লকডাউনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আগের চেয়েও বেশি পরিমাণে দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। প্রতিদিন বানের স্রোতের মতো আসছে ইয়াবা। এরইমধ্যে বেশ কিছু ইয়াবার চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা জব্দ করলেও ধারণা করা হচ্ছে এগুলো দেশে প্রবেশ করা চালানের সামান্য অংশ। প্রতিদিনই এই মাদকদ্রব্যের বড় বড় চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ইচ্ছেকৃতভাবে ছোট কোনও চালানের তথ্য দিয়ে ব্যস্ত রেখে তাদের সামন দিয়ে বা বিকল্প পথ দিয়ে পাচার হয়ে যচ্ছে বড় বড় চালান এমন অভিযোগও রয়েছে।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর কিছুটা অ্যাকশনে থাকলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য এই অপচক্রে জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা পাচারে সহযোগিতা করছেন এমন অভিযোগও আছে আলোচনায়। সম্প্রতি টেকনাফ সাবরাং মুন্ডার ডেইলঘাটস্থ সমুদ্র সৈকত থেকে খালাসের সময় ইয়াবার বিশাল একটি চালান লুটের ঘটনায় সবপক্ষের নাম পুলিশ জানার পরেও নিশ্চুপ হয়ে থাকায় এমন ধারণা আরও বড় হয়ে উঠছে। পৃথক ঘটনায় ধরা পড়েছেন তিনজন এপিবিএন সদস্যও।
দেশে ইয়াবা পাচারের প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট হচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তবর্তী ৩০টিরও বেশি পয়েন্ট দিয়ে পাচার হয়ে আসছে ইয়াবার চালান। এসব পয়েন্টে দেড় হাজারেরও বেশি লোক ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। এ কারণে এসব ইয়াবা কারবারিদের চিহ্নিত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইয়াবা কারবারি ও গডফাদারদের তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় কিছু কিছু কারবারি পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও আত্মসমর্পণের নামে বেশিরভাগ ইয়াবা কারবারি প্রথমে কারাগারে ও পরে ছাড়া পেয়ে যায়। এসব ইয়াবা কারবারিরা জামিনে বের হয়ে ফের ইয়াবা কারবারে নেমেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থামাতে গত ১৪ এপ্রিল সরকার লকডাউন ঘোষণার পর কক্সবাজারের জেলা পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা কাজে ব্যস্ততার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইয়াবা পাচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কারবারিরা।
গত ১৪ এপ্রিল লকডাউনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে কোটি টাকার ইয়াবা। এরপর ১৭ এপ্রিল ইয়াবা পাচারের সময় চকরিয়া থানা পুলিশ এক রোহিঙ্গা যুবকের পেট অপারেশন করে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের ইয়াবা উদ্ধার করে। একইভাবে গত ২১ এপ্রিল উখিয়া থানা পুলিশ ইয়াবাসহ ৪ জন কারবারিকে আটক করে। ২২ এপ্রিল উখিয়ার অন্যতম শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আলী আকবরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ২৩ এপ্রিল টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ তিনজন চোরাকারবারিকে গ্রেফতার করে বিজিবি। একইদিন ৭ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ টাকাসহ আরেক নারী ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করে উখিয়া থানা পুলিশ।
আরও জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল ইয়াবাসহ উখিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় দুই ইয়াবা কারবারি। সবচেয়ে বেশি ইয়াবা উদ্ধার হয় গত ২৮ এপ্রিল। এদিন টেকনাফের উনছিপ্রাং থেকে বিজিবির সদস্যরা ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। একইদিন উখিয়া থানা পুলিশ নারীসহ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ইয়াবাসহ ৩ জন। কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের কর্মচারীকে আটক করে। টেকনাফ থানা পুলিশ ইয়াবাসহ দুইজন অটোরিকশাচালককে ইয়াবাসহ এবং উখিয়া থানা পুলিশ ৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক যুবককে গ্রেফতার করে। গত ২ মে সবচেয়ে বেশি ইয়াবার চালান উদ্ধার করে সীমান্তরক্ষী বিজিবি। এদিন টেকনাফের চৌধুরীপাড়া চিতা পয়েন্টে অভিযান পরিচালনা করে আড়াই লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।
এদিকে ইয়াবা কারবারিদের পাশাপাশি কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। গত ২২ এপ্রিল রাতে উখিয়ায় ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন এপিবিএন-এর তিন সদস্য।
এরা হলেন, উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮নং এপিবিএনের এসআই সোহাগ, কনস্টেবল মিরাজ ও কনস্টেবল নাজিম।
সীমান্তে উদ্বেগজনক হারে ইয়াবা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খামখেয়ালিপনায় বেড়েছে ইয়াবা পাচার। প্রতিদিন মিয়ানমার সীমান্তের অর্ধ শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে বানের স্রোতের মতো আসছে ইয়াবা। শুধু স্থলপথ নয় সমুদ্রপথেও আসছে ইয়াবার বড় চালান। এসব ইয়াবা চালান মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও ইয়াবার বড় চালানগুলো কৌশলে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেন, ‘ইয়াবা কারবার এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে যে হারে ইয়াবা আসছে এতে মনে হয় বাধা দেওয়ার মতো কোনও লোকই নেই। টেকনাফে থেকে আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিরা অধিকাংশই জামিনে মুক্ত হয়েছে। তারা আবারও তাদের পুরনো পেশায় ফিরেছে। তারা নতুন করে জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা কারবারে। তারা দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও তাদের ইয়াবা কারবার চলমান ছিল। তবে বের হয়ে পুরোদমে ফের শুরু করেছে এই মাদকের ব্যবসা।’
টেকনাফের উনছিপ্রাং এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক তাহের নঈম জানান, ‘সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ইয়াবাপাচার। সীমান্তে নিয়োজিত সীমান্ত বাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা আসছে বানের স্রোতের মতো। বিশেষ করে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের অভিযান শিথিল হওয়ার সুযোগ নিয়েছে চোরা করবারিরা। আত্মসমর্পণকারী ও বিদেশ ফেরত কারবারিরা এলাকায় ফিরে এসে কোমর বেঁধে নেমেছে ইয়াবা কারবারে।’
কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোমেন মণ্ডল জানান, ‘মিয়ানমার সীমান্ত ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট দীর্ঘদিন থেকেই। কিছুদিন ইয়াবা পাচার নিয়িন্ত্রণে থাকলেও বর্তমানে তা ব্যাপকহারে বেড়েছে। এজন্য আমাদের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনবল সংকট হলেও আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কিছু ইয়াবা জব্দ করেছি। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’
ইয়াবা পাচারের কাজে কক্সবাজারের কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে সঠিক মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহারকারী গ্রাহকদের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, ডাটাবেজ সংরক্ষণ, ছবি, স্ক্যানিংসহ সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিদিন নজরদরি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ইয়াবা পাচারকাজে স্থানীয় নারী-পুরুষ শরীরের বিশেষ কায়দায় পাচার, যানবাহনসহ নানা কৌশলে ইয়াবা বহনের কারণে পাচাররোধ কঠিন হয়ে পড়েছে। ইয়াবা পাচাররোধে জনসচেনতার কোনও বিকল্প নেই।’
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ‘চোরা কারবারিরা তো সবসময় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। সেইসঙ্গে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর। এ কারণে এসব ইয়াবা কারবারিরা প্রতিদিন ইয়াবাসহ ধরাও পড়ছে পুলিশের হাতে। আত্মসমর্পণকারীরা জামিনে মুক্ত হয়ে ফের ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ছে কিনা তা কড়া নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ। তাই, এসব কারবারিদের ধরতে সব সময় পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে সম্প্রতি টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং মুন্ডার ডেইল ঘাট পয়েন্টে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের দুই বস্তা ইয়াবা লুটের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট ওই ঘাট দিয়ে নিয়মিত ফিশিং বোটে করে মাছ শিকারের আড়ালে ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করে আসছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মিয়ানমার হতে ইয়াবার একটি বড় চালান আসার সংবাদে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কৌশলে অবস্থান নেয়। এরপরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে ইয়াবার চালানটি খালাস চলছিল। তবে সেই মুহূর্তে সেটি লুট করে নিয়ে যায় আরেকটি পক্ষ।
শোনা গেছে, ইয়াবার বড় চালানটি এনেছিল শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণ পাড়ার নুরুল হাকিম মাঝির ছেলে জাফর আলম। তবে এ চালানটি খালাস ও নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সাবরাং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন দানুর। তবে ওই এলাকার ইব্রাহীম, আব্দুর রহিম, ফজলুর রহমান প্রকাশ ফজরানসহ বেশ কয়েকজন এসে চালানটি লুট করে নিয়ে যায় বলে একটি সূত্র দাবি করেছে। ওইদিন মিয়ানমার থেকে ফিশিং বোটে করে ইয়াবার বড় চালানটি নিয়ে আসে আনোয়ার মাঝির নেতৃত্বে মো. আলম, কাদির ও রশিদ উল্লাহ। আশ্চর্য হওয়ার বিষয় যে দুই পক্ষের নাম স্থানীয় পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃ ঙ্খলা বাহিনী অবগত ও দুয়েকদিন তৎপরতা দেখালেও এ ঘটনায় ইয়াবাগুলো আটক তো দূরের কথা, কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি।