X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনার করুণ কাহিনি: বাঁচতে হলে জানতে হবে ও সচেতন-অসচেতনতা

মাকসুদুল হক
৩০ মে ২০২১, ১১:৫৩আপডেট : ৩০ মে ২০২১, ১৭:২৩

মাকসুদুল হক ‘মানব মস্তিষ্ক জীবতাত্ত্বিক কম্পিউটার আর মানব মন তার অসীম চেতনা।’—অজ্ঞাত

এইডস (অ্যাকোয়্যার্ড ইমিউনিটি ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম), এই মহামারিতুল্য রোগ প্রাথমিকভাবে ১৯৮১-তে আমেরিকার সমকামীদের ভেতরে পরিলক্ষিত হলেও তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সকল প্রান্তে। ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশ এইডসের এই ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি। আফ্রিকা মহাদেশ ও ভারতবর্ষের অবস্থা ছিল বেগতিক। সমগ্র বিশ্বজুড়ে এইডস বা তার উপসর্গ এইচআইভি (হিউম্যান উমিনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে গেলে ভয়াবহতা বোঝা যাবে—এই লেখাতে তা আর অন্তর্ভুক্ত করলাম না।

এই রোগের সূত্র, এ কোথা থেকে এলো তা করোনাভাইরাসের মতো আজ অবধি রহস্য রয়েই গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, আফ্রিকার সবুজরঙা এক প্রজাতির বানর দ্বারা মানবদেহে এইডস সংক্রমিত হয়। তবে নির্ভুলভাবে এই তথ্য কখনও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে হবে করেও আর হয়ে উঠলো না।

সমকামী পুরুষ বা হোমোসেক্সচুয়ালদের মলদ্বারে যৌন মিলনের কারণে এইডস রোগ ছড়ালেও পরবর্তীতে কী করে তা সাধারণের দেহে অনুপ্রবেশ করলো? বিজ্ঞান-স্বচ্ছ তদন্তে উঠে আসে যে অনেক উভয় লিঙ্গ (বাইসেক্সচুয়াল) এইডস রোগী তাদের স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ড, পার্টনার ইত্যাদির সঙ্গে যৌন মিলনের কারণে ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিকভাবে এইডস সংক্রমিত করে, যা পরবর্তীতে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীদের ভেতরে এই রোগ সংক্রমণ হওয়ার খবর আসা মাত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে।  

বহু নবজাতক শিশুর ভেতরেও এই রোগ দানা বাঁধে। কেবল তা-ই নয়, যারা সমকামী নন—সুস্থ-সবল স্বাভাবিক মানুষ অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপ্রচারের সময় বা পরের রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণেও সংক্রমিত হয়েছিল। মার্কিনি কিংবদন্তি টেনিস তারকা আর্থার অ্যাশ ১৯৮৩-তে হার্ট বাইপাস অপারেশনের সময় ব্যবহৃত দূষিত রক্তের কারণে এইডস রোগে সংক্রমিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

আর হ্যাঁ, এইডস রোগের ভাইরাস মানবদেহে ১০ বছর অবধি বেঁচে থাকতে পারে। সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে কয়েক লক্ষ মানুষ এইডস রোগ বা তার উপসর্গ এইচআইভি  'ক্যরিয়ার’ বা বাহক। বাংলাদেশেও এ ধরনের বাহকের সংখ্যা নিতান্ত কম না। এই রোগের কোনও ‘কিউর’ বা চিকিৎসা নেই — মৃত্যুই শেষ গন্তব্য।

১৯৯৫-১৯৯৬-এর দিকে বাংলাদেশ থেকে হাজারো লোক প্রতিমাসে থাইল্যান্ড ও পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার সময় পতিতালয়গুলোতে যাওয়া-আসা করে, এই রূঢ় সত্যটাই সম্ভবত রাষ্ট্রকে এইডস বিষয়ে আরও চিন্তায় ফেলে দিলো। বাংলাদেশে এইডস রোগ আছে কিনা সে-নিয়ে বহু বিতর্কে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র চাপে পড়ে সরকার নিশ্চিত হলো যে হ্যাঁ, আছে—এবং কিছু মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার পর পর তারা নড়েচড়ে বসলো।  

সমস্যা দেখা দিলো এই রোগ সম্পর্কে দেশবাসীকে কীভাবে সচেতন করা যাবে, যখন রোগটা কীভাবে ছড়ায় তার বর্ণনা করা খুবই স্পর্শকাতর? রাষ্ট্র বেছে নিলো এই রোগ প্রতিরোধ করা সচেতনতার কর্মসূচির জন্য অদ্ভুত এক ট্যাগলাইন—“বাঁচতে হলে জানতে হবে”।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে ‘কী জানতে হবে?’

সে-সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা ও নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ড আজকের ন্যায় উদার বা সংস্কারমুক্ত ছিল না। তথ্যপ্রবাহ ছিল খুবই সীমিত ও তারচেয়ে সীমিত ছিল সেক্স বা যৌনতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সমাজে আলোচনা করার আগ্রহ। লজ্জা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনীহা, অনিচ্ছা এসব তো বাঙালি চরিত্রের অপরিহার্য অংশ। এখন যেমন মাস্ক পরলে বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলে করোনা থেকে সহজে বাঁচা যাবে বলা হচ্ছে– এইডস প্রতিরোধ করার দুটি মূল উপায় জনগণকে বোঝানো বা ‘জানান দেওয়া’ কেবল বিব্রতকর ছিল না, তা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। 

‘অবাধ যৌনাচারসহ অনৈতিক যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা’ (আজকের সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং) ও ‘কনডম ব্যবহার করা’ (আজকের মাস্ক পরিধান করা) এই দুটো উপদেশ জনগণকে দেওয়া চারটিখানি বিষয় কেবল ছিল না– তা ছিল এক মহা চ্যালেঞ্জ। 

যে-দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌনশিক্ষা বা সেক্স-এডুকেশন অনুপস্থিত, যেখানে ‘স্বাভাবিক’ নারী-পুরুষের যৌন মিলন নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও আলাপচারিতা নিরুৎসাহিত করা হয়– সে দেশের জনগণকে পুরুষ-পুরুষের বা নারী-নারীর ‘জটিল’ যৌন মিলন বা সমকামিতার জ্ঞান কী করে দেওয়া সম্ভব? 

ভয়ভীতি, আতঙ্কের চেয়ে আরও মারাত্মক একটা দিক সমাজকে জেঁকে ধরলো। অভিভাবক শ্রেণি ধারণা করা শুরু করলেন ‘ছেলেমেয়েদের সাথে এতটা খোলামেলা আলোচনা করা যাবে না’ বা ‘এসব খোলামেলা আলোচনা করলে ছেলেমেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে’– আরও কত-কী! আজকের সমাজে যে-উদারতা দেখতে পাচ্ছি তার অন্যতম কারণ সেই ‘৯০-দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনেকেই এইডস রোগের কারণেই বাধ্য হয়েছিল যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে সাহসী আলাপচারিতা দাবি করে তা আরম্ভ করতে। এই ডায়লগ এগিয়ে নিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।  

উপরন্তু ছিল ‘ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা’র আদেশ–যা কখনোই ক্ষুদ্র রাজনীতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিল না। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ঘোর বিরোধিতা করতে ‘মোল্লাতন্ত্র’ সব সময় সোচ্চার ছিল। তাদের ধারণা, কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ইত্যাদি ব্যবহার ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদি নাসারার মুসলিমের ইমান নষ্ট করার ষড়যন্ত্র’ বলে যথেষ্ট প্রচার পেতো সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।  

আরেক ঝামেলাপূর্ণ বাস্তবতা ছিল সম্প্রচারমাধ্যম বলতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার, সাথে হাতেগোনা কিছু পত্রিকা ও সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। তাছাড়া বিলবোর্ড ও যানবাহনে হাতে বিলি করা পুস্তিকা। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষণশীলতার ঊর্ধ্বে কখনোই ছিল না। গান, নাটক, বিজ্ঞাপনের ওপরে চলত ক্ষুরধার ‘ভেটিং’ নামের সেন্সরশিপ। এতসব সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকে সৃষ্টিশীল কাজ করতে হতো।  

এইডসের ভয়াবহতা জনগণকে বোঝানোর জন্য রাষ্ট্র অভিনেতা ও সফল বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেনকে দায়িত্ব দিলো এ নিয়ে একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করতে। আমি-সহ অনেক ব্যান্ড সংগীতশিল্পী, গানের শিল্পী, নাটকের শিল্পী, জাতীয় দলের ক্রিকেটার, ফুটবলার ইত্যাদি অর্থাৎ সেই সময়কার যেসব ব্যক্তিকে মিডিয়ার কল্যাণে জনগণ চিনতো তাদের ‘ফেসভ্যালু’ কাজে লাগিয়ে এই মিউজিক ভিডিও অনবরত বিটিভিতে প্রচার শুরু হলো।  

এই প্রচারের ফলে এইডস রোগ কতটা কমেছিল সে-ধারণা করা না-গেলেও পরবর্তী সময়ে এইডস রোগ সম্পর্কে জনসমক্ষে খোলামেলা আলোচনা ছিল লক্ষণীয়। বাড়তি প্রাপ্তি ছিল এইডস নিয়ে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সচেতনতা কর্মসূচি। শুক্রবারের জুমার নামাজে খুতবার সময় সরকার এইডস নিয়ে মুসল্লিদের সচেতন করা বাধ্যতামূলক করলো। কিছুটা রাখঢাক করে, ভদ্রতা বজায় রেখেও যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ হতে পারে তাও দেখার মতো ছিল। যেসব তথ্য প্রকাশ্যে শেয়ার করা যেত না– তা বিস্তারিত বোঝার জন্য তথ্যপুস্তিকা অথবা লিফলেট বিলি করা হতো। 

সেই সময়কার বাস্তবতা থেকে আজকের বাস্তবতার যোজন ফাঁক। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্য সহজলভ্যতার কারণে, এতটাই বেশি আসছে যে ‘ইনফরমেশন ওভারলোড’ বা তথ্যের অত্যধিক বোঝাইয়ের কারণে জনগণ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এই ‘অতি জানার’ যুগে আমরা একেকজন হয়ে যাচ্ছি ‘জানোয়ার’-তুল্য ও অমানুষের মতো হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন আচরণ। করোনা মহামারি নিয়ে এক ভয়াল তথ্যের জলনির্গমন পথ উন্মুক্ত হওয়াতে জনগণ অযাচিত, মিথ্যা, গুজব ও অসংলগ্ন তথ্যের বন্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ-সময়টাতে রাখছে প্রচণ্ড ন্যক্কারজনক ভূমিকা। ভয়, আতঙ্ক ছাড়াও চলছে বিষণ্ণতার মহামারি– আত্মহত্যার হার মহামারিতে মৃত্যুর হারকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। আবার এই কাটাঘার ওপরে লবণ ছিটাচ্ছে গণমাধ্যম। ইদানীং যেকোনও পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের খবর আপাদমস্তক ‘নেগেটিভ’ বা নেতিবাচক। কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। নেই কোনও বিনোদন, নেই কোনও পজিটিভিটির চিহ্ন বা চিত্র। এতকিছু থাকার পরেও ‘নেই নেই’ হাহাকার চতুর্দিকে। মূলত যা ‘নেই’ তা মানুষের মনের শান্তি। অশান্তির মাঝে শান্তির অন্বেষণ কখনোই সুফল বয়ে আনতে পারে না। আজকের বাংলাদেশের জনগণ আবেগপূর্ণ ও ভাবপ্রবণ। দুয়ের সমন্বয়ে বীভৎস এই ‘টকসিক মিক্স’ বা বিষাক্ত মিশ্রণ সমাজ তথা রাষ্ট্রকে ঠেলে দিচ্ছে এমন এক গন্তব্যে যা অতীতে ছিল অভাবনীয়। 

পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘হিউমার’ বা হাসিঠাট্টা যা অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে নেই কারো কোনও ভাবনা। ঈদে টিভির রম্য নাটকগুলো কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা মানুষের বিরক্তি কেবল বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রের করোনা প্রতিরোধ সচেতনতা কর্মসূচি শুধু প্রসাধনী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সুবিধা হয়েছে। সাবান ও স্যানিটিজের এই মুহূর্তে ‘হট কেক’-এর মতো বিক্রি চলছে ঠিকই, তবে তার ফলশ্রুতিতে যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।

হাত ধৌতকরণ নিয়েও আছে ব্যাপক তামাশা। একটি  ‘দায়িত্বশীল টিভি চ্যানেল’ যেমন দিনে ২০ বার হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছে! তা যদি সত্যি সত্যি করা হয় জনপ্রতি দিনে ১০ লিটার বা তার অধিক পানির অপচয়ের কথা কেউ কি একবার চিন্তা করছে? তর্কের খাতিরে ধরা যাক  ১০ কোটি জনগণ যদি দৈনিক ১০ লিটার পানি অপচয় করে, দেশে পানি সংকটের কী ভয়াবহ চিত্র হতে পারে– তা পাঠকরা একটু চিন্তা করুন তো? 

এই মুহূর্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাস্ক পরিধান করা, অথচ সরকারের ‘মাস্ক, মাস্ক ও মাস্ক’ নামের টিভির সচেতনতার বিজ্ঞাপন জনগণের কোন অংশকে টার্গেট করছে তা বোঝা দায়। বিজ্ঞাপনটি কেবল দুর্বল নয়, ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত আলিশান অট্টালিকা ও ঘাসের সুন্দর-করে-কাটা লন– তার ওপর অপরিচিত মডেলের উপদেশ দেখতে ও শুনতে যথেষ্ট ঢোঁক গিলতে হয়। করোনা কি অভিজাত শ্রেণির রোগ ও এ কি কেবল ‘ওই শ্রেণিকে’ সচেতন করার চেষ্টা? এ প্রশ্ন যেকোনও মানুষের মনে আসাটা অস্বাভাবিক মোটেও না। 

মুম্বাইয়ের মুভিগুলোতে ভারতের খুবই নগণ্য ‘ডার্টি রিচ’ বা নোংরা ধনাঢ্য শ্রেণির লোকের আরাম আয়েশী লাইফস্টাইলের সচিত্র বিবরণ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সিনেমা হলগুলোতে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে। অল্প সময়ের জন্য ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়ে সুখের স্বপ্নে বিভোর রাখে। সেই একই স্ট্র্যাটেজি কি রাষ্ট্র নিয়েছিল এই বিজ্ঞাপনের ‘টার্গেট দর্শক’ নির্ণয় করার জন্য? নিয়ে থাকলে তা একেবারে কাজে লাগেনি তা নতুন করে বলার কিছু নেই। 

এত কিছু শক্ত, নম্র ভাষায় বলার পরে, উপদেশের ওপরে উপদেশ দেওয়ার পরেও পথঘাটে দেখা যায় বড় জোর ৪০% জনগণ মাস্ক ব্যবহার করছে–অর্থাৎ যতই চেষ্টা রাষ্ট্র করুক করোনায় আমাদের ভাগ্যের মরণলেখনী খুব সহজে কি মুছে যাবে? অবাধ্য জনগণকে বাধ্য করা অসম্ভব। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আইন করে, ফাইন করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়নি ও যাবে না।

আমাদের সমাজে অত্যন্ত ক্ষতিকর ‘ঢাকাকে সমগ্র বাংলাদেশ অনুসরণ করবে’ মানসিকতা এই ‘টপডাউন’ চিন্তাচেতনা করোনা মহামারির মাঝে আবারও প্রমাণ করলো রাষ্ট্র জনগণের আকাঙ্ক্ষার থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন। দেশের সব সমস্যার সমাধানের ‘সুন্দর চিন্তা’ কিছু সরকারি আমলা, বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদের মাথা থেকে উদ্ভূত হবে– এই ভুল ধারণা আজ আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্তরায়। লকডাউন থেকে শুরু করে মাস্ক পরিধান, প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা যে হোঁচট খেয়েই চলছি তা মূলত এসব গা-ছাড়া, দায়িত্বহীন আদেশ/উপদেশ ও ভুল মেসেজিংয়ের কারণে। একই ইস্যুতে একই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠা থেকে বিভিন্ন সময়-অসময়ে জ্ঞানদাতাদের জ্ঞানদানের প্রচেষ্টা জনগণকে রেখেছে বিভ্রান্ত ও তা করা হচ্ছে জ্ঞাতসারে। 

যতটুকু খবর রাখি তাতে জেনেছি গ্রাম বা মফস্বলের জনগণ মাস্ক পরিধান করলে ‘বাঁচা যাবে’ এই তথ্য কেবল অবিশ্বাস করে না– তারা করোনা মহামারিকে মনে করে ‘ভুয়া’– নতুবা ঢাকা শহরের ‘বড়লোকের রোগ’। যেহেতু ঢাকাসহ অন্য বড় শহরগুলোতে করোনায় মৃত্যুর হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি– এ ধরনের চিন্তা করাটা অযৌক্তিক না হতে পারে, কিন্তু অসচেতনতার কারণে করোনা ও তার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট সমগ্র দেশে ছেয়ে যেতে পারে– সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হবে আত্মঘাতী।  

তাহলে কী করার? 

বহির্বিশ্বে অনেক দেশে জনগণকে মাস্ক পরিধান কার্যক্রমে রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট’, বা জননন্দিত ব্যক্তিবর্গকে কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, পেশাদার খেলোয়াড় ইত্যাদি সবাই মাস্ক পরিধান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাদের নিজ নিজ ভক্তকুলসহ আপামর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। 

এমন কার্যক্রম বাংলাদেশে গেলো ১৪ মাসে দেখা যায়নি, কারণ আমাদের সব সচেতনতা কর্মসূচি স্পষ্টত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু পণ্যের বিক্রয় ও বিপণনের দিকেই লক্ষভূত ও সীমাবদ্ধ। মাস্কের ব্যবসা সে-তুলনায় ক্ষুদ্র বা কুটির শিল্প ও তার ‘অ্যাকটিভ মার্কেটিং’ বা বিক্রয় ও বিপণন নেই, বা তার প্রয়োজনও নেই। সমাজের শুধু উচ্চবিত্তরা হয়তো বা মাস্ককে একটা ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে, তবে সাধারণ জনগণ তা মানুষ-দেখানোর জন্য হয় গলায় অলংকারের মতো ঝুলিয়ে বা পকেটবন্দি করে রাখে। 

এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির প্রয়োজন সেলিব্রিটি এন্ডোর্সমেন্ট। উদাহরণস্বরূপ শিল্পী মমতাজ ও জেমস্ কিংবা ক্রিকেটার মাশরাফি ও সাকিব ছাড়াও অন্য যে-সকল জননন্দিত ব্যক্তিবর্গ তাদের মাস্ক পরিধান কর্মসূচিতে আর্জেন্টলি অন্তর্ভুক্ত করা। যাদের আপামর জনগণ একদৃষ্টিতে চেনে ও আন্তরিকভাবে সমর্থন করে তারা মাস্ক পরিধান করা নিয়ে যদি কিছু বলে, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা কেবল আন্দাজ করা যায়। 

বিজ্ঞাপনগুলো এলোপাথাড়ি না হয়ে হতে হবে টার্গেটেড। এতে রাষ্ট্রের এক পয়সাও খরচ করা লাগবে না। বহুজাতিক-সহ দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে তাদের সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) বাজেট থেকে মাস্ক পরিধান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকার বাধ্যতামূলক আদেশ দিলেই বাকি সবকিছু ঘাপে ঘাপে পড়ে যাবে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। 

বলা হচ্ছে করোনা বহু বছর থাকবে। এইডস ভাইরাসও এখনও জীবিত আছে এবং তাও থাকবে অনেক বছর। ইতোমধ্যে জনগণকে সচেতন করার যত রকম কর্মসূচি সম্ভব তা চালিয়ে যেতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না সেই পুরনো জামানায় রাষ্ট্র যা করেছিল তার নাম আজকের প্রেক্ষাপটে ছিল সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট। অত্যন্ত প্রতিকূল সময়ে ১৯৯৫-’৯৬-তে যেমন কর্মসূচি এইডস ভাইরাস নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সে-রকম কি করোনাভাইরাসের ব্যাপারেও ভেবে দেখা যায়? 

লেখক: সংগীতশিল্পী

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ