X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যত দোষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের!

রফিক মুহাম্মদ
রফিক মুহাম্মদ
২৮ মে ২০২১, ১৮:২৭আপডেট : ২৯ মে ২০২১, ১৩:৩৫

রফিক মুহাম্মদ

বাংলায় প্রচলিত প্রবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। অর্থাৎ যে যত দোষই করুক না কেন, সব নন্দ ঘোষের ঘাড়েই যায়! এ প্রবাদের সহজ অর্থ হচ্ছে, দুর্বলের ঘাড়ে দোষ চাপানো। হিন্দু পুরাণ কেন্দ্রিক এই প্রবাদটি এবার যেন আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য। লকডাউনে বাস, ট্রেন, লঞ্চ-স্টিমার, হাট-বাজার, শপিং মল সবই খোলা। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাড়া শিক্ষার্থীরাও সর্বত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ধ শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাহলে কি যত দোষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের?

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের রোগী গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয় গত বছর ১৮ মার্চ থেকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এরপর আসে নিষেধাজ্ঞা, তারপর লকডাউন। লকডাউন সম্পর্কে ধারণা ছিল সবকিছু বন্ধ থাকবে। তবে বাস্তবে দেখা গেলো উল্টো। একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আর বাকি সবকিছু খোলা রেখে চললো আমাদের দেশের লকডাউন।

এই অভিনব লকডাউনে বাস, ট্রেন, লঞ্চ-স্টিমার সবই খুলে দেওয়া হয়েছে। হাট-বাজার, অফিস আদালত চলছে যার যার মতো। ঈদের শপিং করতে ভিড় উপেক্ষা করে পুরো পরিবারই ছুটে গেছে শপিং মলে। পার্ক, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রেও দেখা গেছে উপচেপড়া ভিড়। স্বাভাবিক গতিতে বিয়ে, জন্মদিন, সংবর্ধনা, জনসভাসহ সামাজিক সব ধরনের অনুষ্ঠানও চলছে। বন্ধ শুধু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হচ্ছে। যদিও গত ২৬ মে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয়তো আগামী ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারবো’।

করোনার কারণে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কলেজের উঠানে পা না রেখে একটি ব্যাচ কলেজ জীবনই শেষ করে ফেললো। কলেজ নিয়ে তাদের ব্যক্তিজীবনে কোনও অভিজ্ঞতাই যোগ হলো না। প্রথম শ্রেণির মাধ্যমে যেসব শিশুর স্কুলে প্রবেশের বা পা রাখার কথা ছিল, তারা সেই সুযোগটি পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন প্রথম বর্ষে (নিউ ফার্স্ট ইয়ার) কোনও শিক্ষার্থী নেই। কারণ, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে কোনও শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারেনি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছর অটো পাসের মাধ্যমে যারা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেসব শিক্ষার্থীরই প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে এখনও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমন বিলম্ব প্রায় সব খাতে। এটি সবার ব্যক্তিজীবনকেও প্রভাবিত করছে। ব্যাপক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বেড়েছে বাল্য বিয়ে। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে নানা মানসিক সংকটের মুখোমুখি। এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। পড়ালেখার কোনও চাপ নেই। তাই হাতের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাতছানি। একটি মোবাইল ফোন হাতে থাকা মানেই গোটা দুনিয়ার আনন্দ-বিনোদন, ভালো-মন্দ সবই নিজের হাতের মুঠোয়।

ফলে শিক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। শহর, নগর-গ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা। অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা দিনে দিনে পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পড়াশোনার কথা বললেই রেগে যায়। সারা রাত জেগে থাকে। দিনে ঘুমায়। কিছু বলতে গেলেই নানা কথা শুনিয়ে দেয়। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা বললেন, সবই তো খোলা। তাহলে স্কুল-কলেজ খুলতে সমস্যা কোথায়?

করোনার ছোবলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। টানা ১৭ মাস ধরে বন্ধ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন জরিপে করোনায় শিক্ষা খাতের ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে, বঞ্চিত হয়েছে ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৯২ শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে নিয়মিত পড়াশোনার একদম বাইরে রয়েছে। এ গবেষণায় এমন প্রেক্ষাপটে মা-বাবাদের চিন্তা-ভাবনার চারটি মৌলিক দিক উঠে এসেছে। এগুলো হলো, শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাওয়া, শিক্ষার খরচ তুলনামূলক বেড়ে যাওয়া, স্কুল খোলার সময় নিয়ে চিন্তা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মসংস্থানজনিত উদ্বেগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের ক্ষতি চোখে দেখা যায়। কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি দৃশ্যমান হতে থাকে ধীরে ধীরে। বিভিন্ন গবেষণায় যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা গভীর উদ্বেগজনক। শিক্ষার জন্য তা অশনি সংকেত। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরে পাঠগ্রহণকারী শিশুদের শিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক দিকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই করোনায়। শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। এ বছর স্কুল ভর্তির সময়সীমা দফায় দফায় বাড়িয়েও সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। আয় না থাকায় বহু অভিভাবক পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। ফলে তাদের সন্তানরাও স্কুলে ভর্তি হয়নি। এই শিশুরা বিদ্যালয়ে ফিরবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া বেড়েছে বাল্যবিয়ে। এছাড়া দরিদ্র পরিবারগুলোতে আয়হীনতার কারণে অভিভাবকরা তাদের পরিবারের শিশুদের সুষম খাদ্য ও পুষ্টি এখন দিতে পারছেন না। পুষ্টিহীনতা শিশুর শিখনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসবের বাইরে বেসরকারিভাবে পরিচালিত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা, বিশেষ করে নন-এমপিও, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা আয় নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছেন। করোনায় শিক্ষার এসব ক্ষতি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। অথচ ক্ষতিপূরণে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই।

করোনা সহসা আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। জীবন এবং জীবিকার বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য লকডাউনেও যেমন সবকিছু উন্মুক্ত রয়েছে, তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। জাতিকে বাঁচাতে শিক্ষাকে অবশ্যই সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রয়োজন। আসছে বাজেটে শিক্ষাকে একক খাত হিসেবে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনও কিছুতেই কর আরোপ করা যাবে না। বিশেষ করে ডিজিটাল লেখাপড়ার কোনও উপকরণে নতুন কর যেন বসানো না হয়। করোনাকাল আরও দীর্ঘ হলে শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের বাইরের পড়াশোনা তথা অনলাইন পাঠদান ও ভার্চুয়াল ডিজিটাল ক্লাসরুম আরও বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষা খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এতে একটি প্রজন্ম শিক্ষা থেকে বহুদূরে ছিটকে যাবে। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, জাতিকে বাঁচাতে, একটি প্রজন্মকে রক্ষা করতে যত দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াসহ একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে ততই মঙ্গল।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ