X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

গর্জন আর বর্ষণের বাইরেও

মানস চৌধুরী
০৯ জানুয়ারি ২০১৬, ১৪:৪৪আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:৪৭

মানস চৌধুরী পাকিস্তানের সাহসী তেজস্বী সাংবাদিক হামিদ মীর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘ফরেন ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পুরস্কার করতে আসার আগে থেকেই বাংলাদেশে তিনি মিত্র হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে তিনি তার আগে থেকেই হিরো। পুরস্কারটি তিনি নিতে এসেছিলেন তার প্রয়াত বাবা অধ্যাপক ওয়ারিস মীরের তরফে, যিনি মুক্তযুদ্ধের আগে থেকেই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের নিপীড়ন-অন্যায় বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।
হামিদ মীর নিজে এর আগে থেকে লাগাতার এই বিষয়ে তার স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করে আসছিলেন। তার কলামে, সাক্ষাৎকারে, মতামতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, পাকিস্তানের সামরিক নির্যাতন নিয়ে, সেই বিষয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিশ্চুপতা নিয়ে মীর অত্যন্ত সমালোচনামুখর। খুব একটা রাখঢাক কৌশলী উত্তরের আশ্রয়ও তিনি নেননি। ১৯৭১-এ পাকিস্তানের ভূমিকার জন্য তাদের যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত সেটাও স্পষ্টভাষাতেই উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। একাধিকবার। বাংলাদেশে আসবার আগেই তিনি অনায়াসে স্বাধীনতাপ্রিয় বাংলাদেশবাসীর সম্মান ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এসে বাবার পক্ষে পুরস্কার নেবার কালে সেটা আরও পোক্ত হয়। আবার বাংলাদেশে নানাবিধ রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্ভাবনা সৃষ্টি করে যান।
কিংবদন্তী ক্রিকেটার ইমরান খান রাজনীতির মঞ্চে এসে অবধি বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক ভূমিকা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা দেখাননি। কিংবা নিস্পৃহতা দেখিয়েছিলেন। যারা তার রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে অদৃশ্য সামরিক পক্ষের যোগাযোগের সম্পর্ক দেখেন তারা সেটার সঙ্গেই তার এই নিস্পৃহতাকে মিলিয়ে পাঠ করেছেন। তিনিও রাজনৈতিক জীবনের একটা পর্যায়ে ৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনিও স্পষ্টভাষাতে পাকিস্তানের ক্ষমা চাইবার পক্ষে মতামত দেন। এমনকি একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এই ক্ষমাপ্রার্থনা করতে তিনি আহ্বানও জানান।

ইমরান বা হামিদ কারোর জন্যই নিজ দেশে এসব ভূমিকা বিশেষ নন্দিত হয়নি। সেটা বোঝার জন্য বিশেষ কোনওরকম বিশ্লেষক হবার প্রয়োজন নেই। সাধারণ বুদ্ধিতে ভাবলেই চলে। আর আরও হাতেকলমে প্রমাণ চাইলে ইন্টারনেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে যে কেউ দেখতে পারেন। হামিদের ভূমিকা ইমরানের থেকে লাগাতার আর বলিষ্ঠ। ফলে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু তিনিই বেশি। সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকজন পর্যন্ত হামিদকে যা-নয়-তাই বলে গালমন্দ করেছে। ‘গাদ্দার’ বা ‘প্রতারক’ এর মতো গালাগালই বরং নিরীহ শোনাতে পারে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে তাকে দেশের পাসপোর্ট বিসর্জন দিতেও ধামকি দিয়েছে।

পরের বছর হামিদ মীরকে লক্ষ্য করে ‘দুষ্কৃতিকারী’রা গুলি ছোঁড়ে। কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার পাবার মাসেই তিনি পরের বছর আক্রান্ত হন। কাছে থেকে ৬/৭ রাউন্ড গুলি লাগার পরও সফল অস্ত্রোপচার করবার পর কপালগুণে তিনি বেঁচে যান। তিনি নিজে দ্বিধাহীনভাবে আইএসআইকে এই আক্রমণের জন্য দায়ী করেন। পাকিস্তানের মধ্যকার নানাবিধ রাজনৈতিক কূটচাল পর্যালোচনা করলে, আর মীরের ধারাবাহিক সাহসী কর্মকা- বিবেচনা করলে, এই দোষারোপের কারণ বোঝা যায়। হামলা যারাই করে থাকুক না কেন, হামিদ মীর তার সাহসী ভূমিকার কারণে নিজ দেশেও ক্রমাগত শত্রু বাড়িয়ে চলছেন সেই বাস্তবতাটাকে হিসেবে আনা দরকার। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতি তার ও তার বাবার অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়টাও তাহলে আর বিযুক্ত নয়।

এসব কথা মনে এলো অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ঘোষণা লক্ষ্য করে। ডিসেম্বর মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবার ঘোষণা দেন। এই ঘটনাটি ঘটার কালে আমি দেশের বাইরে ছিলাম। হয়তো একটু দেরি হতো খবরটির নাগাল পেতে। কিন্তু পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ এর অবধারিত পরিণতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচিকৃত একটা সেমিনার স্থগিত করা হয় যেখানে সদ্যপরিচিত এক ভারতীয় অধ্যাপক বন্ধু আসবেন বলে খুশি হচ্ছিলাম।

গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সরকার যেসব ভূমিকা নিয়েছে তাতে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নানাবিধ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষজন ক্ষোভে আর ক্রোধে যে ফুঁসবেন সেটাকেও সঙ্গতই লাগে। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত নেবার ভঙ্গি সবিশেষ চিন্তিত করেছে আমাকে। কথা হচ্ছে একটা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। এর বুদ্ধিবৃত্তিক দায়দায়িত্ব নিয়ে, রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে চিন্তনের সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গে। চিন্তাটা প্রাসঙ্গিকই ছিল আমার। ফিরে এসেই লক্ষ্য করলাম ঢা.বি. কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত কেবল জনপ্রিয়তাই পায়নি, অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়কেও এই নিবিড় জাতীয়তাবাদী ঘোষণাটি দেবার জন্য সাইবার জগতে আহ্বান জানানো শুরু হয়ে গেছে।

আমি একটুও অবাক হইনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকাকে দেখা হচ্ছে সাহসী আর অগ্রসর হিসেবে। আর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে ব্রতী হওয়ার জন্য যে আহ্বান জানানো হচ্ছে তা অচিরেই সামাজিক চাপ হিসেবে আবির্ভূত হবে। ফলে জোয়ারটা কমবেশি একটু চালু থাকলেই ‘পপুলার’ এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় নিতে শুরু করবে। গত দুদিন ধরে একটা সাইবার গ্রুপ চোখে পড়ছে যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে এই পদক্ষেপ নেবার জন্য চাপ দিতে তৈরি হয়েছে। আমি অবাক নই। কিন্তু কেন পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তথা পাকিস্তানে বাংলাদেশী দূতাবাস বন্ধ করতে চাপ দেবার আগেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাপ দেয়া হচ্ছে। কেনই বা এরকম প্রতিষ্ঠানের এই পপুলার ভার নিতে হবে? কে না জানে যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছেদই এসব ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সম্ভাব্য পদক্ষেপ। সেটা সেরা পদক্ষেপ কিনা তা আরেক প্রসঙ্গ।   

একটা বিশ্ববিদ্যালয় আর পাঁচটা সরকারি দফতর কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে কূটনৈতিক অফিসের মতো করে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না। এমনকি জনপ্রিয় কোনও বৃহত্তর দাবির সঙ্গেই প্রশ্নাতীতভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে না। পারে না বলতে এরকম ভূমিকা নেয়া আখেরে বিপজ্জনক। বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ, আর জাতীয়তাবাদী ডামাডোল অনুভূতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ কিছুতেই এক রাজনৈতিক মাত্রার ভূমিকা নয়। সর্বোপরি রাষ্ট্রের পরিচালক বর্গের এজেন্ডার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নাতীত সংমিশ্রণ আরো বিপজ্জনক। যাদের বিষয়টা বুঝতে কষ্ট হবে তারা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভারতের বিশ্ববিদ্যাগুলোর উপর হস্তক্ষেপ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তৎপরতা লক্ষ্য করলেই বুঝবেন। 

কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকা বিপজ্জনক? কারণটা খুবই সোজা। একটু আগে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলার সাম্প্রতিক তৎপরতার কথা বলছিলাম। অনেকেরই এতে ভাল লাগবে না? বিজেপি আর বাংলাদেশের সেক্যুলার দল এক হলো? এক নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এরকম সস্তা জাতীয়তাবাদী আর সাদাকালো অবস্থান নিলে হামিদ মীরগণ বাংলাদেশে আর কোনো মিত্র প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাবেন না। কথা একজন হামিদ মীরকে নিয়ে হচ্ছেও না। আমি জানি হামিদ মীর আর গ্রহণীয় উদাহরণ নেই। জানি বা না জানি, পড়ি বা না পড়ি, সকলেই হামিদ মীরের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল নিয়ে প্রশ্নমনস্ক বিশ্লেষণ আর পছন্দ করেননি। এক বছর আগের মিত্রই এখন পরম শত্রুতে পর্যবসিত। আমি এও জানি যে আমার এই রচনা আমাকেও বিশেষ জনপ্রিয় বানাবে না।

পরিশেষে আমাদের একজনের জনপ্রিয়তা মুখ্য বিষয় নয়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বিদ্বেষ আর ঘৃণার কাঠামো হয়তো নিরাপত্তার প্রশ্নটাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। জনসমাজে যাই থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সমালোচনামনস্ক আরেকটু বড় পরিমণ্ডল নিশ্চিত করতে পারা জরুরি। কোনো একটা পক্ষে ঝাণ্ডা না ওড়ালেই কিংবা কোনও একটা ব্যবস্থার সমালোচনা করলেই পাকিস্তানের সমর্থক বানিয়ে ফেলার প্রবণতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরে থাকা দরকার। পত্রিকা/প্রেসগুলোরও এই চক্করে না পড়া খুব জরুরি।

কদিন আগে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের নামোল্লেখ করে এই পত্রিকারই কলামে একজন কলামলেখক আক্রমণ করেছেন। তাকে কলামলেখক পাকিস্তানপন্থী দেখানোর চেষ্টা করেছেন। পুরো রচনায় এই নামোল্লেখ বিশেষ আবশ্যকও ছিল না। যার নাম বলা হয়েছে তার প্রতি ক্রোধ বা বিদ্বেষ ছাড়া পাকিস্তানপন্থী বানানো সমূহ কঠিন ও অসম্ভব। সেটা মুখ্য প্রসঙ্গ নয় এবং অন্যত্র আলাপ হবে বলে আশা রাখি। আমার দুশ্চিন্তার জায়গা এই আলগা ক্রোধ ও বিদ্বেষ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলগতভাবে এর থেকে গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু কাঠামো নিশ্চিত করতে পারা একান্ত জরুরি।

দেশাত্মবোধ এত সস্তা ঠুনকো নয় যে পাকিস্তানের গণতন্ত্রী সহকর্মীর সঙ্গে আমার সংমিশ্রণে তা বিনষ্ট হবে। তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘ফরেন ফ্রেন্ডস’ পুরস্কারে কোনও পাকিস্তানীর অন্তর্ভুক্তিরই সুযোগ ছিল না। দেশাত্মবোধ সস্তা জাতীয়তাবাদের পতাকা বহনও নয়। তল্পিবহন আর জ্ঞানচর্চার মধ্যে প্রভেদ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। ভয়ানক দুশ্চিন্তার কথা!

লেখক: জা.বি.তে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক; আর বিশ্লেষক, গল্পকার. অভিনেতা, সম্পাদক। 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ