X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
পুরান ঢাকায় অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা

বেশিরভাগের নেই লাইসেন্স, স্থানান্তরে লাগবে আরও এক বছর

রিয়াদ তালুকদার
০৬ মে ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৬ মে ২০২১, ১১:০০

দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও তদারকির অভাবে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। ঘটছে অগ্নিকাণ্ড, মারা যাচ্ছে মানুষ, নিঃস্ব হচ্ছে একেকটি পরিবার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি নজরদারি, ব্যবসায়ীদের অবস্থান সনাক্ত ও সচেতনতা বাড়ালেই পুরান ঢাকাকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে। বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে পুরান ঢাকায় যে নিহতের ঘটনা ঘটে তা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের শামিল বলেও মনে করেন তারা।

কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এগোচ্ছে না সেই কাজ। মুন্সীগঞ্জে ৩০০ একর জমির ওপর নির্মিতব্য কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকায় ২০২২ সালের আগে যেতে পারবেন না পুরান ঢাকার কেমিকেল ব্যবসায়ীরা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিটিতে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর আগুনে মারা যান ১২৪ জন। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আগুনে নিহত হন ৭১ জন। এ বছর আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের আগুনের ঘটনায় মারা যান ৬ জন। সব ঘটনার স্থান একই-পুরান ঢাকা‌। আর আগুন লাগার পর প্রতিবারই আলোচনায় আসে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের কথা।

প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২২ সালের আগে স্থানান্তর না হলে তার আগপর্যন্ত কীভাবে চলবে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম? কী ধরনের নজরদারি বা সতর্কতা নেওয়া হবে? কারা করবেন তদারকি?

অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হোক

‘এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। শুরু হয় লোক দেখানো অভিযান।’ বলছিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মনিটরিংয়ের অভাব, নানা সিদ্ধান্ত কার্যকর না করা এবং সর্বোপরি এসব মৃত্যুগুলোকে আমলে না নেওয়ার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।’

ইকবাল হাবিব আরও মনে করেন, ‘পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে কাদের কারণে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে বা কার্যকর হয়নি তা বের করা হোক। মৃত্যুর দায় কে, কীভাবে বহন করবে, ক্ষতিপূরণ কী করে দেওয়া হবে, এসব বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হতে পারে।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক মুন্সীগঞ্জের প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলেই রাস্তা, ড্রেন-কালভার্ট করে প্লট করা হবে। এরপরই বরাদ্দ দেওয়া যাবে। কাজ শেষ হতে ২০২২ সালের জুন লেগে যাবে। শিল্পনগরী সম্পন্ন হওয়ার পর একটি নীতিমালা হবে বলেও জানান তিনি।’

স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রণালয় কী ধরনের নজরদারি রাখবে এমন প্রশ্নে এই প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দেয়। আমরা অবকাঠামোর দিকগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন- বিশেষ করে তারাই এসব নজরদারি করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমি শুধু ব্যবসায়ীদের বলতে পারি নিরাপত্তা জোরদার করতে। আবাসিক এলাকায় যেন গোডাউন বা দোকান না বানায় সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছি। অফিশিয়ালি এসব দেখভালের দায়িত্ব বিসিকের নয়।’

তালিকা করতে হবে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেমিক্যাল আমদানি থেকে মজুদ কোনও ব্যক্তির পছন্দের ওপর নির্ভর করবে না। এতে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। সরকারকে এখন প্রায়োরিটির ভিত্তিতে কেমিক্যালের বিষয়ে নজর দিতে হবে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও দেখভালে বেশ কয়েকটি সংস্থা জড়িত। একটি ঘটনা ঘটলে শোনা যায় গোডাউনের ট্রেড লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স নেই বলে কি ওরা পার পেয়ে যাচ্ছে? লাইসেন্স ছাড়া ওরা অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা চালাচ্ছে কী করে?’

তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় বৈধ-অবৈধ কী পরিমাণ কেমিক্যাল গোডাউন এবং ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে, জরিপ চালিয়ে সেটার তালিকা করতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া তো আমদানি সম্ভব নয়। আমদানিকারক ও মজুদকারী কারা এ বিষয়ে নজর দিলেও ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্থানান্তর প্রক্রিয়া কেমন হবে, কীভাবে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কী করে সরানো হবে সে বিষয়গুলোও তালিকা করে সম্পন্ন করতে হবে। জনসচেতনতাও বড় একটি বিষয়। ব্যবসায়ীদের অসচেতনতাও বড় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। কোন রাসায়নিকের ক্ষেত্রে কেমন সতর্কতা রাখতে হবে, বিস্ফোরকের ব্যাপকতা কেমন সে সম্পর্কে যদি জনসাধারণ অবহিত থাকে তবে তারাও কেমিক্যাল আছে এমন বাসাবাড়িতে থাকার বিষয়ে সতর্ক হবে।’

ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, ‘মুসা ম্যানশনের ভাড়াটিয়ারা কিন্তু শিক্ষিত। তারপরও তারা এটা জানতেন না যে কী ধরনের কেমিক্যাল তাদের বাসার নিচে মজুদ রয়েছে। এগুলোতে সামান্য আগুন লাগলেও কতো বড় আকারে তা ছড়াতে পারে। কী ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে। ভাড়াটিয়ারা এসব জানলে কিন্তু এলাকা ছেড়েই চলে যাবে। এতেও প্রাণহানির ঘটনা কমবে।’ এক্ষেত্রে জাতীয় রাসায়নিক সমন্বয় কমিটি গঠনের কথাও বলেন তিনি।

কেউই লাইসেন্স দেয় না!

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার কর অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫ এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউনের সন্ধান পাওয়া গেছে। কেমিক্যাল-এর ধরন ও ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় মাঝারি আকারের ঝুঁকিতে থাকা গোডাউনের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ০.৫ শতাংশ, নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ ১.৫ শতাংশ। এসব তথ্য জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছে ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা।

ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে কোনও অনুমতি ছাড়াই কিভাবে এসব দ্রব্য আমদানি হয়, কীভাবে গুদামজাত হয় ও কীভাবে ব্যবসা চলে আসছে? দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতোক্ষণ না কাজ না করবে ততোক্ষণ সমস্যা রয়ে যাবে।’

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেমিক্যালের লাইসেন্স দেওয়ার সংখ্যা আমাদের অনেক কম। প্রজ্জ্বলনীয় দাহ্য পদার্থ নিয়ে যে আইন রয়েছে, পেট্রোলিয়াম বিধিমালা অনুসারে আমরা কিছু এনওসি এবং মজুদ করার লাইসেন্স দিই। এ ছাড়া অন্যান্য কেমিক্যালের লাইসেন্স আমরা দিই না। বেশিরভাগই দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া মাধ্যমে দায়িত্বরত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কিংবা মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তারা তাদের আওতাভুক্ত কেমিক্যালগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকেন।’

তিনি বলেন, লাইসেন্স দেওয়ার পর মনিটরিংয়ের সুযোগ আমাদের কম। কোনও ব্যবসায়ী যখন আবেদন করেন, সেই সময় আমরা কাগজপত্র ও অবকাঠামো যাচাই করে লাইসেন্স দিই। লাইসেন্স দেওয়ার পরে মনিটরিংয়ের তেমন সুযোগ থাকে না। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকায় কিন্তু আমাদের কোনও লাইসেন্সই দেওয়া নেই।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২২ সালে স্থানান্তরের আগপর্যন্ত আমাদের ব্যবসা পরিচালনা প্রক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে এখনও নির্দেশনা পাইনি। আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডের পরই কেমিক্যাল গোডাউনগুলোতে অভিযান শুরু হয়। সরিয়ে ফেলতে বলা হয় গুদাম। কিন্তু কোথায় সরানো হবে তা কেউ বলে না। এখন শুনতে পাচ্ছি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আবারও অভিযান হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক জাতীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদির লাইসেন্স মিটফোর্ড এলাকায় দেওয়া হয় না। এসবের জন্য নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে কিছু কিছু গোডাউন আছে। আমরা ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে কমিটি করে দিয়েছি। যারা অবৈধ উপায়ে ব্যবসা চালাচ্ছে তাদের বিষয়ে নজরদারি রাখছি।’

/এফএ/
সম্পর্কিত
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
সর্বশেষ খবর
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়