X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষমা করো ভাই, ক্ষমা করো বোন

জয়া আহসান
১৩ মে ২০২১, ১৯:১৬আপডেট : ১৪ মে ২০২১, ১৬:৩৪

জয়া আহসান অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে যা হলো, তাতে হেঁট হয়ে গেলো মাথা। কী করেছিলেন চঞ্চল? মায়ের সঙ্গে তোলা তাঁর একটা ছবি মা দিবসে আপলোড করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাতে দোষ কী হলো? না, মাথায় সিঁদুর লাগানো চঞ্চলের মায়ের সুন্দর মুখশ্রীটি আগুন লাগিয়ে দিলো অনেকের মনে। ধর্মের পরিচয়ে কেন তিনি সংখ্যাগুরু আমাদের মতো নন, অনেকের মনের এই জ্বালায় নোংরায় ভরে গেলো চঞ্চলের ফেসবুক।

সেসব দেখতে দেখতে আমি শুধু ভাবছিলাম, এরপর মুখোমুখি হলে ওকে আমি মুখ দেখাবো কী করে? মাথাটা নিচু হতে হতে মাটির সঙ্গে লেগে যায় আমার- বাঙালি হিসেবে, মুসলমান হিসেবে, মানুষ হিসেবে। বাঙালি হিসেবে, কারণ এমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠার জন্যই তো আমরা রক্ত দিয়েছিলাম, যেখানে আমার অন্য ধর্মের ভাইটি-বোনটিও আমারই মতো মুক্তভাবে তার বিশ্বাস চর্চা করবে।

মুসলমান হিসেবে, কারণ এরাই সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে মন্দ ধারণা দিচ্ছেন। সুরা হুজুরাতে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বলেছেন, ‘কোনও পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো হতে পারে। আর কোনও নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। আর তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না।’ এই পৃথিবীকে সৃষ্টিকর্তা ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য অপার করে দিয়েছেন। সবাইকে এই প্রকৃতির সম্পদে অবাধ প্রবেশাধিকার দিয়েছেন। তাদের মাথার ওপরেও তিনি ছায়া দিয়ে রেখেছেন। এই উপহাসকারীরা কি সৃষ্টিকর্তাকেও লঙ্ঘন করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে?

আর মানুষ হিসেবে, কারণ হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে সভ্যতার এত ফুল-ফল-ফসলের পরেও পৃথিবীর এই কোণে আমরা এখনও সভ্য হয়ে উঠতে পারলাম না।

শুধু চঞ্চলই নন, মা দিবসে অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনাও একই রকম নোংরা কটাক্ষের শিকার হয়েছেন। কেন? ভাবনার মায়ের পোশাক অপবাদকারীদের যথাযথ মনে হয়নি। এ রকম আরও আরও অনেকে।

ক্ষমা করো, ভাই। ক্ষমা করো, বোন।

মুখ খিস্তি করে আর নর্দমা থেকে শব্দ তুলে লিখে মানুষকে অপদস্থ করার নতুন একটা যুগ শুরু হয়েছে যেন। এর বড় এক সাম্রাজ্য ইন্টারনেট। আর তার মহাসড়ক হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। অডিও-ভিডিও-টেক্সটে আপনি আপনার কুৎসার ভরা ঝাঁপি নিয়ে সেই সড়ক ধরে যে কারও অন্দরমহলে পৌঁছে যেতে পারেন। যিনি অনেক সাধনায় মর্যাদার একটা আসন তৈরি করেছেন, তাঁর দিকে শুধু নোংরার ঢিলটি ছুড়ে দিলেই আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুক্ষণের বিজয়ী। শয়তানের বিজয় মুকুট আপনারই প্রাপ্য, কারণ তাঁর মতো কঠিন পথে হেঁটে আপনি অর্থপূর্ণ কোনও মর্যাদার দিকে যেতে চাননি।

কিন্তু এই সাইবার বুলিইং কত যে নীরব রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে মানুষের মনে মনে। কিশোরী মেয়েদের আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনার কথাও আমরা শুনেছি। একটা জায়গায় পড়লাম, এই সাইবার বুলিইংয়ের শিকার মূলত মেয়েরা, দশ জনের মধ্যে আট জন। প্রধান শিকার অল্প বয়সের মেয়েরা, যারা পৃথিবীটাকে এখনও সামাল দিতে শেখেনি। যা সব নিয়ে সাইবার বুলিইং হয়, তার বিষয়গুলোও মোটামুটি এ রকম—ধর্ম, পোশাক, জীবনযাপন, যৌনতা। যারা সাইবার বুলিইং করে, তাদের বেশিরভাগও আবার কিশোর-তরুণ-যুবক। অনেকে আছে নারী–ছদ্মবেশী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা ঠিক মূল্যবোধ শেখাতে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি না তো?

আমি নিজে নেট-নাগরিক। আমার নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বোলালেই আমি এটা টের পাই। আমার নিজের ধারণা, সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই বুঝে নেওয়া সম্ভব জাতি হিসেবে কে কতটা সভ্য হয়ে উঠতে পেরেছি। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ঢুকলে গায়ে পাঁক নিয়ে উঠে আসতে হয়। একবার এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, আমার ফেসবুকে ওঁৎ পেতে আছে অগুনতি সম্ভাব্য ধর্ষক। অভিনয়কে আমি আমার নিয়তি হিসেবে বরণ করে নেওয়ার পরপরই নিজের পথ স্থির করে নিয়েছিলাম। মেয়েরা সফল হলে সেটি যে তার নিজেরই যোগ্যতায় হতে পারে, আমরা এখনও সেটি ভাবতে শিখিনি। আমরা ধরে নিই, তার সফলতা এসেছে সহজ কোনও পথে। তাই আমি জানতাম, আমার কিছুমাত্র যদি সাফল্য আসে, তার সঙ্গে কটু কথাও আসবে চারপাশ থেকে। সেদিকে আমি ফিরেও তাকাবো না। যারা কটুকাটব্য করেন, নিজেদের নোংরায় তারা নিজেরাই সয়লাব হয়ে থাকুক। কিন্তু কোমলমতি যারা, তারা নিজেদের কীভাবে বাঁচাবে?

মানুষের বাসনার শেষ নেই। সভ্যতার শিক্ষা সে বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ বা রূপান্তরিত করা। শিক্ষা, সংস্কৃতি আর খেলাধুলার চর্চা ছাড়া মনে হয় না আমরা আদৌ সেখান থেকে বের হতে পারবো। কিন্তু এটা তো দীর্ঘ একটা পথ। সেখানে পৌঁছানোর আগে কী হবে?

শুনেছি, সাইবার বুলিইং দেখার জন্য পুলিশের একটা সেল আছে। আমরা তাদের নতুন করে ভাবতে অনুরোধ করি। আরও সক্রিয় হতে আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের স্পর্শকাতর সমাজে বুকের পাটা বড় করে কয়টি মেয়ে সেখানে অভিযোগ করতে যাবে? পুলিশের সাইবার বুলিইং সেল নিজেই কি উদ্যোগী হয়ে দেখানোর মতো কিছু করতে পারে না? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যেকোনও নারী তারকার ফেসবুকই হতে পারে তাদের প্রথম টেস্ট কেস।

দোহাই, অন্তর্জালের চোরাবালি থেকে অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচান।

লেখক: অভিনয় শিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ