X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একজন গণমাধ্যম কর্মীর অস্বস্তি

রেজোয়ান হক
০৩ মে ২০২১, ১১:৫২আপডেট : ০৩ মে ২০২১, ১৭:২১

রেজোয়ান হক আমাদের সাংবাদিকতা নানা কারণেই বহুদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। গুলশানের ফ্ল্যাটে মুনিয়া নামের তরুণীর অপমৃত্যুর কাভারেজ নিয়ে তা নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়ে, বলা যায় বড় একটা ঝাঁকি খায়। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কখনও কুতর্ক, কখনও যৌক্তিক বিতর্ক বা আলোচনায় আশাবাদী হয়েছিলাম এর মধ্য দিয়ে হয়তো আমরা কিছুটা হলেও পরিশীলিত হতে পারবো।

কিন্তু অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, এই বোধ কোনও কোনও মিডিয়া হাউজকে মোটেই স্পর্শ করেনি, বরং এই ঘটনাটির ফলোআপের নামে তারা যা পরিবেশন করছে তা সাংবাদিকতা নিয়ে আগেই ওঠা নানা প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে, মানুষের আস্থা যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা ধরেও টান দিয়েছে। একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে অস্বস্তি বোধ করছি।

তবে মুনিয়ার অপমৃত্যুর কাভারেজ নিয়ে এক শ্রেণির পাঠক-দর্শকদের যে অসন্তোষ বা সমালোচনা রয়েছে সেজন্য সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে নিন্দা করা অন্যায্য। প্রায় ৩ যুগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মতলববাজ কিছু লোক বাদে অধিকাংশ সাংবাদিক অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, দুর্নীতি প্রকাশ করে সমাজকে শুদ্ধ করা বা রাখার মহান ব্রত নিয়েই এ পেশায় এসেছেন। সে কারণেই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যেও বেশিরভাগ সাংবাদিক এ পেশা ধরে রেখেছেন।

ফেসবুকের চর্চা যারা বেশি করেন, তারা যেহেতু এই প্ল্যাটফর্মে যখন যা খুশি লিখতে পারেন, তাই তাদের ধারণা গণমাধ্যমেও সাংবাদিকরা তা করতে পারেন। যখন তারা তা পান না তখনই সাংবাদিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কিন্তু তারা তো শুধু তথ্য সংগ্রহ এবং তা পরিবেশনের জন্য তৈরি করে দিতে পারেন, তা প্রচার বা প্রকাশ করার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞাপনদাতা এবং মালিক পক্ষের ব্যবসায়িক বা গোষ্ঠীস্বার্থ, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ঘটনাগুলোর বেলায়।

ঠিক এ কারণেই এই মুহূর্তে একশ্রেণির মিডিয়ায় গুলশান ঘটনার ভিকটিম মুনিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের চরিত্র হনন চলছে। তা করতে গিয়ে তাদের এই সাধারণ বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে যে, মুনিয়া যদি খারাপ চরিত্রের মেয়ে হয়েও থাকে তাতেও তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া বা হত্যা করা যায় না। যেসব সংবাদপত্রে বা অনলাইনে এই অপসাংবাদিকতা চলছে তাতে সাধারণ সাংবাদিকদের কোনও দায় নেই। প্রতিবেদনের নামে এসব আবর্জনা হয় বাইরে থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে অথবা অতি উৎসাহী সাংবাদিকদের কেউ কেউ তা রচনা করছেন। কোনও কোনও সম্পাদক হয়তো স্রেফ চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য তা অনুমোদন করছেন।

যারা এগুলো করছেন তাদের হয়তো জানা নেই যে, এসব লেখালিখি এই ঘটনার বিচারে কোনও সুবিধা দিতে পারবে না। আদালতে এগুলো কোনও প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না। মাঝখানে ক্ষতি হচ্ছে সাংবাদিকতার, এমনকি যার পক্ষ নিয়ে এসব লেখালিখি হচ্ছে তারও। ইতোমধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি আসলেই দোষী বলেই তাকে বাঁচাতে উল্টো ভিকটিমকে অপরাধী বানানোর এই অপচেষ্টা চলছে। যদিও বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে এই মামলায় আসামি করা হলেও অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যায় না।

আমাদের সবারই উচিত ঘটনাটির উপযুক্ত বিচার হতে সহায়তা করা। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা কেউ কেউ পানি ঘোলা করে তাতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছি। ঘটনা এবং এর চরিত্রগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে সাংবাদিক কমিউনিটি পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জোরে মাত্র দুই বছরের মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া একটি সংবাদপত্র শুধু মালিকপক্ষের স্বার্থের বলি হয়ে অপসাংবাদিকতার ফাঁদে পড়ে পতন ডেকে আনছে। যেসব কর্মী সেখানে শুধু সাংবাদিকতাই করতে গিয়েছিলেন তাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারি। সাংবাদিকতা মহান পেশা হলেও দিনশেষে এটি চাকরিও, যা বেশিরভাগ সাংবাদিকের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস। তাই মুনিয়ার অপমৃত্যু, মামলা নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াগুলোর নীরবতায় সেখানকার সাংবাদিকদের ঢালাও সমালোচনাও মানতে পারছি না। অন্য কোনও গ্রুপের ক্ষেত্রে হলেও এ রকমই হতো।  

তবে এই ঘটনায় সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতায় কিছু ভুল, বিচ্যুতি অবশ্য হয়েছে। প্রথমদিকে খবরটি একেবারেই চেপে যাওয়া অথবা ভিকটিমের পরিচয় দিলেও অভিযুক্তকে আড়াল করা, ভিকটিম মুনিয়ার ছবি প্রকাশ করে সাংবাদিকতার মৌলিক রীতি লঙ্ঘ ন করা- এসব ক্ষেত্রে উপরের চাপ থাকলেও সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর মাধ্যমে তা মোকাবিলার চেষ্টা করা হলে হয়তো কিছুটা হলেও কাজ হতো এবং ক্ষতিটা কম হতো।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে শক্তিশালী সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা দরকার। সম্পাদক পরিষদ নামে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের পুরনো একটি সংগঠন আছে বটে, তবে তারা এসব নিয়ে কখনও ভেবেছে বলে জানা নেই। সব মাধ্যমের মিডিয়ার সম্পাদকদের নিয়ে সম্প্রতি এডিটর্স গিল্ড নামের একটি সংগঠনও হয়েছে। এসব সংগঠনের এখন নামের প্রতি সুবিচার করার সময় এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেইল করে চলা নামসর্বস্ব হাজার হাজার প্রিন্ট এবং অনলাইন সংবাদপত্র ইতোমধ্যে সাংবাদিকতার অনেক ক্ষতি করেছে। করপোরেট হাউজগুলোর মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা মূল ধারার গণমাধ্যমকে গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতাও কারও কারও মধ্যে খুবই প্রকট। এতে বাকিদের প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল। এ রকম চলতে দিলে সাংবাদিকতার মৃত্যু অনিবার্য।

লেখক: বার্তা প্রধান, মাছরাঙা টিভি

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ