X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ ভারতে বাড়ি হচ্ছে জনশূন্য, নেই মৃতের প্রকৃত পরিসংখ্যান

বিদেশ ডেস্ক
১৮ মে ২০২১, ২০:৩১আপডেট : ১৮ মে ২০২১, ২১:৪৮

ভারতের বড় বড় শহরগুলোতে তাণ্ডব চালানোর পর এখন করোনার সংক্রমণ দেশটির গ্রামীণ জনপদে ছড়াচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশটির বেশিরভাগ গ্রামে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনও উপায় নেই।

রাজধানী দিল্লি থেকে দেড়ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বাসি গ্রামের ৫ হাজার ৪০০ বাসিন্দার প্রায় তিন ভাগ অসুস্থ এবং গত তিন সপ্তাহে মারা গেছেন ৩০ জনের বেশি। এখানে নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, চিকিৎসক এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর ভারতের শহুরে শিক্ষিত সোশ্যাল মিডিয়াতে সরব মানুষের মতো টুইটারে অপরিচিতদের কাছে সহযোগিতার চাওয়ার অবস্থাও তাদের নেই।

গ্রামের নতুন নির্বাচিত প্রধান সঞ্জিব কুমার বলেন, কোনও অক্সিজেন না থাকায় গ্রামের বেশিরভাগ মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থদের জেলা সদরে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় এবং গুরুতর অসুস্থদেরও চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়। অনেকে সময় মতো সেখানে পৌঁছাতে পারেন না।

এমন দৃশ্য ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের ১৮টির বেশি শহর ও গ্রামের প্রতিনিধিদের দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তারা করোনার হত্যালীলার ভয়াবহতার মাত্রা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। পুরো পরিবারের সব সদস্যই মারা গেছেন, তাদের দেহ গঙ্গা বা কৃষি জমিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে সৎকার করার মতো কর্মীর অভাবে।

অনেক মানুষ মনে করেন, সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে সংকটের প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। গ্রামের মানুষেরা জ্বর হলেও বাড়ি ছাড়তে রাজি না হওয়া, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভাইরাসে মৃতের প্রকৃত সংখ্যার হিসাব রাখতে না পারার কারণে এই আশঙ্কা বেড়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে, মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ৭৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

মহামারির এক বছরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও ভ্যাকসিন সরবরাহসহ চিকিৎসা অবকাঠামো শক্তিশালী করতে না পারার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। গত মাসে বাসি ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় নির্বাচনে হেরেছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এমন সময় নির্বাচনে বিজেপি হারলো যখন প্রতিদিন দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

তৃণমূলে মানুষের মনোভাব মোদি ও বিজেপির রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জন্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যোগীকে মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরি মনে করা হচ্ছে। আগামী বছর রাজ্যটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বাসি গ্রামের ৭২ বছর বয়স্ক বাসিন্দা সাহাব সিং বলেন, মোদি ও যোগীর প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। এখন যা কিছুই ঘটুক না কেন আমরা বিজেপিকে হারানোর জন্য ভোট দেবো।

সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারণার সময় অনেক নির্বাচনিকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের একজন কুমারসাইন (৫৯)। তার ৩১ বছরের ছেলেও আক্রান্ত হয়েছে। হাঁটতে না পারা ও শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় গত মাসে কাছের একটি হাসপাতালে তাদের নিয়ে যায় পরিবার। সেখানে তারা অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা আছে এমন কোনও অ্যাম্বুলেন্স পাননি।

কুমারসাইনের ছেলে প্রবীণ বলেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক জানান বাবা মারা গেছেন। কিন্তু করোনায় মৃত্যুর বদলে কারণ হিসেবে লেখা হয় হৃদরোগ। আমাদের বলা হয়, যেহেতু মৃত্যু হয়ে গেছে তাই করোনা পরীক্ষা করার কোনও প্রয়োজন নেই।

কয়েক দিন পর তার ভাইয়েরও মৃত্যু হয়। ক্লিনিকটিতে তখন অক্সিজেন সাপোর্টে ছিলেন আরও ছয় রোগী। তারাও মারা যান। প্রবীণ বলেন, আমার সন্দেহ হাসপাতালে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণ ছড়াবে জেনেও নির্বাচন আয়োজন ফৌজদারি অপরাধ।

এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তারা কোনও সাড়া দেয়নি। ১৪ মে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন মোদি। তিনি বলেন, আমি আপনাদের করোনার বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। গ্রামে দ্রুত করোনা ছড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

মৃত স্বজনের ছবি হাতে বাসি গ্রামের বাসিন্দা

বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বায়জাওয়ান্ত পান্ডে জানান করোনার সাম্প্রতিক প্রকোপ আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। কিন্তু তিনি টিকাদান কর্মসূচির কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি মোদির পদক্ষেপ সমর্থন করে জানান, নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল পাওয়া রাজ্য সরকার অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত না করার জন্য দায়ী।

পান্ডে বলেন, একা শুধু প্রধানমন্ত্রী ভাবেননি যে আমাদের করোনার প্রকোপ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে, জানুয়ারির শুরুর দিকে ভারতেই এই মনোভাব বিরাজ করছিল।

বিজেপি নেতা আরও বলেন, অনেক এপিডেমিওলজিস্টস অক্টোবরে বলেছিলেন খারাপ সময় শেষ, আমাদের কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন তারাই সমালোচনা করছেন।

হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে একটি বইয়ের লেখক ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিকিতা সুদের মতে, করোনা মোদিকে বিপদে ফেলার মতো আরও কারণ হাজির করছে। সেগুলো হলো, গুরুতর অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও বড় কোম্পানির স্বার্থে কৃষিনীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন।

তিনি বলেন, সহজে বললে করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা মোদি শাসনের পক্ষে থাকা জনমত উল্টো দিকে ধাবিত করছে। মনে হচ্ছে, ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম বিজেপি সত্যিকার অর্থে বেকায়দায় পড়েছে।

রাজধানী দিল্লিতে নেতারা যখন সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন তখন পুরো ভারতে শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য বিরাজ করছে। গত সপ্তাহে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের মানুষ ঘুম থেকে জেগে গঙ্গা নদীতে প্রায় ৭০টি দেহ ভাসতে দেখেন। করোনায় মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় শ্মশানগুলো সৎকারে কুলিয়ে উঠতে না পারায় দেহগুলো এভাবে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গঙ্গা নদীর তীরবর্তী আরও কয়েকটি স্থানেও মৃতদেহ ভেসে থাকার খবর পাওয়া গেছে।

মধ্য প্রদেশের উজ্জাইন শহরে ট্রাভেল কোম্পানির মালিক রাজেশ শর্মা বলেন, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়েই আমাদের ব্যর্থতার কারণ। ভারত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এক বছর সময় পেয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ও খ্যাতি বাড়াতে বিদেশে ভ্যাকসিন পাঠানো ছাড়া কিছুই করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে বেড নেই, ওষুধ নেই। মানুষকে মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হয়েছে। উজ্জাইনে গত দুই দিনে অনেক পরিবারের সবারই মৃত্যু হয়েছে।

পাঞ্জাব প্রদেশে স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের এক কর্মী বলবীর জানান, এমন সংকট আগে কখনও দেখা যায়নি। তিনি বলেন, মানুষ এতই ভয় পেয়েছে যে, অনেকে জ্বর হলে কাউকে বলছে না। এত বেশি সংক্রমণের পরও তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কোনও মাস্ক না, কোনও গ্লাভস না, কিছুই না।

উত্তরাখণ্ডের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এখানকার স্থানীয় নবীন মোহন বলেন, ঋষিকেশ এলাকায় সব বাড়িতে অসুস্থ মানুষ রয়েছে। হরিদওয়ারেও একই পরিস্থিতি। মহামারি এখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। হাজারো মানুষ মরছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহে আরও মরবে। সরকার মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রতারণা করছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র সবার সামনেই দৃশ্যমান। সূত্র: ব্লুমবার্গ

/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বশেষ খবর
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা