X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘নিত্য কালের ডাক’

সব্যসাচী হাজরা
২৫ মে ২০২১, ১১:১০আপডেট : ২৫ মে ২০২১, ১১:১০

যে শিকড় আমাদের, তাকে ঘুরে দেখতে হয় না, সে কখনো কখনো অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। সময়ের দাবি মেনে সে ফিরে ফিরে আলোকিত হয়, প্রাঞ্জল হয় বিপন্ন সময়ের অন্ধকারে। যেখানে প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকার লড়াইকেই প্রকট করে, সেখানে মুহূর্ত প্রকট হয় ‘বাঁচো'—শব্দ দিয়ে। পরিকল্পিত গণহত্যা, হিংসা, বিভেদ, ধর্মীয় মেরুকরণ যেখানে ক্ষমতার মদতপুষ্ট, যেখানে যুগে যুগে, কালে কালে সংগঠিত রোষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষকে মারে, যেখানে গণচিতার আগুনে তাকিয়ে থাকে নতুন প্রজন্মের নির্মল চোখ, যেখানে গণকবরের সামনে স্থির হয় সরল নিষ্পাপ মুখ, যখন একজন শিখে নেয় অন্যকে যন্ত্রণা দেওয়ার ‘সভ্য' উপায়, যখন ‘প্রতিভা’ প্রদর্শিত হয় অসহায়, সর্বহারা মানুষকে রাষ্ট্রযন্ত্রের গিনিপিগে পরিণত ক'রে, যখন লিঙ্গভেদে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠে, তখন?—স্থান কাল নির্বিশেষে সেখানে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে ‘বিদ্রোহী’ উচ্চারণ। শব্দের সত্য সেখানে গোপন থাকে না, সে প্রয়োজনীয় হয় মুক্তির পথে। তাই তো কোনো লেখককে কখনো দেশান্তরী হতে হয়, কাউকে কখনো নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। কলমের ডগায় যে সত্য উন্মোচনে ট’লে যেতে পারে শাসক ও শাসিত মানুষের কৃত্রিম সম্পর্ক, শিকারি ও শিকারের ‘সহজ’ যোগ, সেই কলম দ্বিধাহীনভাবেই নির্ভীক নজরুলের নিজস্ব। সময়ের সংকটে তাই তাঁকে স্মরণ করতে হয় না, অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে দুর্নিবার এই নাম। তাঁর বলা সেই কথা ‘আজ চাই, ভরাট-জমাট জীবনের সহজ, স্বচ্ছন্দ, সতেজ গতি ও অভিব্যক্তি। কোথাও কোনো জড়তা, অজ্ঞতা, অক্ষমতা, আড়ষ্টতা যেন না থাকে’—এই চাওয়া আজও সমান সত্য।

কবি প্রদীপ চৌধুরীর প্রশ্ন—‘মানুষের অস্তিত্বের জন্য কেন গড়ে তুলতে হয় কবিতার প্রতিরোধ?’
নজরুলের কথায়—
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!’
আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না—কাব্য-ভাষার শৈল্পিক উচ্চতার থেকেও সেখানে বড় হয়ে ওঠে উৎপীড়িত, নিপীড়িত মানুষের হয়ে কবির হুংকার। হ্যাঁ, হুংকার, সেখানে আড়াল নেই কোনো, আছে স্পষ্ট , দৃঢ় উচ্চারণ। সেখানে কবির প্রত্যয় সুপ্ত নয়, সর্বসমক্ষে প্রকাশিত। তাই তো তাঁকে ছুটে যেতে হয় দ্রুতির প্রাবল্যে ডানদিকে সদ্যজাত শিশু বাঁদিকে জরায় মরা মানুষকে নিয়ে। তাই তো তাঁর কবিতা আশ্রয় হয় সর্বহারা, অবদমিত মানুষের কাছে, ভাষা জোগায় প্রতিবাদী মানুষের মুখে। পরোক্ষ নয়, এই প্রত্যক্ষ উচ্চারণ তাই অত্যাচারিতের কাছে হয়ে ওঠে ভীতিকর। তখনই প্রশ্ন জাগে ‘কবিতার প্রয়োজন কি সভ্যতার থেকেও বেশি?’
কোথাও কবি লেখেন ‘মানুষ চিরকাল মানুষের উপর যে অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহা পশুদের পক্ষেও অসম্ভব। কারণ মানুষ একটি চিন্তাশীল পশু। তাহার বুদ্ধি এত প্রবল যে, ইচ্ছা করিলেই সে তাহার ভিতরকার পশুটিকে দুর্দান্ত ও নির্মম করিয়া তুলিতে পারে।’ ধর্ম, সমাজ, শান্তি, শৃঙ্খলার নামে প্রতিদিন যে অবক্ষয় আমরা প্রত্যক্ষ ক’রে চলেছি, প্রতিমুহূর্তে মানুষ মানুষের বিশ্বাসের সুযোগ নিচ্ছে যেভাবে, সেখানে কবির চিরদুর্দম কলম যেন প্রাসঙ্গিকতায় উজ্জ্বল।
তাই জয়ধ্বনি করতেই হোলো। তিনি যখন লেখেন
‘প্রার্থনা ক’রো যারা — কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’
বারংবার মানুষের কথাই বলেছেন নজরুল। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিলো সদা জাগ্রত, তাঁর ধ্বনিত উচ্চারণ তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারবার ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্’। এ সত্য কোনো নির্দিষ্ট কালের গর্তে বাঁধা থাকে না, ক্ষমতার আগ্রাসী রূপ যখনই মানুষকে তার পেষণযন্ত্রে চূর্ণ করতে চায়, তখনই আবার মানুষের স্বার্থেই সেই মানুষকে প্রয়োজন হয় ত্রাতার ভূমিকায়। আজও তাঁর লেখা তাই মানবতার জয়গান। সেখানে ব্যক্তি নজরুল ও তাঁর রচনা পারস্পরিক আলোয় সম্পৃক্ত।
জাত, ধর্ম, উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধনের অসাম্য যেখানে সেখানেই তাঁর রচনা আজও আমাদের আশ্রয়। সব বাধা-ব্যবধান সরিয়েই তাই তিনি লিখেছিলেন ‘গাহি সাম্যের গান’।
কখনো বিপন্ন সময়, কখনো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, কখনো বা সভ্যতার সংকট শিল্পীকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নেয় এমন সব নির্মাণ যা সমকালীন প্রেক্ষাপটকে ছাড়িয়ে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে জ্বলে ওঠে তার নিজস্ব প্রাসঙ্গিকতায়। সে পিকাসোর গুয়ের্নিকা হোক, বা নজরুলের কবিতা, অথবা চিরকালীন কষ্ট ও দুর্দশায় নির্মিত সোমনাথ হোড়ের ছবি। জীবন যেন ভাঙা-জীবনের গান গায়, শক্ত হতে বলে, গ’ড়ে নিতে বলে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। মানুষকে সচেতন করে তার অধিকার রক্ষায়। অর্ধমৃত জাতিকে জাগাতে চায় তার আহ্বানে। কল্লোলের কবি নজরুল লাগামহীন শব্দে সেই ভাষাকে তাঁর ভাবনামুখে বসালেন। রঞ্জিত সিংহ বলেন ‘বিশের দশককে আধুনিক বাংলা কবিতার যুগসন্ধির কাল বলে চিহ্নিত করা অবিবেচকের কাজ নয়। কারণ এই দশকের গোড়ায় সত্যেন্দ্রনাথে মৃত্যু, মধ্যভাগে যতীন্দ্রনাথ, নজরুল ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্য আন্দোলন এবং অন্তিমে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’-‘মহুয়া’, জীবনানন্দের ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ’। আমরাও লক্ষ করি রবীন্দ্রবলয় থেকে মুক্তির জন্য এক প্রত্যক্ষ প্রয়াস।
নৈরাশ্যের আবরণ সরিয়ে দিয়ে কবি যখন ব’লে ওঠেন ‘বল বীর—আমি চির-উন্নত শির!’ তখন তা যেন অত্যাচারিত, অবহেলিত, হীনবল মানুষের কাছে আজও মন্ত্রের মতোই শোনায়। তিনি তাই অকপটে বলেন—
‘বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু! বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছ সুখে!’
এ যেন কবির কাব্যরচনার মূল অভিপ্রায় যা কখনোই পরোক্ষ নয় তিনি বলবেন, তাঁকে বলতেই হবে লাঞ্ছিত, পতিত, ন্যুব্জ, শোষিত মানুষের কথা। তার বাইরে বেরনো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বারংবার তাঁর কবিতার বিভিন্ন পঙক্তিতে আলোকিত হয় বিস্ময়/সম্বোধন চিহ্ন, কাব্যগ্রন্থের নাম হয় অগ্নিবীণা, সর্বহারা, ফণি-মনসা, জিঞ্জীর।
‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থে আমরা পাই—
‘ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল।’
সচেতন মানুষ খোলা চোখে তাকায় প্রশ্ন করে—প্রশ্ন করে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও আগ্রাসন নিয়ে, ধর্মে, কর্মে, সামাজে নারী-পুরুষের ভারসাম্য নিয়ে, কন্যা-ভ্রূণ হত্যা, যৌন অত্যাচার/ ধর্ষণ নিয়ে, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ধর্মীয়-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও প্রবেশাধিকার নিয়ে, শিশু-শ্রম, সভ্যতার নামে ধনী ও নির্ধনের পার্থক্য, ধর্মীয় বিভেদ নিয়ে, জাতপাতের কালো গর্ত নিয়ে, সর্বোপরি জানতে চায় মননে, প্রকাশে, উচ্চারণে আমরা সত্যিই স্বাধীন কি না। কবি বুঝেছিলেন এ শুধু হাসি-খেলা নয়, মিথ্যেকথা ও ছলনার মুখোশ তাই তিনি খুলতে চেয়েছেন বিভিন্ন লেখায়। আত্মপ্রচার ও স্তুতি নিয়ে তাঁর ছিলো সরব উচ্চারণ। যে সংকট সেদিনও ছিলো, আজও আছে। তাই কবির দুর্বিনীত প্রকাশ আজও প্রাসঙ্গিকতায় উজ্জ্বল—
১। ‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!’.
২। ‘সাম্যের গান গাই! —
যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই!’
৩। ‘সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
৪। ‘অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’
৫। ‘এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা’
৬। ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই!’
বৈষম্যের বিরুদ্ধে একদিকে মানুষকে জাগিয়ে তোলা, অন্যদিকে মানবতার জয়গান, হৃদয়ের গভীর থেকে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ছিলো কবির আমরণ জাগ্রত। তাই যেখানেই ধর্মের আফিম, সভ্যতার বিষ, সামাজিক ভেদাভেদ, সেখানেই কবির রক্তচক্ষু, সেখানেই তাঁর কলমের গর্জন। মাঠ থেকে মোহনায়, জন্ম থেকে মৃত্যু সর্বত্র তাই কবির মিলনের কথা।
বিদ্রোহ শুধু নয় কবির কলমে ভালোবাসাও সদাজাগ্রত, সেই ভালোবাসা দিয়েই বারংবার তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন সেই নায়ককে যে একায় অগ্রদূত, মিলনে ছাত্রদল। কখনো সেখানে বেদনার পুঞ্জীভূত মেঘে তীব্র ধারার বর্ষণ। কোথাও কাদা-ছোড়াছুড়ির হোলি খেলার বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট ভাষা। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচছ’।
কবিতায় প্রেমে, গানে, প্রবন্ধে কবির কর্মকাণ্ডের নানান দিক উদ্ভাসিত হতে পারে। সে কাজ বাকি থাক, আমি শুধু আজকের নিরিখে কবির কলমের প্রাসঙ্গিকতাকে সীমিত পরিসরে একটি বিশেষ দিকে ধরতে চাইলাম।
‘ভিক্ষা দাও! পুরবাসী, ভিক্ষা দাও! তোমাদের একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও! আমাদের এমন একটি ছেলে দাও, যে বলবে আমি ঘরের নই, আমি পরের। আমি আমার নই, আমি দেশের।

সব্যসাচী হাজরা : পশ্চিমবঙ্গের লেখক

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’