X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যা ও কিছু প্রশ্ন

রুমিন ফারহানা
১৮ মে ২০২১, ১৭:৩৭আপডেট : ১৮ মে ২০২১, ১৭:৩৭

রুমিন ফারহানা মিতুকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা। আমার অবশ্য মিতুকে মনে রাখতে হয়েছে। কারণ, আমি সরকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বয়ানকে একেবারেই ফিকে করে দেওয়ার জন্য সাগর-রুনি, ত্বকী, তনু, রিশার সঙ্গে মিতুকেও অনেক সময়ই সামনে এনেছি।

মিতু হত্যার ভিডিও আমি প্রথম দেখি সামাজিক মাধ্যমে; অস্পষ্ট একটা ভিডিও, একটি মাত্র সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে উদ্ধার করা। ভোরবেলা ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দেওয়ার সময় তিন জন খুনি ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটি ঘটিয়ে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। ৫ বছর আগে ঘটা এই অতি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাসের মধ্যে মোটাদাগে তিনটি ন্যারেটিভ আমাদের সামনে আসে –

১. বাবুল আখতারের জঙ্গি, মাদক, দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে বিরাগভাজন ক্ষমতাশালীরা প্রতিশোধ নিতে মিতুকে খুন করিয়েছে।

২. স্ত্রীর ‘পরকীয়া’ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ বাবুল আখতার তাঁর নিজের সোর্স মুসার নেতৃত্বে তাঁর স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন।

৩. জঙ্গি তো বটেই, চোরাচালান এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে বহু রাজনীতিক এবং পুলিশের উপরওয়ালাদের বিরাগভাজন হয়েছেন বাবুল। তাই এখন জঙ্গির হাতে খুন হওয়া মিতু হত্যার দায় কৌশলে বাবুল আখতারের ওপর চাপিয়ে তাকে চাকরি থেকে সরানোর পাকা ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ঘটনাটি চাপাই পড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট মিতু হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি ৩১ জানুয়ারি ২০২১-এর মধ্যে জানাতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। আবার নড়েচড়ে বসে পুলিশ। এবার বেরিয়ে আসে একেবারে নতুন একটি কাহিনি।

হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর পর গায়েত্রী নামে এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার ঘটনার কথা জানান তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। গায়েত্রী ভারতীয় নারী, ২০১৩ সালে তিনি কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআর-এ কাজ করতেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে বাবুল আখতার কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকার সময় গায়েত্রী ইউএনএইচসিআরের ফিল্ড অফিসার (প্রটেকশন) হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গায়েত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে গায়েত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বাবুল আক্তার। বাবুল আখতারের মোবাইলে গায়েত্রী মেসেজ পাঠিয়েছিল। মোবাইলটি বাসায় রেখে যাওয়ায় ওই মেসেজগুলো মিতু দেখতে পায়। তখন তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরমে ওঠে। ওই ঘটনার জের ধরেই বাবুল তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।

৫ বছর ধরে থেমে থেমে চলা এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নে যাওয়ার আগে বলে রাখি, এই একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দুই জন আর পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এখনও নিখোঁজ আছেন একজন। শুরু থেকেই ঘটনাটি অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল, নতুন ন্যারেটিভে সেসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া তো যায়ইনি; বরং আরও নতুন নতুন প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে।

১) মিতু হত্যার ২০ দিন পর বাবুল আখতারকে হঠাৎ পুলিশ সারা রাত ধরে দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং এরপর পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানায় বাবুল আখতার নিজেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পর বাসায় ফিরে এলে মিতুর মা দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট—আমার মেয়েটা চলে গেলো। এরপর তোরা আমার জামাইকে (এসপি বাবুল আক্তার) প্যাঁচাইলি কেন? বাবুল একটা ফেরেশতা। ওরা আমার মেয়ের জামাইরে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছে। আমার ছেলে নেই, ওকে আমরা ছেলের মতো দেখি’। সেই প্রতিবেদককে বাবুল আখতারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বাবুল এ হত্যায় জড়িত নন। হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার সবই অপ্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বাবুল আখতারের ওপর তাদের এতটাই আস্থা যে তারা খুব সিরিয়াসলি চেয়েছিলেন বাবুল মিতুর কাজিনকে বিয়ে করুক।

জামাইয়ের প্রতি যদি তখন এতটাই আস্থা থাকে তাহলে আজ কেন মিতুর বাবা-মা দাবি করছেন বাবুলের পরকীয়ার কথা মিতু মারফত তারা আগেই জানতেন? পরকীয়ার জের ধরে তাদের সম্পর্কের ভীষণ অবনতির কথা আজকে যখন বলছেন তখন সেই একই ব্যক্তিকে ৫ বছর আগে ‘ফেরেশতা’ বলেছিলেন কেন? কেনই বা হত্যাকাণ্ডের পর পর দীর্ঘ সময় বাবুল তার শ্বশুর-শাশুড়ির আশ্রয়ে ছিলেন? মিতুর কাজিনকে বিয়ের জন্য চাপ বাবুলকে দেওয়া হলো কেন?

২) ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর বাবুল পদত্যাগ করেছিল বলে পুলিশ দাবি করে। যদিও বাবুল বলেছিলেন তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য ৯ আগস্ট, ২০১৬ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে তিনি আবেদন করেন – এই তথ্য বাবুলের দাবিকে সমর্থন করে।

বাবুল আখতারকে কেন পদত্যাগে বাধ্য করা হলো? তিনি যদি মিতু হত্যায় জড়িত থাকেন, তাহলে কি একটা পদত্যাগে তার বিচার হয়ে যায়? তার বিরুদ্ধে তখনই কেন ফৌজদারি অভিযোগ আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি? আর তখন যদি তাকে নির্দোষ মনে করা হয়ে থাকে তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা কি তার ওপর অবিচার নয়? কথা উঠেছিল পুলিশ তার ভাবমূর্তি রক্ষায় বাবুল আখতারকে গ্রেফতারে গড়িমসি করেছে। পুলিশের যেসব কর্মকর্তা বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, এখন কি তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত না?

৩) এই দেশের চিরাচরিত রীতি হলো যেকোনও ঘটনায় প্রথমেই বিরোধী দলকে দায়ী করা। এই ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘটনা ঘটার পরপরই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল ঘটনাটি বিএনপি-জামায়াতের কাণ্ড এবং তারই ধারাবাহিকতায় শিবিরের এক কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়। এভাবেই কি নির্বাহী বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের চাপে নিম্ন পর্যায়ের পদক্ষেপ নির্ধারিত হয়, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে বিচার বিভাগের ওপরও?

৪) ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পিবিআইকে মিতু হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিজ বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রীর অতি আলোচিত হত্যার তদন্ত কি স্বাভাবিকভাবে হচ্ছিল না যে সেটার দায়িত্ব পিবিআইকে দিতে হলো?

৫) পিবিআইও কি তদন্তে আগের মতোই গড়িমসি করছিল যে সেটাকে গতি দিতে রীতিমতো হাইকোর্টকে পদক্ষেপ নিতে হয়? নিজ বাহিনীর একজন সদস্যের স্ত্রী হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত পুলিশ যদি দীর্ঘ ৫ বছরেও শেষ করতে না পারে, তাহলে সাধারণ মানুষদের কী অবস্থা হবে?

৬) এবার বাবুল আখতারকে গ্রেফতারের সময় পিবিআই’র এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত করতে গিয়ে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছেন বাবুলের পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। নিজের সোর্স মুসাকে দিয়েই সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা পত্রিকায় এটাও দেখলাম হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরেই সোর্স মুসার সঙ্গে বাবুলের কথা বলার একটা অডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে, যেটা সঠিক হলে খুব স্পষ্টভাবে বলা যায় বাবুল এর সঙ্গে জড়িত। এই ক্লিপ মাত্র এখন পাওয়া গেলো? এই ক্লিপ তো তখনই পাবার কথা। তাহলে এটা এতদিন জানানো হয়নি কেন? হত্যার মজুরি হিসেবে যে বিকাশ নম্বরে লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে সেটা পেতে পুলিশের এতদিন লাগলো কেন? আর আগে পেয়ে থাকলে এতদিন জানানো হয়নি কেন?

৭) মিতু হত্যার গুরুত্বপূর্ণ আসামি বাবুলের সোর্স মুসাকে হত্যাকাণ্ডের পরপরই পুলিশ তুলে নিয়ে যায় তার স্ত্রীর সামনে থেকে, যা তিনি তখন সংবাদ সম্মেলন করে জানান। এখনও তিনি এই দাবি করেন। কিন্তু মুসার ব্যাপারে পুলিশ আজও কোনও তথ্য জানায়নি। এছাড়াও ঘটনার পরপরই রাশেদ ও নবী নামের দুই জনকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়। ভয়ংকরতম অপরাধে অভিযুক্তকেও কি পুলিশ বিনা বিচারে হত্যা কিংবা গুম করার অধিকার রাখে?

শেষ কথায় বলি ‘মিতু ভাগ্যবান’। তার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অন্তত শুরু হয়েছে। ত্বকী, সাগর রুনি কিংবা আরও অনেকের মতো এমন তো হতেই পারতো যে “কেউ মিতুকে খুন করেনি।”

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ