X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

 ‘পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ করতে পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০৪ মে ২০২১, ০২:০৪আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ০২:০৪

পারিবারিক নির্যাতন আমাদের এক শ্রেণির মধ্যে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাপার। অর্থাৎ মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে, এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ করতে পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। কিন্তু পরিকল্পনা করলেও যে রাতারাতি বদলে যাবে, সেটাও আশা করা ঠিক হবে না। এটা একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।

দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রেক্ষিত: নারীর গতিশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কেন নারী নির্যাতন কমছে না’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেছেন বক্তারা। সোমবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে অনলাইনে এই আয়োজন শুরু হয়। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলাম।  

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন,  ‘লকডাউনে মানুষের বাড়িতে যে আর্থিক সংকট, সেখানে যে শুধু পুরুষরা সংকটে আছেন তা নয়, একজন নারী যিনি ছোট ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন, সেটাও কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কিছুর চাপ কিন্তু নারীর ওপর পড়েছে। এটার ফলাফল হলো— নারীর প্রতি সহিংসতা। শুধু শারীরিক নির্যাতন না, অনেক ধরনের মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনসহ সবধরনের নির্যাতন বেড়ে গেলো। তবে সংসারে সংকটের কারণে এসব ঘটনাকে দায়ী বলে আমি মনে করি না। কেন সেটা হবে, নারীও তো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও তারা ধরে রাখতে চাচ্ছে সংসারটা। একজন নারী তার পরিবারের সবকাজ কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে তাদের ওপরেই এই অত্যাচার নির্যাতন কেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক নির্যাতন আমাদের একশ্রেণির মধ্যে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাপার। অর্থাৎ, মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে, এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। গুরুতর আহত না হলে এসব ঘটনা সামনে আসে না। আমাদের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ যে আইন, সেটাও কিন্তু কার্যকর না। ’  

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মির্জা তাসলিম বলেন, ‘যেকোনও দুর্যোগ মুহূর্তে নারী একটি দুর্বল অবস্থানে থাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু মতাদর্শের জায়গায় হাত দেওয়া খুব কঠিন ছিল। এই জায়গায় যখনই কাজ করতে কোর্টে কেউ গেছেন, তাদেরকে ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। কারণ, যেটি প্রাধান্যকারী মতাদর্শ, আধিপত্যকারী মতাদর্শের জায়গায় কোনও পরিবর্তন আনতে গেলেই তার বিরোধের মুখোমুখি হতে হয়। যা কিছু চলছিল সমাজে সেই জায়গায় পরিবর্তন কেউ পছন্দ করে না। সেই সময় তা ভীষণ প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল।’

তিনি আরও বলেন,  ‘মতাদর্শে হাত দিলে নারী কাজ করতে গেলে তার ওপর যে বোঝা আছে, যে চাপ আছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসা কিন্তু এত সহজ হবে না। এমনিতেও পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে, কিন্তু পরিকল্পনা করলেও যে রাতারাতি বদলে যাবে, সেটাও আশা করা ঠিক হবে না। এটা একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। আমার কাছে মনে হয়, এখানে এখনও কোনও কাজ শুরু হয়নি।’     

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘‘নারীর অগ্রগামিতা একটি তুলনামূলক শব্দ, কার সাপেক্ষে হয়েছে, কিংবা কার সাপেক্ষে হয়নি। আমি যদি রাশা সুন্দরী দেবীর সময়কাল থেকে বলি, তাহলে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশে নারীসমাজ দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে আসছে। তবে বাংলাদেশের ‘ট্যাবু’ সমাজ, সেই সমাজকে নারীবাদ যতটা না মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে পেরেছে, আমি মনে করি— গার্মেন্টসে নারীরা যখন কাজ করা শুরু করলেন, আমাদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতার যে মিথ ছিল, সেটা ভেঙে গেলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালে যেসব মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না, তাদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শহরের ছেলেমেয়েদের যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্কুলিং করানো যায়ম, তাহলে প্রান্তিক অঞ্চলে যেসব ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ছে, সেসব জায়গায় কেন এই ধরনের স্কুলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে না। এই জায়গায় জোর দিতে হবে। প্রান্তিক অঞ্চলে ছেলেমেয়েদের যেসব প্রণোদনা দেওয়া হতো, সেই স্কিম আবারও চালু করা হোক। চালু করা না হলে এর ভয়াবহতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যাবে। কারণ, এদের বিয়ে হয়ে যাবে অল্প বয়সে, যার ফলে অপুষ্ট সন্তান জন্ম দেবে। তাদের সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ কী, সবকিছু মিলে রাষ্ট্র এত বড় দায়ভার নিতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রকে একটা মিনিমাম জায়গায় আসতে হবে। সেটাই হলো, তাদেরকে স্কুলে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয় তত্ত্ব, মতাদর্শ দিয়ে বিচার করি, বাস্তবে কিন্তু ঘটনা একেবারে ভিন্ন। ইসলাম ধর্মে নারী সম্পর্কে কোনও খারাপ কিছু বলা হয়নি। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে বসে হুজুররা প্রথম আক্রমনটা করেন নারীর প্রতি। হাদিসের কথা— পুত্র সন্তান নয়, কন্যা সন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে, ফেরেশতারা তাদের পাখা দিয়ে ছায়া দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবে ধর্মের ক্ষেত্রে মতাদর্শগত কোনও পার্থক্য নাই। কিন্তু বাস্তবে যখন যাচ্ছে তখন প্রয়োগ ভিন্ন। ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনে ছিল– ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে যিনি অথবা যার বাবা  অথবা যার দাদা এই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের ভেতরে ছিলেন, তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু কোনও নারী যদি বিদেশি কোনও স্বামীকে বিয়ে করেন, তাহলে নাগরিকত্ব পাবের না। এটা পরিবর্তন হয়েছে ২০০৮ সালে। সমাজের যে প্রতিফলন সেটা আইনের ক্ষেত্রে ঘটে। কারণ, সমাজ তো আর আইনের বাইরে নয়। যদি ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচার না হয়, তাহলে যে পুলিশ অফিসার চার্জশিট দিলেন, তার কেন বিচার হচ্ছে না। যদি নাই হয় তাহলে এই ৯৭ শতাংশ মামলার সঙ্গে যেসব লোকবল সরকারের যুক্ত ছিল, জনগণের টাকায় তারা বেতন নিলেন, তাহলে সেই হিসাব আমি কেন নেবো না।’   

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘আজকে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় আমরা একটি নাটকীয় উত্থান দেখতে পারছি। ইতিহাসের দিকে তাকালে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা না। পুরো ইতিহাসেই নানারকম বিপর্যস্ত পরিবেশে নারীরা ভিক্টিম হয়। ইতিহাসে হয় বলেই এখন একুশ শতকে এসে আমরা জাতি হিসেবে একটি উত্থানের মধ্যে আছি। এটি যে স্বাভাবিক ঘটনা সেটা বলার অবকাশ নেই, কিন্তু এরকম কেন হচ্ছে সেটা খুঁজে দেখার জায়গা আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজে যখন আমরা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে যাবো, সেটার মূল ভিক্টিম হয়ে যায় কিন্তু নারী। কারণ, ৭০ দশকের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ ছিল– অধিক জনসংখ্যা কমানো। সেই পরিকল্পনার প্রথম প্রয়োগ করা হলো নারীর ওপরে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যে পরিমাণ নারীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটা মূলত এক প্রকার সহিংসতা না হলেও কিন্তু প্রয়োগ তো শরীরের ওপরই হচ্ছে। যে নারী সহিংসতার শিকার হয় না, সেও কিন্তু সম্ভাবনার ভয়ে দিন পার করে। তাকে ভীতির সঙ্গে বসবাস করতে হয়।’

/এসও/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সাক্ষীতেই আটকে আছে বর্ষবরণে যৌন হয়রানি মামলার বিচার
নারী উদ্যোক্তার মামলা না নেওয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে  
যৌন নিপীড়নের অভিযোগে জবি শিক্ষককে বহিষ্কার
সর্বশেষ খবর
মুক্তি পাওয়া আসামির প্রবেশন মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন, অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
মুক্তি পাওয়া আসামির প্রবেশন মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন, অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও