করোনাভাইরাস প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে যে থাবা বিস্তার করেছে তা গুটিয়ে নিতে আরও এক থেকে দুই বছর লেগে যেতে পারে। মূলত পণ্য সংকট নিয়েই এ বছর পার করতে হবে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ী, প্রযুক্তি পণ্যপ্রেমীদের। বাজারে গেলে অন্তত ‘নেই নেই’, আর ‘বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে’ এমন শব্দ শুনতেই হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
প্রযুক্তি বাজার সূত্র বলছে, গত এক বছরে ৩০-৪০ শতাংশ বাজার হারিয়েছে এই খাত। যদি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তবে, বিশ্ববাজারে উৎপাদন বাড়িয়ে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক করে আগের অবস্থায় ফিরতে এক থেকে দুই বছর লেগে যাবে। চিপ সংকট এখনও দূর হয়নি। নতুন করে প্রসেসর, মনিটরের প্যানেল, র্যাম ও মাদারবোর্ডের সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ডেস্কটপের বাজারে। আর ল্যাপটপের সংকট দেশের বাজার গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেখছে।
এদিকে বাজারে যন্ত্রাংশের অভাবে ডেস্কটপ কম্পিউটার বিশেষ করে ক্লোন পিসির দাম বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে যে ক্লোন পিসি বিক্রি হতো ৪০ হাজার টাকায়, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৭ হাজার টাকায়। ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ হাজার টাকায়ও। কেন দাম বেড়েছে— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো, বিদেশে থেকে পণ্য আনার খরচ বেড়েছে। কন্টেইনার ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ। আগে একটি কন্টেইনারে যে পরিমাণ পণ্য দেশে আসতো, এখন আসে তার অর্ধেক। ওদিকে ভাড়াও দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, চীন সরকার পণ্য রফতানিতে ১৫ শতাংশ চার্জ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এটার ফলেও দাম বাড়ছে। অন্যদিকে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও যন্ত্রাংশের দাম বাড়িয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে দাম বেড়েছে, বেশি প্রভাব পড়েছ ক্লোন পিসির বেলায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) যুগ্ম সম্পাদক মুজাহিদ আল বেরুনী সুজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাজারে এখন প্রসেসর (ইনটেল, এএমডি), মনিটরের প্যানেল, র্যাম, মাদারবোর্ডের সংকট রয়েছে। ফলে কম্পিউটারের দাম বাড়ছে। আর চিপ সংকট তো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালের আগে চিপ সংকট দূর হবে না বলে তিনি মনে করেন।
দেখা যেত আগে কন্টেইনারে ১০ হাজার ইউনিট কোনও পণ্য দেশে এলো, এখন তা কমে ৫ হাজার ইউনিটে নেমে গেছে। যে মনিটর এই কিছু আগেও বিক্রি হতো ৬ হাজার ৫০০ টাকায়, প্যানেল সংকটের কারণে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৮০০ টাকায়। উৎপাদকরাই মনিটর প্রতি ১০ থেকে ১৫ ডলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে তিনি জানান।
ব্র্যান্ডভেদে ল্যাপটপের সংকট এখনও
ব্র্যান্ডভেদে দেশে এখনও ল্যাপটপের সংকট রয়েছে। তবে গত বছর করোনা শুরু পরে লকডাউন থেকে এ বছরের লকডাউনেও ডেল ব্র্যান্ড বাজারে তাদের ল্যাপটপ সংকট হতে দেয়নি। বরং স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি সরবরাহ করে প্রযুক্তি বাজার ল্যাপটপ শূন্য হতে দেয়নি। এরপর পরই ছিল এসার ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ডটিও বাজারে ল্যাপটপের চাহিদার কাছাকাছি সরবরাহ করতে পেরেছে বলে বাজার সূত্রে জানা গেছে। ভয়াবহ সংকটে ছিল এইচপি ও লেনেভো। বর্তমানে ব্র্যান্ড দুটি সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কিছু কিছু ল্যাপটপ বাজারে ঢুকছে বলে বাজার সহনীয় মাত্রায় আছে এখনও।
এদিকে আসুস ব্র্যান্ডের কান্ট্রি অফিস থেকে পূর্বাভাস পাওয়া গেলো, এ বছরটা সংকটের মধ্য দিয়েই কাটবে। আসুস বাংলাদেশের বিপণন ব্যবস্থাপক (ডিজিটাল ও পাবলিক রিলেশন্স) নাফিজ ইমতিয়াজ বলেন, আমরা যেটা বুঝতে পারছি, বছরটা সংকটের মধ্য দিয়েই শেষ হবে। আসুস থেকে আমাদের সরাসরি না বললেও ল্যাপটপের স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় তেমনটাই মনে হচ্ছে। তিনি জানালেন, বিশ্বজুড়ে চিপ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাব সব খাতেই পড়বে।
ব্যাংক ঋণে ব্যবসা টিকে আছে
করোনাকালে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের যাতে ব্যবসা গোটাতে না হয়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ না হয় সেজন্য দেশের প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে। এগিয়ে আসে ব্র্যাক ও প্রাইম ব্যাংক। সদস্যদের প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভর করে ব্যাংক দুটি স্বল্প সুদে বিনা জামানতে ঋণ দেয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সমিতির সদস্যরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করান। অফিস ভাড়া, কর্মচারীর বেতনই ছিল ব্যবসায়ীদের প্রধানতম চাহিদা। ব্যাংক ঋণে সেসব পরিশোধ করে ক্রেডিট স্কিমে পণ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করে টেক আছে। নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক কম্পিউটার ব্যবসায়ী বললেন, ব্যাংক ঋণ না পেলে এতদিনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হতো। কিছুটা বাকিতে, আর কিছু পণ্য নগদে এনে ব্যবসা করে টিকে আছি। অফিস ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন আপাতত ঋণের টাকা থেকে দিচ্ছি। খরচ তুলতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ সেল শুরু হলে সংকট দূর হবে বলে তিনি আশাবাদী।
কতগুলো সদস্য প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ পেয়েছে তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি সেই তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ঋণ গ্রহণকারী সদস্যদের আপত্তির কারণে তথ্য প্রকাশ করা না হলেও জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী (আবেদন যারা করেছেন) ব্যাংক ঋণ পেয়েছেন।