন ও দিবানিশি ‘খাইতে দেন খাইতে দেন’ আহাজারি এখনও আমার কানে বিভীষিকার মতো বাজে।

তখন আমি নটরডেম কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ুয়া ছাত্র। অনাহারে থাকা মানুষের জীবন রক্ষার্থে সমগ্র বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে লঙ্গরখানা সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেমনটি করা হয়েছিল আমাদের কলেজ প্রাঙ্গণেও। প্রায় ৩ মাস সেখানে আমি-সহ অন্যান্য ছাত্র ২৫০০ মানুষের দেখাশোনা করার স্বেচ্ছাসেবকের কাজে নিয়োজিত ছিলাম। ভাষায় অবর্ণনীয় এই ট্র্যাজেডি, এই দুর্যোগ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম।

মৃতদেহের স্তূপ অনেক জায়গায় বিশেষ করে রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে দেখা যেতো। অসুস্থ ও অনাহারে থাকা কঙ্কালের মতো মানুষ পথে-ঘাটে ফ্যাকাসে চোখ-মুখ নিয়ে যেভাবে তাকিয়ে থাকতো তা মনে হতো এসব ‘জীবিত মৃত’। অজানা কারণে আমাদের ইতিহাসের পাতা থেকে এই দুর্ভিক্ষের কথা ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে।

এই একইরকম দৃশ্য ২০২০-এ আমরা আবারও দেখবো? এ কথা একেবারেই মেনে নিতে পারছিলাম না। অথচ আমার বিল্ডিংয়ের বাইরের চিত্র দিনে দিনে অবনতি হতে থাকলো।

আমাদের মহল্লার গৃহপরিচারিকা ‘বুয়া’ (আপা)-দের অধিকাংশ স্বামী হয় রিকশা না হয় ভ্যানচালক। তাদেরও কোনো ‘খ্যাপ নাই’ - রিকশা, ভ্যান আয় ইনকামের পথ সবই বন্ধ, তাদের কোলের সন্তানাদিরা রয়েছে অনাহারে। পুরো পরিবার বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায় রাস্তায় দুটো অন্নের সন্ধানে। একই চিত্র সমগ্র ঢাকা শহরে। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ পথঘাটে, ফুটপাথে বসে আছে একটু খাবার পাওয়ার অপেক্ষায়। কেউ খাবার নিয়ে আসলে মরিয়া হয়ে পেছনে পেছনে ছুটছে রুগ্ন শিশু, ছুটছে আবালবৃদ্ধবনিতা।

বাংলাদেশের গরিব কারও কাছে হাতপাতা বা ভিক্ষা নেবার অভ্যাস নেই - গরিব হলেও তাদের ইজ্জত আছে। অথচ ২০২০-এর মার্চ মাসের শেষে এই এক ‘সামাজিক দূরত্বের’ জু-জু দেখিয়ে আমরা করলাম তাদের ইচ্ছাকৃত ও সমষ্টিগতভাবে বেইজ্জতি, যা তাদের জীবনে এর আগে কেউ করেনি বা করার সাহস পাইনি। এত বড় দুঃসাহস আমরা পেলাম কোথা থেকে?

যে কারণে এসব দরিদ্র মানুষকে আমাদের আঙ্গিনায় নিয়োগ দেই, তা মূলত আমাদের গৃহসহ কাপড়চোপড় পরিষ্কার করা ও রান্নায় সহযোগিতা করা। তাই যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে কোন যুক্তিতে, কোন বিচারে আমরা মনে করা শুরু করলাম ওরা ‘অপরিষ্কার’ ওরা ‘নোংরা’? ওদের হাতের রান্না পর্যন্ত আমরা খাই - তখন কী সেখানে তারা বিষ মেশায় নাকি আমরা কোনও নোংরামি দেখি? গরিব হওয়াটাই কি তাদের একমাত্র ‘অপরাধ’?

উল্টোটা- আমরা অলসতার কারণে নিজেরাই অপরিষ্কার থাকি, তৈরি করি আবর্জনার স্তূপ ও সেগুলো তারা সরিয়ে দিয়ে আমাদের বাসাঘরের পরিবেশ রাখে সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত। ক্রীতদাসদের দিন শেষ হলেও আমাদের নোংরা ‘আত্মার দরিদ্রতার’ কারণে এসব চোখে দেখি না, কারণ প্রকারান্তরে তাদের আমরা ‘সার্ভেন্ট’ বা ‘চাকর’ মনে করি।

আর ‘সামাজিক দূরত্ব’?

খেটে খাওয়া অতিসাধারণ দরিদ্র মানুষ ‘শারীরিক দূরত্বে’ সজ্ঞানে চর্চা করে ও আমাদের থেকে এমনিতেই দুই চার হাত দূরে থাকে। এটাই তাদের স্বভাবগত চরিত্র। না তারা আমাদের গায়ের সাথে গা ঘেঁষে কথা বলে, না সে আমাদের ব্যবহৃত চেয়ার টেবিলে বা খাট পালঙ্কে বসে, বা নিজের মতো করে ব্যবহার করে। সকাল বিকাল সে নীরবে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেই যায়। এটাই তাদের ‘মুনিবের প্রতি সম্মান’ - আর আমরা বিপদের সময় কি সম্মান তাদের দেখালাম? এ কী আমাদের মরণের ভয় নাকি অশ্লীল শ্রেণিগত স্বাজাতিকতা?

‘মৃত্যুর মিছিল’ নিয়ে আমরা খুবই আবেগ তাড়িত পোস্ট দিচ্ছি ফেসবুকে। যেহেতু শ্রেণির প্রভেদে আমরা বিশ্বাসী - দয়া করে কি বলবেন যারা প্যানডেমিকে এই অবধি মারা গেছেন বা যাচ্ছেন - তারা কোন ‘শ্রেণির’ মানুষ? স্পষ্টত কাপড়চোপড় ও টাকা খরচের প্রবণতা দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার। সম্মান রেখেই কথাটা বলছি - হয় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা একেবারে অভিজাত শ্রেণির মানুষ। কতজন তথাকথিত ‘গরিব’ কে সেই ভিড়ে দেখতে পেরেছেন এ পর্যন্ত?

কত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সরকারি আমলা, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, অভিনয় শিল্পী, এমনকি কোটিপতি চলে গেলেন। কই কোনও বস্তিবাসী, রিকশাওয়ালা, দোকানের কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, কৃষক, গার্মেন্টস ওয়ার্কার, ট্রাক, বাস, ভ্যান চালকের মৃত্যুর খবর কি দেখা বা শোনা যাচ্ছে? আপনাদের কুৎসিত ভবিষৎ বাণী যদি সত্য হতো তাহলে এতদিনে তো অনেক বস্তি সাফ হয়ে যাবার কথা। তা হয়নি বা হলো না কেন? এমনকি ম্যাজিক ‘গরিব’ দেখাতে পারছে, যা আমরা দেখাতে পারছি না?

আমাদের এই যুগ সম্পূর্ণ তথ্য-উপাত্ত নির্ভর। কজন লোক কদিনে কীভাবে মারা যাবে সেই কাল্পনিক পূর্বাভাসের তথ্যও আমাদের নখদর্পণে। কিন্তু সমাজের কোন শ্রেণির কতজন লোক, কীভাবে এই প্যানডেমিকে মারা যাচ্ছে তার কোনও ‘ডেটা’ আমরা এই অবধি জোগাড় করেছি? করিনি, কারণ সমাজের বাস্তবিক চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা ও তা আমাদের রীতিমত থতমত করে নিশ্চুপ করে দেবে লজ্জায়।

অপরদিকে আরেকটা অবাক করার বিষয়, যা উপেক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব না। মৃত্যুর ঘটনা কেবল ঢাকাসহ অন্য বড় শহরগুলোতেই ঘটছে। গ্রামগঞ্জের খবর কি? পরিচিত কেউ বা আমাদের আত্মীয়-স্বজন কজনই বা মৃত্যুবরণ করেছে? খুব সহজে উত্তর মিলবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই হতদরিদ্র মানুষ মরছে না বা মরবে না, তার সম্ভাব্য কারণগুলো কি তা দেবার চেষ্টা করছি:

১. গরিবের কোনও মৃত্যুর ভয় নেই। কারণ, সে প্রতিদিনই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। তাদের জীবন-জীবিকা ও হাত থেকে মুখ অবধি অন্ন জোগাড়ের করুণ বাস্তবতা যে পরিমাণ দুশ্চিন্তায় রাখে, তাতে মৃত্যুর অহেতুক চিন্তা হলো ‘বিলাসিতা’। তা করার মতো সময় বা সামর্থ্য কোনোটাই তাদের নেই।

২. অনাহারে বা অর্ধাহারে গরিব যত স্বল্পটুকুই খাবার খাক না কেন, তাতে পুষ্টির যে পরিমাণ থাকে তা আমাদের খাদ্যে অনুপস্থিত। তাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বা ‘ইমিউনিটি’ আমাদের চেয়ে ঢেরগুণ বেশি। এর পাশাপাশি আছে দেশি লতাপাতা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের মরিচ, মসলা ও প্রাকৃতিক ঔষধি। সবকিছুই তারা জোগাড় করে প্রকৃতি থেকে এবং সবকিছুই তারা পায় টাটকা- এমনকি মাছ মাংসও।

৩. অপরদিকে আমরা জীবনকে ‘আধুনিক ও সুস্থ’ রাখার প্রয়াসে দেহে গ্রহণ করি ভেজালমিশ্রিত ‘পয়জন’ বা বিষ। ‘জাঙ্ক ফুড’ বা আবর্জনাকর খাদ্যকে আমরা তর্জমা করেছি ‘ফাস্ট ফুড’ বা ‘দ্রুত খাদ্য’। আমরা এতটাই নাকি ব্যস্ত যে সবকিছু হতে হবে ঝটপট বা ‘ইনস্ট্যান্ট’। তাই ইনস্ট্যান্ট কফি, ইনস্ট্যান্ট নুডুলসের মতো আমরা চাই সকল সমস্যা, এমন কি করোনারও ‘ঝটপট সমাধান’।

এসবই হলো আমাদের সঙ্গে গরিবের তফাৎ। বছরকে বছর আমাদের দেহের মধ্যে সঞ্চালন করছে কত হাজার রকম মানবসৃষ্ট রাসায়নিক ও মাদকদ্রব্য তা কি একটুও আমাদের ভাবনায় আসে? এই যে জাতিগতভাবে আমাদের অহেতুক ভয়, অস্থিরতা ও অধৈর্যের বৈজ্ঞানিক কারণগুলোই বা কি, তা আমরা জানা বা বোঝার ইচ্ছা কি কখনও প্রকাশ করেছি?

বিভিন্ন বহুজাতিকের আগমনে আমাদের ‘ফুড চেইন’ যে ধ্বংস হয়ে গেছে বহু আগে তা কি আমরা পারবো আগের জায়গায় ফেরত নিতে? যেভাবে আমাদের বাপদাদা পূর্ব পুরুষরা বেঁচে ছিল ও জীবন যুদ্ধে এগিয়ে ছিল, তা কি আমরা করতে পারবো না? আমি মনে করি, এই তিন বিষয়ে ধ্যান করলেই কোভিড-১৯-কে কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে তার সহজ পদ্ধতি আমরা নিজেরাই বের করতে পারাটা অসম্ভব কিছু না।

একটা পজিটিভ চিত্র দিয়ে এই লেখার ইতি টানছি।

ঠিক ১৯৭৪-৭৫-এর মত ২০২০-এ বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সাহায্য সংস্থা, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এগিয়ে এসেছিল গরিবের সাহায্যার্থে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেরিয়ে পড়েছিল অনাহারে কাতর মানুষকে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য। না, বাংলাদেশের সব মানুষই স্বার্থপর বা অসংবেদনশীল এ কথা কখনোই বলা যাবে না।

শেখ হাসিনার সরকারকে পছন্দ করি আর না করি, বিশ্বাস করি আর না করি, ভোট দেই আর না দেই- সে অন্য কেচ্ছা। তবে যে সত্যটা অনস্বীকার্য তা হলো গত বছরের এই প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের সময় ক্ষুধার্ত ‘গরিব’ জনগণের জন্য ঠিক সময়ে  ৩৫ লক্ষ দরিদ্র পরিবারকে সরাসরি মোবাইল ফোন মারফত ২৫০০ টাকা করে প্রদান করা খুব ভয়াবহ অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে।

এই দুটি কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কি আমাদের একটা বিনম্র স্যালুট পেতে পারেন?

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ