X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাক্রান্ত ভয়ংকর জীবনের গল্প

আমি জানি নিশ্বাস নেওয়ার মূল্য: কাজী হায়াৎ

ওয়ালিউল বিশ্বাস
১৬ মে ২০২১, ১৫:৩৯আপডেট : ১৬ মে ২০২১, ১৮:৪৬

বাংলা চলচ্চিত্রের বিদ্রোহী নির্মাতা ধরা হয় কাজী হায়াতকে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার মতো সফল ছবি আর কেউ দিতে পারেননি। জীবনঘনিষ্ঠ সচেতনতামূলক সিনেমাই বেশি এসেছে তার কাছ থেকে। ১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ ছবিটি পরিচালনার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। ৪০ বছর পর ২০২০ সালে তৈরি করেছেন তার ৫০তম চলচ্চিত্র ‘বীর’। সিনেমার এই পরিভ্রমণে বরাবরই দৃপ্ত পদচারণা তার। চলচ্চিত্রের বাইরেও সাম্প্রতিক খবরের শিরোনাম হন করোনাক্রান্ত হয়ে। ফিরেছেন আইসিইউ থেকে। যম-ডাক্তারের এই টানাপড়েন জীবন-পর্দায় দেখেছেন নির্মাতা। জানালেন, এক অসহায় দর্শক হয়ে জীবনের কঠিন ক্লাইমেক্স উৎরে এসেছেন তিনি। সবাইকে সচেতন করতে সেই গল্পটাই জানালেন বাংলা ট্রিবিউন পাঠকের কাছে-

বাংলা ট্রিবিউন: চারদিকে একটা খবর রটেছিল, জীবনের এতটা পথ হেঁটে আপনি এখন খুব ক্লান্ত। করোনার ধকল আপনাকে স্থির করে দিয়েছে। নির্মাণ করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আদৌ কতটুকু সত্য?

কাজী হায়াৎ: দেখুন, আমি নিজে অসুস্থ। দেশে করোনা। কবে সুস্থ হবো, কবে ভালো হবো, দেশ কবে সুস্থ হবে, সিনেমা হল কবে খুলবে- এগুলো সবই তো অনিশ্চিত। তাই আমার ফেরাটাও অনিশ্চিত। তার মানে এই নয় যে আমি এখনই বিদায় বলেছি। আপাতত কাজ করছি না বা করতে পারছি না। এটাই স্বাভাবিক।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি যখন করোনায় আক্রান্ত হলেন, তার কয়েক দিন তো বেশ ভালোই ছিলেন। হঠাৎ আপনাকে আইসিইউতে নেওয়ার খবর এলো।

কাজী হায়াৎ: ২ মার্চ টিকা নিলাম। ৬, ৭, ৮ তারিখে ভালো, তবে হালকা জ্বর ছিল। ৯ তারিখ ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষা করলাম। সেদিন সন্ধ্যায় তারা জানালো আমি পজিটিভ।

তখনও আমি ভালো। আমার বোনের স্বামী ডাক্তার। তার পরামর্শে আমি ওষুধ খেতে লাগলাম। সে আমাকে বললো, ‘দাদা, সবই ভালো আছে, কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতি দ্রুত খারাপও হতে সময় লাগবে না। তখন হয়তো আমি কিছুই করতে পারবো না। তাই একটা হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ভালো হবে।’

মারুফ শুনে দ্রুত টিকিট কাটলো। সে তখন আমেরিকায়।

প্রত্যেকটা মানুষের কাছে অনুরোধ এই মহামারিতে যেন বাসা থেকে অপ্রয়োজনে বের না হয়। কারণ, আমি অনুভব করেছি এই মৃত্যুটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। নিশ্বাস নেওয়ার যে কষ্ট তা বলে বোঝনো যাবে না।

আর আমার মেয়েটা জোর করে আমাকে নিয়ে গেলো পপুলার হাসপাতালে। সেখানেও প্রথম দিন ভালো। দ্বিতীয় দিনে অক্সিজেন লাগলো। তৃতীয় দিনে এর পরিমাণ এক সিলিন্ডারে কুলালো না; দুইটা লাগলো। মনে হচ্ছিল, গলার মধ্যে কী যেন আটকে আছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় এই মুহূর্তে মারা যাবো। আমি বাথরুমে যেতে পারছিলাম না। সামান্য একপাশ থেকে ওপাশ হবো সে অবস্থা নাই। এক মহিলা ডাক্তার এক্সরে দেখে বললেন, এখনই ওনাকে আইসিইউতে নিতে হবে। সেখানে যাওয়ার পর ওরা বলল, ৫৫ শতাংশ ফুসফুস ড্যামেজ, ২৫ লিটার অক্সিজেন লাগবে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো অনেক আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। ছেলে কাজী মারুফ যদি না আসতো বা মেয়ে যদি হাসপাতালে না নিতো, আপনি সম্ভবত হাসপাতালেও যেতেন না।

কাজী হায়াৎ: হ্যাঁ, সেটা ঠিক। আমার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস ছিল আমি তো ভালো আছি। এ অসুখে আক্রান্ত হয়েও টের পাওয়া যাওয়া যায় না সে কতটা অসুস্থ। জীবন একটা, মৃত্যুও একবার হবে। তবু প্রত্যেকটা মানুষের কাছে অনুরোধ এই মহামারিতে যেন বাসা থেকে অপ্রয়োজনে বের না হয়। কারণ, আমি অনুভব করেছি এই মৃত্যুটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। নিশ্বাস নেওয়ার যে কষ্ট তা বলে বোঝনো যাবে না।

বাংলা ট্রিবিউন: ঠিকই হয়তো এটা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু তারপরও কি কিছুটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন?

কাজী হায়াৎ: এটা সম্ভব নয়। তবু একটা উদাহরণ দিই। মনে করুন, আমি এক গ্লাস পানি পান করবো। একটা ঢোক নিতে গেলাম, সেটা গিলতে ফিরতি একটা নিশ্বাস নিতে হয়, সেটা নিতেই যে কষ্ট ও শক্তি লাগে তা অবর্ণনীয়। হয়তো করোনা আক্রান্ত না হলে এই ছোট-আধা পরিমাণ যে শ্বাস নিতে হয়, সেটার কথা কোনও দিন চিন্তায় আসতো না।

সে গান গেয়ে তার টাকা দিতো এফডিসির এক্সট্রা এক মেয়েকে। সেই মেয়েটির কন্যার একদিন করোনা হলো। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় ছেলেটি। মেয়েটি ভালো হয়, কিন্তু ছেলেটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যায়। ছেলেটা আর ভালো হয় না।

বাংলা ট্রিবিউন: আইসিইউতে থাকার একটা পর্যায়ে আপনার একটা ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন মারুফ। তখন মনে হয়েছিল আপনি সুস্থের পথে। সেই সময় মাথায় কী ধরনের চিন্তা ভর করতো? কখনও কি মনে হয়েছে, এবার যদি বেঁচে যাই ‘অমুক’ কাজটি করবো?

কাজী হায়াৎ: আইসিইউতে একটা নার্স ও বয় সব সময় থাকতেন। তাদের কথাবার্তায় আমার মনে হয়নি আমি ফিরতে পারবো। তাই অন্য কোনও চিন্তা মাথায়ই আসেনি। নড়তে পারিনি, উঠতে পারিনি, বাথরুমে যেতে পারিনি। কী যে কষ্ট। তাই আমি বারবার বলতে চাই, এ দেশের গরিব মানুষের বাঁচতে হলে মাস্ক পরিধান করতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো যমের ঘর থেকে ফিরে এসেছেন। নিশ্চয়ই দেশ ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হবে। আপনিও কাজে ফিরবেন। তখন কি করোনা নিয়ে কোনও নির্মাণ ভাবনা আপনার মধ্যে আছে?

কাজী হায়াৎ: করোনা নিয়ে ভাবনা ছিল আমার। এর নাম ‌‘গুড মর্নিং’। এফডিসির একটা ছেলে গান গেয়ে টাকা সংগ্রহ করতো। গান গেয়ে বলতো, তোমরা ভয় পেয়ো না, একদিন সকাল হবে। একদিন এমন সকাল হবে যখন সারা বাংলাদেশে কোনও করোনা পেশেন্ট থাকবে না। সে গান গেয়ে তার টাকা দিতো এফডিসির এক্সট্রা এক মেয়েকে। সেই মেয়েটির কন্যার একদিন করোনা হলো। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় ছেলেটি। মেয়েটি ভালো হয়, কিন্তু ছেলেটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যায়। ছেলেটা আর ভালো হয় না। সেদিন হাসপাতাল থেকে শুনলো, আজ বাংলাদেশে কোনও করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। সে মনে মনে বললো, এই শুভ সকালটাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম। নার্সকে বলবে তাকে একটু বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সকালটা দেখবে! তাকে বাইরে নেওয়া হয়, আর ফিরতে পারেনি হাসপাতালে। মারা যায় ছেলেটা। সে-ই ছিল বাংলাদেশের শেষ করোনা পেশেন্ট।

ধরুন রাত ১২টায় আমি একটা মেয়েকে নিয়ে রিকশায় করে ফিরছি। সাংবাদিক তা দেখে লিখে দিলো, ‘যুবতী মেয়ের সঙ্গে মধ্যরাতে কাজী হায়াৎ’। কিন্তু সেই মেয়েটা আমার সন্তানও হতে পারে, আমার স্ত্রীও হতে পারেন। সাংবাদিক চোখের দেখাটা দেখছে, বা যারা যেটুকু দেখাচ্ছে, সেটুকুই দেখছে, গভীরে যাচ্ছে না।

বাংলা ট্রিবিউন: এটাই কি সিনেমায় আমরা পাবো? আপনি বানাতে চাচ্ছেন?

কাজী হায়াৎ: আমি চাইছিলাম। কিন্তু এখন আর চাই না। কোনও ফাইন্যান্সার আসেনি। কেউ প্রডিউসার হতে চায়নি। তাহলে আর বানাবো কীভাবে? সবাই নাচ-গানের ছবি করতে চায়। যদি সম্ভব হয় আমার বানানো ‘দি ফাইটার’ দেইখেন, ‘দিলদার আলী’ দেইখেন। একজন পরিচালকের কান্না আছে সেখানে। ওখানে টেলি সামাদকে দিয়ে পরিচালক বলাতে চেয়েছেন, ‘ও জুলিয়া প্রাণ খুলিয়া দে, একটু কোমর দুলিয়া দে, ওরা কমার্শিয়াল চায়।’ আমাদের চলচ্চিত্রে ভালো একটা মন নিয়ে এসেছিলাম। এক উদ্যমী যুবক (কাজী হায়াৎ) এসেছিল। যে ‘কাবলিওয়ালা’ বানাতে চেয়েছিল, কিছুই হয়নি। চলচ্চিত্রের যে অবক্ষয় হয়েছে, সমস্ত চলচ্চিত্র যে কোথায় নেমেছে, তা শুধু শুনে রাখুন, লিখবেন না।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার অফ দ্য রেকর্ড অনেক কথাই হয়তো ছাপানো হবে না। কিন্তু আপনি কেন বলতে চান না?

কাজী হায়াৎ: সাংবাদিকতায় কিছু দায়িত্ব থাকে, সেটা পালন করতে হয়। আমি বলেছি, বলছি- এগুলো দিয়ে দলাদলি হবে। কিন্তু সাংবাদিক লিখলে তা হবে না। আজকের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাও অন্যরকম হয়ে গেছে। ধরুন রাত ১২টায় আমি একটা মেয়েকে নিয়ে রিকশায় করে ফিরছি। সাংবাদিক তা দেখে লিখে দিলো, ‘যুবতী মেয়ের সঙ্গে মধ্যরাতে কাজী হায়াৎ’। কিন্তু সেই মেয়েটা আমার সন্তানও হতে পারে, আমার স্ত্রীও হতে পারেন। সাংবাদিক চোখের দেখাটা দেখছে, বা যারা যেটুকু দেখাচ্ছে, সেটুকুই দেখছে, গভীরে যাচ্ছে না। এভাবেই জায়গাটা খুব সস্তা হয়ে গেছে। তাই সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আপনি কি কখনও জ্যোৎস্না রাতে কুয়ার পাড়ে দাঁড়িয়েছেন? যদি দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকান, মনে হবে কেউ হয়তো পেছন থেকে আপনাকে ধাক্কা দেবে। পড়ে গেলেই শেষ। এক ধরনের অদৃশ্য ভয় আপনাকে গ্রাস করবে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ৫০তম চলচ্চিত্র ‘বীর’। যা ২০২০ সালে মুক্তি পায়। শোনা যাচ্ছে, বিছানায় শুয়ে দুর্বল শরীরেই আপনি আরও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছেন।

কাজী হায়াৎ: হ্যাঁ, আমার বিগত ৫০ সিনেমার অংশবিশেষ, গান ও বিভিন্ন ফেস্টিভালের দৃশ্য দিয়ে তৈরি হবে এই ছবি। করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর আমি যখন আইসিইউ থেকে বাসায় ফিরি তখনই এই চিন্তাটি মাথায় আসে। কারণ, এখনকার মানুষ ছোট ছোট অংশবিশেষ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। চলচ্চিত্রের বিশেষ অংশগুলো তারা বারবার দেখছে। সেই ভাবনা থেকেই আমার ছবির বিশেষ অংশ দিয়ে জার্নিটা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। করোনায় আমি এখনও বিছানায়। একটু সুস্থ হয়ে শুটিংয়ে অংশ নেবো।

বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের আলোচনার বড় একটি অংশজুড়ে করোনা ছিল। তাই শেষটাও করতে চাই এটা দিয়েই। আপনি চলচ্চিত্রকার। করোনার এই গ্রাসকে কীভাবে প্রকাশ করবেন?

কাজী হায়াৎ: আপনি কি কখনও জ্যোৎস্না রাতে কুয়ার পাড়ে দাঁড়িয়েছেন? যদি দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকান, মনে হবে কেউ হয়তো পেছন থেকে আপনাকে ধাক্কা দেবে। পড়ে গেলেই শেষ। এক ধরনের অদৃশ্য ভয় আপনাকে গ্রাস করবে।

সে ভয়টাই হলো করোনা। কিন্তু বাস্তবে করোনা আপনাকে সত্যি সত্যিই ধাক্কা দেবে। তখন সেই কুয়া থেকে কেউ উঠে আসতে পারে, কেউ পারে না। যারা পারে না, একবুক অসহ্য যন্ত্রণায় তাদের মৃত্যু হয়! আমি সেই একবুক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি! আমি জানি, শ্বাস নেওয়ার মূল্য, চোখ মেলে ধরতে পারার সার্থকতা! তাই সবার কাছে অনুরোধ, বাইরে গেলে মুখ থেকে মাস্ক নামাবেন না। বাসায় ফেরামাত্র সাবান দিয়ে হাত ধুবেন। এই দুটোই আমাদের মতো গরিব দেশকে বাঁচাতে পারে।

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা