শহীদুল ইসলাম সাভারের একটি কেজি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। গত বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে গেলে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মাস পরে বন্ধ হয়ে যায় শহীদুলের বেতনও। মোটরসাইকেল চালাতে জানতেন। ঢাকায় এসে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ে নিবন্ধন করে যাত্রী বহন শুরু করেন। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে সব খরচ বাদ দিয়ে হাজার খানেক টাকা নিয়ে সাভারের বাসায় ফিরতেন। এ বছর লকডাউন শুরু হলে অ্যাপ সার্ভিসও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো আর বন্ধ হয় না। সংসারের সদস্যদের খাবার জোগাড় করতে নেমে পড়েন রাস্তায়।
ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুদিন মামলা খেয়েছেন। এরপর থেকে ঢাকার বাইরে বিশেষ করে ঢাকা -পাটুরিয়া রুটে মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেন। রবিবার (২ মে) দুপুরে ঢাকার গাবতলি ব্রিজের ওপর কথা হয় শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, সাভার-মানিকগঞ্জের যাত্রী বহন করি। তবে পাটুরিয়া ঘাটে যেতে পারলে আয় ভালো হয় কিন্তু আমার মতো প্রায় দেড় হাজার বাইকার (মোটরসাইকেল চালক) আছে এই রুটে। ফলে সবাই দূরের যাত্রী পায় না। তিনি জানান, খুব সকালে যাত্রী বেশি হয়। পথে কোথাও চেকপোস্টে গাড়ি আটকায় না। চেকপোস্টে পুলিশ দেখেন না বলেও তিনি জানান। বর্তমানে সারাদিন মোটরসাইকেল চালিয়ে তার আয় হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
বকুল আগে রেন্ট-এ-কারে মাইক্রোবাস চালাতেন। লকডাউনে সব বন্ধ। সংসার চালানোর জন্য নিজে ঝুঁকি নিয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। গাড়ি চালান গাবতলি থেকে পাটুরিয়া ঘাট। ১০ জন যাত্রী নিয়ে রওয়ানা করেন। প্রতিজন ৩০০ টাকা। মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ২০০ টাকা। ফেরার সময় ২০০ টাকা করে যাত্রী নেন। গাড়ির সংখ্যা বেশি বলে যাত্রী পাওয়া দুষ্কর তাই কম রেটই তার ভরসা। রাউন্ড ট্রিপে আয় ৫ হাজার টাকা। জ্বালানি খরচ আর মালিককে টাকা দিয়ে ২ হাজার টাকা রাখাও তার জন্য কষ্টের হয়ে যায়। প্রতিদিন গাড়িও পান না মালিকের কাছ থেকে। এভাবেই সংসারের চাকা চালু রেখেছেন তিনি।
রিফাত আগে উবারে ‘উবার মটো’ সার্ভিস চালাতেন। এখন ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। একজন যাত্রী নিয়ে যেতে চাইলে খরচ বেশি পড়ে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুজন যাত্রী নিলে ৬০০ টাকা আয় হয়। আর একজন হলে যাত্রী ৪০০ টাকার বেশি দিতে চায় না। উবার চালক জামাল জানালেন, তিনি ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে লকডাউন শুরুর পর থেকে নিয়মিত গাড়ি চালাচ্ছেন। চারজন যাত্রী নেন, প্রতিজন ৪০০ টাকা। সামনের আসনে নারী যাত্রী বসানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারী যাত্রী অনেক পাই। তবে একজন হলে সামনের সিটে বসাই। দূরে যান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাড়ি রিজার্ভ হলে যাই। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, নড়াইল পর্যন্ত তার সীমানা বলে জানান।
মোটরসাইকেল, পিক-আপ আর মাইক্রোবাসের সারি
গাবতলি দিয়ে ঢাকা থেকে বের হওয়ার মুখে গাবতলি ব্রিজের এপাশে চোখে পড়বে মোটরসাইকেল, পিক-আপ আর মাইক্রোবাসের সারি। প্রাইভেট কারের সংখ্যাও কম নয়। তবে সকালে এসব যানের ভিড়টা বেশি চোখে পড়ে। যাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। অনেকটা ঈদের আমেজ যেন। রবিবার (২ মে) দুপুরে গাবতলি থেকে আমিন বাজার অবধি হেঁটে চোখে পড়লো ফুটপাতে হাঁটার জো নেই। যাত্রীরা ভিড় করে হেঁটে যাচ্ছেন। কোথায় গিয়ে গাড়িতে উঠবেন ঠিক বোঝা যায় না। পেছন পেছন হেঁটে গেলে চোখে পড়ে কারও হাতে কাপড়ের ব্যাগের সঙ্গে সিলিং ফ্যান, আইপিএসের মেশিন। একজনের মাথায় ছোট্ট মিটসেফ। কাঁধে ঝোলা। ব্রিজের এ মাথায় দূরের ভাড়া বেশ চড়া। ব্রিজ পেরিয়ে পশ্চিম প্রান্তে গেলে গাড়িও বেশি, ভাড়াও তুলনামূলক কম।
তপ্ত রোদের ভেতর হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে ব্রিজ পার হয়ে ওপারে যাচ্ছেন মফজেল হোসেন। যাবেন পঞ্চগড়ে। একটু কম ভাড়ার আশায় রোদের মধ্যে হাঁটছেন। মফজেল জানান, ঢাকায় রিকশা চালাতেন। ঈদের আগেই বাড়ি চলে যেতে চান। বাড়ি গিয়ে কৃষিকাজ করে খাবেন। তিনি শুনেছেন ব্রিজের ওপারে ভাড়া কম। ব্রিজের নিচে আসতেই শোনা গেলো একটা ট্রাক ডাকছে, ‘পঞ্চগড় পঞ্চগড়’। ট্রাকের হেলপার তার কাছে ভাড়া চাইলো ১ হাজার টাকা। মফজেল ৫০০ টাকা দিতে চান। হেলপার নাছোড়। ১ হাজারে কমে যাত্রী ওঠাবে না। দুপক্ষের দরদাম চলছে। অবশেষ রফা হলো ৮০০ টাকায়।
অন্যদিকে পিক-আপগুলো যাচ্ছে, সাভার, মানিকগঞ্জ, ঝিটকা, সাটুরিয়া। সাভারের ভাড়া হাঁকছে ৫০ টাকা। মানিকগঞ্জ ১৫০ টাকা আর ঝিটকা ও সাটুরিয়া ২০০ টাকা। পিক-আপও খালি যাচ্ছে না। যাত্রীদের কারও মুখে মাস্ক নেই। রোদ ঠেকাতে একজন মাথায় তুলে দিয়েছেন মুখের মাস্ক। যেতে পারবেন কিনা জিজ্ঞেস করতেই মাথায় মিটসেফ বহনকারী একজন বললেন, ‘ঈদের সময়ও এমন তরিক হয়। অভ্যাস হয়া গেছে।’ কেন যেতে হবে এই অবস্থায়—প্রশ্ন করতেই পাল্টা জবাব, ‘ঢাকায় কাজ আছে? গ্রামে ধান কাটলে দিনে ৭০০ ট্যাকা পামু’।
মুভমেন্ট পাসের মুভমেন্ট নেই
গত বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) এই প্রতিবেদক জরুরি প্রয়োজনে মাগুরা গিয়েছিলেন। সকালে ঢাকা থেকে বের হওয়ার মুখে গাবতলিতে চেকপোস্ট দেখতে পান কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুভমেন্ট পাস দেখতে চাননি! কেন, কোথায় যাচ্ছি তার কারণও জানতে চাননি। একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিক-আপ ভ্যান থেকে যাত্রী ডাকার দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখা গেলো আমিন বাজার পর্যন্ত। যাত্রী অসংখ্য। সাভার স্মৃতিসৌধ পেরিয়ে যাওয়ার সময়ও চোখে পড়ে শত শত অপেক্ষমাণ যাত্রী। সেখানেও চোখে পড়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিক-আপ, ব্যাটারি চালিত রিকশা ইত্যাদি। ১ মে একই পথ ধরে ঢাকায় ফিরে আসার সময়ও কোথাও মুভমেন্ট পাস দেখতে চাওয়া হয়নি।
ঢাকার প্রবেশমুখে গাবতলি ব্রিজের গোঁড়ার দিকে দেখা মিললো অসংখ্য মোটরসাইকেল চালকদের। দূর থেকে আসা যাত্রীদের তারা গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চায়। বিভিন্ন যানের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, তারা এতবার করে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন, কোথাও চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হননি। তাদের ভাষ্য, যত কড়াকড়ি ঢাকা শহরে!
গার্মেন্ট কর্মীদের বহনকারী গাড়িতে সাধারণ যাত্রী!
গণপরিবহন বন্ধ। তাই গার্মেন্ট মালিকরা বাস, মিনিবাস ভাড়া করেছেন কর্মীদের বাসা থেকে আনা নেওয়ার জন্য। কিন্তু শনিবার (১ মে) বিকেলে নবীনগর ও সাভারে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। ‘গার্মেন্টস কর্মী/শ্রমিক বহনকারী গাড়ি’ লেখা কাগজ বাসগুলোর সামনের বড় গ্লাসে সাঁটানো থাকলেও সাধারণ যাত্রী তোলা হচ্ছিলো। বাসের হেলপাররা চেঁচিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের ডাকছিল। সাভার বাসস্ট্যান্ডে দেখা গেলো বাস থেকে যাত্রী নামানো হচ্ছে। কিছু কিছু গাড়িতে গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হয়েছে। বাসের জানালা দিয়ে যা একটু দেখা গেলো, যাত্রীরা গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে, বসে আছেন। বেশিরভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। বাসের সংখ্যা বেশি থাকায় রীতিমতো যানজটও তৈরি হয়।