X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে বাড়ি ফেরার পক্ষ-বিপক্ষ

আনিস আলমগীর
১১ মে ২০২১, ১৪:১৮আপডেট : ১১ মে ২০২১, ১৫:২২

আনিস আলমগীর ঈদে বাড়ি ফেরা বাংলাদেশের এক আদি বিড়ম্বনা। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা অন্যান্য বড় শহরের মানুষগুলোর বেশিরভাগের এখনও আদি ঠিকানা গ্রাম কিংবা কোনও ছোট শহরে। বছরের দুই ঈদ এলে তাই তাদের বেঁধেও আপনি শহরে রাখতে পারবেন না। যতই বিড়ম্বনা হোক, সড়ক দুর্ঘটনা হোক। এই শহর তাদের টানে না. আবার গ্রাম তাদের কর্মসংস্থানের, সন্তানের শিক্ষা লাভের, চিকিৎসা, নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। তাই তারা আসা এবং যাওয়ার মধ্যে আছেন। অনেকে বাধ্য হয়েই তা করছেন। স্বল্প আয়, তবু পরিবার নিয়ে শহরে থাকতে চান।

আবার একটা শ্রেণি আছে ব্যাচেলর জীবনযাপন করে শহরে। মেস জীবনে ঢাকা শহর তাদের কাছে মরুভূমির মতো। আবার বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলর জীবনে আছেন অনেকে। তাদের পরিবার থাকে গ্রামে। মা-বাবার সঙ্গে দেখা, স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে দেখা, কিংবা গার্মেন্টসের যে নারী সন্তান রেখে এসেছেন মা কিংবা শাশুড়ির কাছে, তারও ছুটতে হয় ঈদে, আদি গন্তব্যে। সে কারণে আমরা দেখি লঞ্চ, বাস, ট্রেনে উপচে পড়ছে মানুষ। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো এরা ছোটে। সড়ক-মহাসড়কে ঘরে ফেরা মানুষের স্রোত নামে। কারও সাধ্য নেই এদের আটকানোর। এই তথাকথিত শহুরে জীবন তাদের ছুটি কাটানোর উপায় শেখাতে পারেনি। পিছুটান, দুই জীবন থেকে মুক্তি দেয়নি। তাই ঈদ এলে কোনও প্রতিবন্ধকতা তাদের আটকাতে পারে না গ্রামে ফেরা থেকে।

করোনার মধ্যে এবার তৃতীয় ঈদ উদযাপনেও তা-ই হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে মানুষ বাড়ি ফিরছে। মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন বন্ধ থাকায় বিকল্প উপায়ে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, পিকআপ, মোটরসাইকেলসহ ছোট ছোট যানবাহনে চড়ে যাচ্ছেন তারা। পথে পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যারিকেড ও দিনে ফেরি চলাচল সীমিত রেখেও এদের আটকানো যায়নি। উল্টো তাদের উপচে পড়া চাপে ফেরির সংখ্যা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন। জরুরি পরিষেবার জন্য চালু রাখা ফেরিতে গাড়ির বদলে গাদাগাদি করে মানুষ যেতে দেখা গেছে।

এই ঘরে ফেরা মানুষদের নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের মধ্যেও গোঁজামিল রয়ে গেছে। দেখা গেছে সিদ্ধান্তহীনতা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলার অভ্যন্তরে বাস চলাচল করলেও আরেক জেলায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু সবাই দেখছে বারবার যানবাহন পরিবর্তন করে ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। আবার ফেরি চালু আছে। এর কারণে তাদের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তেমনি গুনতে হচ্ছে চার পাঁচগুণ বেশি ভাড়া।

আর স্বাস্থ্যবিধির কথা কী বলবো! দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভার্সন চলে এসেছে। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা এখনও সন্তোষজনক হারে নেমে আসেনি। কিন্তু এই বাড়ি ফেরা মানুষগুলোর যাত্রা যেমন নিরাপদ, দুর্ভোগহীন করার কোনও প্রচেষ্টা নেই তেমনি তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতেও দেখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ঈদের পরে আমাদের দেশের অবস্থাও ভারত ও নেপালের মতোই ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেছেন, পাশের দেশ ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। এই ভ্যারিয়েন্ট এখন আমাদের দেশেও চলে এসেছে।

বাড়িফেরা নিয়ে সতর্ক করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনে গ্রামের বাড়ি যেতে ছোটাছুটি না করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এতে আপনজনের জীবনই হুমকির মুখে পড়বে। একটা ঈদে কোথাও না গিয়ে নিজের ঘরে থাকলে কী ক্ষতি হয়? আপনারা ছোটাছুটি না করে যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকেন। সেখানেই নিজের মতো করে ঈদ উদযাপন করুন। আমি জানি ঈদের সময় মানুষ পাগল হয়ে গ্রামে ছুটছেন। কিন্তু আপনারা যে একসঙ্গে যাচ্ছেন, এই চলার পথে ফেরি বা গাড়ি যেখানে হোক কার যে করোনাভাইরাস আছে আপনি জানেন না। কিন্তু আপনি সেটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার পরিবারের কাছে। মা-বাবা, দাদা-দাদি যেই থাকুক আপনি তাকেও সংক্রমিত করবেন এবং তাদের জীবনও মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেবেন।’

সবার কথাই যুক্তিযুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর কথাও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু ঈদ উৎসবের ঠিক আগে আগে এসব বলে লাভ কী! তাদের ঘরে ফেরা থেকে নিরুৎসাহিত করতে কতটা মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছি আমরা। সরকার লকডাউনের মধ্যে দোকানিদের অনুরোধে দোকান খুলে দিয়েছে। কেনাকাটার স্রোত বইছে সেখানে। এর সিংহভাগ ক্রেতাই হচ্ছে ঈদে বাড়ি ফেরার দল। তারা জামা-কাপড় কিনে নিয়েছে, বাজার সওদা করেছে, বাড়ি যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে- সংযমী কীভাবে হতে পারে! ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পায়ে হেঁটে, পানিতে নেমে হলেও ছুটছে গ্রামের দিকে। আবার দুদিন পর একইভাবে শহরে আসার হাঙ্গামাতে যোগ দিবে তারা।

এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে এই বাড়ি ফেরার পক্ষে-বিপক্ষে। চলে এসেছে যথারীতি ধনী-গরিবের সস্তা সেন্টিমেন্ট। কারও কারও প্রশ্ন- আপনি ধনীদের প্রাইভেট কারে, বিমানে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে গরিব কেন তার প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাবে না ঈদে? শুনতে খুবই যৌক্তিক মনে হবে কিন্তু প্রাইভেট কার আর উড়োজাহাজে স্বাস্থ্য সুরক্ষা যেভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে, নিম্ন আয় কিংবা মধ্যবিত্তের ঘরে ফেরার মধ্যে সেটা কি নিশ্চিত করা যাচ্ছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, যাচ্ছে না। তাহলে উপায় কী– গণতান্ত্রিক দেশে বাড়ি ফেরার অধিকার তো সবার আছে। ধনী বাড়ি যাবে, তার গাড়ি চলবে কিন্তু এই নগরে যারা রিকশা চালাচ্ছে, বাসা বাড়িতে কাজ করছে, গার্মেন্টস কর্মী কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছে, চাকরি করছে- তারা বাড়ি যাবে কীভাবে! লকডাউনে সবই চলছে, গণপরিবহন চলছে না, ফেরি বন্ধ- এটা কি কেবল গরিবকে বাড়ি যেতে না দেওয়া! ধনীদের ট্রল করছি না কিন্তু গরিবরা গাদাগাদি করে ফেরিতে যাচ্ছে- তাদের নিয়েই শুধু ট্রল চলবে?

এই বিতর্কে দুপক্ষের ঝাঁঝালো যুক্তি আছে। কিন্তু সমাধান কী? তার স্পষ্ট নির্দেশনা এবং বাস্তবায়ন নেই। চলমান লকডাউনের কারণে আক্রমণের তীব্রতা কমে এসেছে, ঈদযাত্রার পরে বুঝা যাবে কতটা নির্বুদ্ধিতা মানুষ দেখিয়েছে নাকি একমাত্র আল্লাহ তাদের সহায় ছিল। ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে এটা ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। যে যত কথাই বলুক, দিনশেষে দায় আসবে সরকারের ঘাড়ে। করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। এখন যারা অধিকার, গণতন্ত্র, ধনী-গরিব প্রসঙ্গ তুলেছেন- তারা তখন দেখা দেবেন না। ঈদযাত্রা নিয়ে সরকারের সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল অনেক আগে থেকে। লকডাউন দিয়ে রাখাই শুধু সমাধান না।

অন্যদিকে, মহামারিতে চলাচল করলে কী পরিণতি হবে সবাই ভয় দেখাচ্ছি আমরা কিন্তু এটি যাদের কাছে পৌঁছানো দরকার, ইতিবাচক ম্যাসেজ হিসেবে প্রচার দরকার– সেই কাজটি সরকারি, বেসরকারি কোনও যন্ত্রই করতে পারেনি বলে আমার ধারণা। আইন না করলে, আইন অমান্যকারীকে সাজা না দিলে যেমন কোনও উদ্যোগের ফল আসে না, তেমনি বিষয়টি যে তাদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে সেই বার্তাটিও পৌঁছানো দরকার। করোনা আক্রমণের শুরুতে যে সচেতনতার বার্তা প্রচারিত হয়েছে, লক্ষ করা গেছে– এখন তা চোখে পড়ছে না। অথচ সামনে এর ভয়াবহতা আরও তীব্র হবে বলেই সবাই আশঙ্কা করছেন।

সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ হোক নিরাপদ এবং আনন্দময়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ