X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্খ ঘোষ : নীরব জল, প্রতিবাদের শিখা

গৌতম গুহ রায়
০১ জুন ২০২১, ১১:৪১আপডেট : ০১ জুন ২০২১, ১১:৪৬

‘আমারই রাতের স্নেহে ফুটেছিল এই গন্ধরাজ
যে কোনো ঘাসের গায়ে আমারই পায়ের স্মৃতি ছিল
আমারই তো পাশে পাশে জেগে ছিল অজয়ের জল
আবারও সে নেমে গেছে আমারই চোখের ছোঁয়া নিয়ে।
...
তোমাদের পায়ে পায়ে আমারও জড়ানো ছিলো পা
তোমরা জানোনি তাকে, ফিরেও চাওনি তার দিকে
দুধারে তাকিয়ে দেখো ভেঙে আছে সবগুলি সাঁকো
কোনখানে যাব আর যদি আজ চলে যেতে বলো।’
[মাটি : শঙ্খ ঘোষ]

সময়টা বাংলার কালবৈশাখীর কাল। আচমকা আকাশ কালো করে আসা প্রবলঝড়ের মুহুর্মুহু আক্রমণের সময়েই সবচেয়ে বড় আঘাতটা এলো, বাংলার বিবেকীস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখানো কবি যখন অন্তিম শ্বাস নিলেন তখন তাঁর বয়সের হিসাবে প্রায় নব্বই, এই ‘চলে যাওয়া’টাকে ‘যথাসময়’-এ বলা যায় হয়তো কিন্তু সময়টা যথাযথ নয় এ কথা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়। ২১শে এপ্রিল সকালে দুঃসংবাদটা জানার পরপরই আমার শিক্ষক ড. তপোধীর ভট্টাচার্য মেসেজ করলেন, ‘আজ সকাল ৮টায় ফ্যাসিবাদী শ্মশানচণ্ডাল কবলিত বাঙ্গালী তাঁর অনমনীয় মেরুদণ্ড ও চিরজাগ্রত বিবেক কবি ও পথপ্রদর্শক ভাবুক শঙ্খ ঘোষকে হারাল। পিশাচ-দানব ও তাদের প্রেতসেনার তাণ্ডবে বাংলা যখন আত্মস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জমান, কোথাও কোনো বাতিঘর রইল না।’
আমাদের সময়, দেশ বহুমুখী বিপর্যয়ের মুখে আজ। আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাজ আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সামনে। মানবতার দৈনন্দিন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো অন্ধকারের দিকে এই মৃত্যুযাত্রা আমাদের। এই সময় সবচেয়ে বিবেকী স্বর, আমাদের একমাত্র ছায়াবৃক্ষটিও অন্তর্হিত হলো। ধ্বংসের প্রান্তরে বসে যার উচ্চারণে ছিল জীবন মন্ত্র:

‘পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’

কবিতায়, প্রবন্ধে, রবীন্দ্রনাথকে পুনঃপুনঃ আবিষ্কারে, প্রত্যক্ষ সামাজিক সক্রিয়তায় অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে প্রায় নয় দশকের যাপিত জীবনের গোটাটাই তাঁর আমাদের সামনে উদাহরণ, স্থিতধী এক ‘চির প্রণম্য অগ্নি’। পুরাণকে, আদি আখ্যানকে বারংবার পুনর্নিমাণের মধ্যদিয়ে সঞ্জিবনী জিজ্ঞাসা রেখে গেছেন অনুকরণীয় শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। ‘জাবাল-সত্যকাম’এর নির্জন রাখাল সত্যকামের মুখ দিয়ে আমাদের, সমসময়ের পাঠকের সামনে তিনি রাখেন সেই অমোঘ প্রশ্নটি, ‘কী আমার পরিচয় মা?’ এই মা তাঁর ধরিত্রী, এই নির্জনতা তাঁর অভিষ্ঠ সাধনধাম যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধ্রুব শব্দ ‘সত্য’। এই সত্য বারেবারে তাঁর লেখায়, কথায় এসেছে, যেমন নীরব অনুভবের সাধনার কথা এসেছে, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও’। এই সত্যের একান্ত নীরবতার কাছে বিসর্জিত শঙ্খ ঘোষ তাই উন-নব্বই বছরের যাপিত জীবনে রয়ে গেছেন শিরদাঁড়া সোজা রাখা এক আপোষহীন প্রতীক মানুষ, ‘আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে লিপ্ত হওয়ার সন্ন্যাস যাঁর’ তিনিই তো লিখতে পারেন ‘মজ্জার ভিতরে গর্ব কই, উপেক্ষা কই? মুখ ঘুরিয়ে উদাসীন সরে দাঁড়ানো কই? এখন আমরা দাম্ভিক কিন্তু গর্বিত নই, নির্জীব কিন্তু উদাসীন নই, লুপ্ত কিন্তু লিপ্ত নই।’
পরম সুহৃদ অশ্রুকুমার সিকদার বন্ধু শঙ্খকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন– “একজন কবির নিজস্ব নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় একেবারে গোড়া থেকেই। আমাদের অস্তিত্বের একটা দিক আত্মিকতার কেন্দ্রে থাকে, অন্য একটা দিক থাকে বাইরে মুখ-ফেরানো। বিশ্বগত আর ব্যক্তিগত সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়, সমন্বিত হয়। সমগ্র সত্তার স্বরূপে তিনি দেখেন বিশ্বকে, সমগ্র সত্তার মধ্যদিয়েই জীবনকে পেতে চান শঙ্খ ঘোষ, তাই স্বার্থের স্থানীয় সমীকরণের গণ্ডি তাঁকে আক্রান্ত করে, ন্যূব্জ করতে পারে না। তিনি আত্মমন্থন জাত উচ্চারণে লিখতে পারেন ‘ঘর যায় পথ যায় প্রিয় যায় পরিচিত যায়/সমস্ত মিলায়/এমন মুহূর্ত আসে যেন তুমি একা/দাঁড়িয়েছ মুহূর্তের টিলার উপরে, আর জল/সব ধারে ধাবমান জল/প্লাবন করেছে সত্তা ঘরহীন পথহীন প্রিয়হীন পরিচিতিহীন/আর, তুমি একা/এত ছোটো দুটি হাত স্তব্ধ করে ধরেছ করোটি/মহাসময়ের শূন্যতলে...।’ এই মহাসময়ে তাঁর প্রয়াণ তাই এক অসীম শূন্যতা এনে দিলো।”

‘ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে রাখে কেবল দূরের
মাটি, আমার বিলীয়মান মাটি।’

পূর্ববঙ্গের বরিশালের বানিয়াপাড়া থেকে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁরা পূর্বপুরুষও চলে আসেন এই পশ্চিম বাংলায়। বাবা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, মা অমলা ঘোষ। ১৯৩২এর ৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ, ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠেন শঙ্খ নামে। বাবার কর্মস্থল পাবনায় শৈশব ও কৈশোর কাটে তাঁর। পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেন। পরবর্তীকালে শিক্ষার জন্য, পেশার জন্য নগর কলকাতা তাঁর আবাস হলেও পূর্ববঙ্গ বা অবিভক্ত বাংলাদেশ তাঁর স্মৃতি ও সত্তায় জাগরিত ছিলো আজীবন। আত্মপ্রসঙ্গে তিনি তাই লিখেছেন যে, ‘এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে–শব্দে বা প্রতিমায়–বাংলাদেশই প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই।... এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের মধ্যেই।’ ১৯৫১তে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলা বিভাগে বাংলায় স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার মতো তিনিও গোটা জীবন শিক্ষকতা করে যান। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। এই সময়কালে তাঁর রবীন্দ্রবিষয়কচর্চা বিদগ্ধজনের চর্চায় আসে, তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। বাংলার আপামর সাহিত্যপ্রেমীর কাছে যদিও কবি পরিচয়েই শঙ্খ ঘোষ ক্রমশ মুখ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু ব্যক্তি মানুষ নয় তাঁর অন্বিষ্ট ছিলো মানবতার সমগ্রতায়, পরিপার্শ্বের প্রতি সংবেদনময় অবস্থান ছিলো তাঁর কাছে গুরুত্ত্বপূর্ণ ও মুখ্য। এই কারণেই সামাজিক মানুষের ওপর যখন কোনো আঘাত এসেছে তিনি সক্রিয় থেকেছেন প্রতিবাদে। সেই প্রতিবাদের উচ্চারণ পঞ্চাশের খাদ্য আন্দোলনের প্রতিবাদীদের ওপর গুলি চালনার প্রতিবাদ থেকে সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ থেকে নন্দীগ্রাম বা কামদনি কাণ্ড, নীরব থাকেনি শঙ্খনাদ। তাঁর সংবেদনী ও যন্ত্রণাকাতর অন্তর থেকে উচ্চারিত হয় তিরস্কার:

‘...চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু’
[আয়ু : মূর্খ বড় সামাজিক নয়]

শঙ্খ ঘোষের অকৃত্রিম সাথি ছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বন্ধুর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অলোকরঞ্জন লিখেছেন, “যে সমীপসময়ের বিশ্বসাহিত্য ও দেশজ কবিতার কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত যেসমস্ত শিল্পকৃতির উদাহরণ তিনি জুগিয়েছেন এবং সেই সূত্রে এই শতাব্দীর কাছে আমাদের ঋদ্ধি ঋণের যে অঙ্গীকার জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তা থেকে প্রতিপন্ন হয়, জীবন ও সাহিত্যের সমীকরণের ঐ দুই কিংবা অনুরূপ আরো জনকয়েক পুরোহিতের ব্যাসার্ধ থেকে অনেক দুরূহসাধ্য ক্ষণসাম্প্রতে তাঁর জাগর ঔৎসুক্যের ঠিকানা। এক হিসেবে তিনি ভারতীয় ও ইউরোপিয় সাহিত্য দর্পণে শীলিত মনস্কতা দস্তুরমতো নেপথ্যে রেখে এভাবেই বেরিয়ে পড়েন কালান্তরের অমীমাংসিত আবর্তগুলির দিকে।”
এখানেই সূচিত হয় কবির দ্বিতীয় প্রস্বর, এরই প্রথম স্বননে ‘প্রতিবাদ ও ভালোবাসা’ যেন এক বিন্দুতে মিলে যায় তাঁর কবিতায়।
শিল্পীর স্ববিবেক বাঁচিয়ে রাখার সংকল্পের বীজ তাঁর অন্তরে অঙ্কুরিত হয়েছিল একেবারে গোড়ার দিকেই। সত্তরের ইন্দিরা জামানার জরুরি অবস্থা, নকশাল দমনের নামে রাষ্ট্র কতৃক নামিয়ে আনা দমনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের উচ্চারণে দ্বিধা করেননি মৃদুভাষী শঙ্খ ঘোষ। শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন নিয়ে যখন এই বাংলার তারুণ্য নিজেদের বুকের হৃৎপিণ্ডটাকে উৎসর্গ করছে সেই সময় তাঁদের শিক্ষকের কলম নিশ্চুপ থাকতে পারে না, লেখেন:

‘তোমারই সেন্ট্রাল জেলে,
তোমারই কার্জন পার্কে।’

এভাবেই লিখে যান,
‘চিতা যখন জ্বলছে, আমার হৃৎকমলে
ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে
এই তো আমার
এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা।’

শঙ্খ ঘোষের প্রিয় ছাত্রদের একজন তিমিরবরণ সিংহ। ‘কবিতার মুহূর্তে’তে লিখেছেন, ‘অনার্স ক্লাসে এসে ভর্তি হলো যখন, তরুণ লাবণ্যময় মুখ, উজ্জ্বল চোখ, নম্র আর লাজুক।... তারপর একবছর বিদেশে কাটাবার পর যখন ফিরে এসেছি আবার আটষট্টিতে, তিমিরের মুখের রেখায় অনেক বদল হয়ে গেছে ততদিনে। কেবল তিমিরের নয়, অনেক যুবকেরই তখন পালটে গেছে আদল, অনেকেরই মনে হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ দেশের মুক্তির পথ, সেপথে মেতে উঠেছে অনেকের মতো তিমিরও।’ এরপর একদিন বইয়ের একটি তালিকা নিয়ে ছাত্র আসে শিক্ষকের কাছে। ‘ফেরত পেতে দেরি হবে অনেক। এখন তো দেখা হবে না অনেকদিন’। ‘অনেকদিন আর কোথায়? তোমাদের এম.এ. ক্লাস শুরু হতে খুব তো বেশি দেরি নেই আর।’ অল্প খানিকক্ষণ নিচু-মুখে বসে রইল তিমির, বলল তারপর : ‘কিন্তু এম.এ. পড়ছি না আমি। পড়ে কোনো লাভ নেই। কোনো লাভ নেই এইসব পড়াশোনায়। আপনি কি মনে করেন, না-পড়লে কোনো ক্ষতি আছে?... গ্রামে চলে যাচ্ছি আমি। কোথায় থাকব, কবে ফিরব, কিছুই ঠিক নেই। বইগুলো সঙ্গে থাকলে একটু সুবিধা হবে আমার।’ এই তিমির ‘কিন্তু ধরাও পড়ে একদিন। আর তারপর, আবার একদিন, কয়েকজন সহবন্দির সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে মারে পুলিশ―সে খবরও কানে এসে পৌঁছয়।’ তিমিরের মতো আত্মবলিপ্রদত্ত ছাত্রদের ভুলতে পারেননি শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। লিখছেন, ‘কুয়াশাভরা সন্ধ্যায় ময়দানের কাছে গাড়ি বাঁক নিতেই দ্রুত ফুটে উঠল কয়েকটা ছবি। এই সেই ময়দান, যেখানে ভোররাতে পুলিশের হাতে কত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে অনায়াসে, পড়ে থেকেছে কত রক্তাক্ত শরীর। মনে পড়ল তিমিরকে। মনে পড়ল তাঁর মাকে, যাকে আমি দেখিইনি কখনো।’ কবিতা লিখলেন তিনি―

‘ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।’

এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি বা মুক্তি চাননি কবি। এর অনেক দিন পরেও নিজের বাসার বারান্দা থেকে দেখতে থাকা বৃষ্টি ও বিদ্যুতের মধ্যেও ফিরে আসে তিমিরেরা।

‘ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ
চুরমার ফেটে যায় মেঘ,
দশভাগে দশটানে বিদ্যুৎ
তারপর সব চুপ
এই তোমার মুখ, তিমির
কিন্তু তারপর সব চুপ।’

দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক চেহারাটা অনেক পাল্টে যাওয়ার পরেও শঙ্খ ঘোষ তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুত হননি। ‘কলকাতা’ সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্তকে লেখা একটি চিঠির অবতারণা এই প্রসঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক। নব কলেবরে প্রকাশিত ‘কলকাতা দু-হাজার’-এর লেখক পরিচিতিতে দুঁদে পুলিশ অফিসার রঞ্জিত গুপ্ত-এর পরিচিতিতে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধের প্রতিবাদে সম্পাদক ‘প্রিয় জ্যোতি’কে চিঠি লেখেন তিনি। লেখক পরিচিতির পাতায় লেখা ছিল : ‘হ্যাঁ, এই সনেট-অনুবাদক রঞ্জিত গুপ্ত’ই হচ্ছেন সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ কমিশনার, পোলো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, নৃতাত্ত্বিক, চাষি এবং ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট রঞ্জিত গুপ্ত আই পি।’ শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, ‘...ভাবনাটা আলোড়িত হলো পরিচয় জানাবার বিশেষ এই পদ্ধতিতে, বিশেষণের এই মর্মান্তিক নির্বাচনে, এই সগৌরব ঘোষণায় যে ইনিই সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ অফিসার।... অনুমান করি যে এ-উল্লেখ আপনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু লেখকের বৈচিত্র্যটুকুই, এমন কী হয়তো আত্মবিরোধটাই, পোলো খেলা এবং নকশাল-দমনের এই চমকপদ সহাবস্থান, বিবরণে সম্পূর্ণতার গরজ ছাড়া ওখানে নিশ্চই আর কোনো রকম অতিরিক্ত অভিপ্রায় কাজ করেনি। অথচ এই কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ যে মুহূর্তমধ্যে আমার মতো অনেক পাঠকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে ওঠে এক বিষাক্ত ছোবল নিয়ে, সেকথাও সত্যি।... ওই ‘দমন’ শব্দটি শুনবার সঙ্গে সঙ্গে পনেরো বছরের পুরোনো ছবিগুলি আবার জেগে উঠতে থাকে আমাদের চোখের সামনে, জেগে ওঠে কত-না স্বজন বন্ধু ছাত্রছাত্রী অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের মুখ, আমার আপনার সকলেরই বেশ চেনাজানা, কিছু-বা সংকল্পে উজ্জ্বল, কিছু–বা নির্যাতনে বধির, যারা অনেকেই হয়তো বিভ্রান্ত ছিল সেদিন, কিন্তু যাঁদের আর্ত কল্পনার সামনে ছিল মস্ত এক সুস্থ দিনের স্বপ্ন।... সভ্যতা আর মানবতার এই শব্দদুটি যখন আজ পড়ি, তখন মনে পড়ে বেলেঘাটার কথা, বরানগরের কথা, দমদম আর বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের অন্তর্গত নৃশংস আর অবাধ হত্যাকাণ্ডের কথা, মানবতাকেই যার প্রধান ভিত্তি বলে বিবেচনা করা শক্তই ছিল সেদিন। দমনের এই বিভীষিকাময় দিনগুলি কি আজও কিছু কিছু মনে পড়ে আপনার?’
এটি নিছক এক বন্ধু সম্পাদককের কাছে এক কবির অন্তর্গত যন্ত্রণার ভাষ্য নয়, সময়ের গভীর তত্ত্বতলাশ। ‘কী হয়েছিলো সেই দমন প্রক্রিয়া, সেটা ভাববার আগে লক্ষ করা দরকার এই বিশৃঙ্খলার চরিত্রটা। নকশালপন্থি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে, যেকোনো কৌশলেই হোক, মিশে গেল লুম্পেন প্রোলিটারিয়েটরা। আবার লুম্পেন প্রোলিটায়েটদেরই প্রয়োগ করা হলো এদের ধ্বংস করবারও কাজে, এর বিবরণ রঞ্জিত গুপ্ত নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু তার বিবরণে তিনি স্পষ্টত বলেননি জেল বা জেলের বাইরে সেই রাজনৈতিক ছেলেমেয়েদের কথা, যারা লুম্পেন নয়, ওই ফাঁদে জড়িয়ে নিয়ে যাদের ওপর পুলিশি মত্ততা চলেছিল উৎকট হিংস্রতায়। উনিশশো সত্তরের জুলাই থেকে পুলিশ কমিশনার হন রঞ্জিত গুপ্ত, আর আমাদের মনে পড়ে সে-বছরেরই নভেম্বরের এক ভোররাতে, যখন বেলেঘাটার পাঁচশো বাড়িতে হানা দিয়ে চুয়াল্লিশটি পুলিশভ্যান টেনে বার করে কিছু স্কুলকলেজের ছাত্রকে, আর প্রমাণহীন বিচারহীনভাবে চারজনকে গুলি করে মেরে ফেলে সেখানেই, প্রকাশ্য অঞ্চলে। শ্যামপুকুর পার্কের কাছে চৌদ্দ বছর বয়সের টাইফয়েড আক্রান্ত একটি ছেলেকে পথে নিয়ে এসে দিনের আলোয় খুন করে পুলিশ, শ্যামপুকুর রোডে ডেপুটি কমিশনার নিজেরই হাতে গুলি করেন দুজনকে, বেলঘরিয়াতেও ঘটে একইরকম ঘটনা।... প্রতিটি মধ্যরাতে পুলিশ শ্মশানঘাটে নিয়ে আসে চৌদ্দ থেকে তিরিশ বছরের অন্তর্গত অসংখ্য যুবাকিশোরের দগ্ধ শরীর, ...অথবা ভাবুন একাত্তর সালের চব্বিশ ফেব্রুয়ারিতে বহরমপুর জেলের কথা। বেয়নেট আর লাঠি দিয়ে চারজনকে পিটিয়ে মারা হয় সেলের অভ্যন্তরে, তিনজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে পৌঁছে আরো একজন পরে। দমদম সেন্ট্রাল জেলে একইভাবে হত্যা করা হলো একদিন ষোলোটি ছেলেকে, আহত আরো অগণ্য। কিংবা ভাবুন বরানগরের-কাশীপুরের সেই হিংস্র আরণ্যক দিনদুটির কথা, বারো আর তেরোই আগস্ট, যখন তালিকাচিহ্নিত করে দেড়শো ছাত্রকে খুন করা হলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে, পথের মোড়ে লটকে দেওয়া হলো নাম, সকলের অভিজ্ঞতার সামনে, যেন প্রশাসনহীন জগতে।’
১৯৮৫তে লেখা এই চিঠিতে আমরা যে মানুষটিকে পাই সে গরল পানের স্মৃতিদগ্ধ ক্ষুব্ধ এক কবি, সামাজিক অবদমনের বিরুদ্ধে সমকালের প্রধান সংবেদনশীল ‘এক্টিভিস্ট’।
জরুরি অবস্থার সময় নিজের অবস্থানে অটুট থাকার জন্য খেসারত দিতে হয়েছিলো তাঁকে। ১৯৭৫’এ ১৮ মাসব্যাপী জরুরি অবস্থার অন্ধকার সময়ে শুধু বিরোধী মত ও দলের মানুষদের অবরুদ্ধই করা হয়নি, বহু সংবাদপত্র, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা হয়েছিলো। ব্যাতিক্রম ঘটেনি শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রেও। ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নিজে চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর কবিতা, কিন্তু ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞায়’ ছাপতে পারেননি! সাগরময় ঘোষ সসংকোচে অন্য লেখা দিতে বললেন। উত্তরে শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘অন্য কোনো কবিতা তো পারব না পাঠাতে। কেননা যা কিছু লিখছি এখন, তার সবটাই তো ও-রকম সরকারি হুকুম নিয়ে ফিরে আসতে পারে।’ সেবার আর লেখা দেননি। ইন্দরার সেই সময়ে শঙ্খ বাবুর শর্ত ছিল অবিকৃত ভাবেই তাঁর লেখা ছাপানোর সাহস দেখালেই সম্পাদককে লেখা দেবেন। এই শর্তে অনেক সম্পাদক পিছিয়ে আসলেও বার্ণিক রায়, অরুণ সেনেরা এই শর্তেই লেখা ছাপেন। ‘লা পয়েজি’ ও ‘সাহিত্যপত্র’এ ছাপা হয় ‘রাধাচূড়া’ ও ‘আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’।
জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্র শাসকের রক্তচক্ষুকে কুর্ণিশ না জানানো কবি শঙ্খ ঘোষের আরো অনেকগুলো অভিজ্ঞতা আছে। একবার সরকার নিয়ন্ত্রনাধীন দুরদর্শনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন আর অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সেখানে ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’ নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়জন করা হয়েছিলো। হঠাৎ অনুষ্ঠান পরিচলক শঙ্খ ঘোষকে জানান যে স্টেশান ডিরেক্টারের আপত্তিতে তাঁকে একটি লাইন পাল্টাতে হবে। লাইনটি হলো, ‘তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা’। দর্শকের কানে যদি ‘ইন্দ্র’ শব্দটি ‘ইন্দিরা’ হয়ে প্রবেশ করে এই ভয়ে সেই শব্দটি পাল্টাতে বলা হয়। এমনই আরও অভিজ্ঞতা ছিলো তাঁর, একবার ‘আকাশবাণী’তে অনুষ্ঠান করছেন তিনি ও কবিতা সিংহ। সরকারি বেতার কর্তৃপক্ষ কবিতা সিংহের লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্প থেকে নেওয়া অংশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে শঙ্খ ঘোষ এই অংশটি বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন, বলেন যে বাদ দিলে গোটাটাই বাদ দিতে হবে। এই দৃঢ়তা সবাই সেই সময় দেখাতে পারেননি, যেটা শঙ্খ ঘোষ পেরেছিলেন। ‘কবিতার মুহূর্তে’তে লিখেছেন, ‘অপমান বোধ হয়। অপমান বোধ হয়, ভয় দেখিয়ে শাসন করবার এই লজ্জাহীন ফ্যাসিস্ট আয়োজন দেখে। স্ট্রেটেজি হিসাবে অনেকে চুপ থাকতে চান সত্যি, কিন্তু প্রতিবাদে এগিয়ে এসে পুলিশের কাছে তাড়িতও হন অনেকে গোটা দেশজুড়ে। দিল্লির মসনদ কি জানে না যে প্রতিবাদীর এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলবে? অনিচ্ছুকের উপর চাপ দিয়ে খুব বেশিদিন যে বাঁচে না ক্ষমতা, ইতিহাস কি তাকে শেখায়নি এটা?’ এই কথাগুলো চিরকালীন সত্য উচ্চারণ হয়ে থাকবে।

এর অনেক আগেই, ১৯৫১, কোচবিহারের খাদ্য আন্দোলনের প্রতিবাদীদের ওপর গুলি চালনায় নিহত কিশোরীর স্মৃতিতে লেখা ‘যমুনাতী’ কবিতা কালের ঘটনাচিহ্নের সীমানা ছাড়িয়ে কাল-উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার চার বছর পরেও কেন মানুষকে খাদ্যের দাবিতে পথে নামতে হবে? কেন খাদ্যের দাবিরত মানুষের উপর রাষ্ট্র গুলি চালাবে? এই প্রশ্ন তাকে ক্ষুব্ধ করে, এই ক্ষোভের প্রকাশে লেখেন :

‘নিভন্ত ওই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে’।

‘কবিতার কথায়’ লিখেছেন তিনি, ‘সকালবেলা একদিন কাগজ খুলে দেখি প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে কুচবিহারের খবর, পুলিশের গুলিতে কিশোরীর মৃত্যু। ...সে কিশোরীর বয়স ছিল ষোলো বছর। বিশ্বাস হতে চায় না কথাটা। ক্ষোভে লজ্জায় কাগজ হাতে বসে থাকি এই খবরের সামনে। ... মিছিলের একেবারে সামনে থেকে একটি ষোলো বছরের মেয়েকে কর্ডনের এপারে টেনে নেয় পুলিশ, আর ‘অবৈধ’ এই সীমালঙ্ঘনের অভিযোগে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তাকে, পথের ওপরেই মৃত্যু হয় তার।
স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের হাতে স্বাধীন এক কিশোরীর কত অনায়াস সেই মৃত্যু!...’

‘নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
মৃত্যুরই গান গা―
মায়ের চোখে বাপের চোখে
দু-তিনটে গঙ্গা’।
দূর্বাতে তার রক্ত লেগে
সহস্র সঙ্গী
জাগে ধকধক, যজ্ঞে ঢালে
সহস্র মণ ঘি!...’

‘তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই নির্জন রাখাল।
তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই এমন সকালসন্ধ্যা
আজানু বসেছি এই উদাসীন মর্যাদায়
চেয়ে আছি নিঃস্ব চোখে চোখে।...’

রবিবারের আড্ডা, উল্টাডাঙার ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের ফ্ল্যাটবাড়ির আড্ডা। বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের এক চর্চিত আড্ডা, যার কেন্দ্রে শঙ্খ ঘোষ। কবির বাসার এই আড্ডা আসলে মিলনের, ভিন্নমতের ও পথের মানুষদের, ভিন প্রজন্মের মানুষদের, অভিজ্ঞ ও বিদগ্ধ পণ্ডিতের পাশের চেয়ারে এসে অনায়াসে বসে থাকেন সদ্য কবিতা লিখতে আসা মফস্বলের তরুণ-তরুণী। বছরের এক-দুবারের বেশি কলকাতা যাওয়া হয়া না আমার, তবুও ৬০০ কিমি দূরের একপ্রান্ত জনপদের আমার মতো অনেকের কাছেই এই নিবাস ও আড্ডা এক তীব্র আকর্ষণবিন্দু হয়ে উঠেছিল। একদিন এই আড্ডা নিয়ে জিজ্ঞাসা রাখলে তিনি তার ‘জাবালা ও সত্যকাম’ কবিতার কথা বলেন। ‘কবিতার মুহূর্ত’তে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘শেষ হয়ে আসছে ১৯৬৬ সাল। প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল নতুন দেশের, কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে ভরসা হয় না যে তৈরি হয়ে উঠবে কোনো ঐক্যময় নতুন সমাজ। ভাঙ্গনে ভাঙ্গনে কি ভরে এল সব? কোনো কি লক্ষ্য আছে আমাদের এই দিশেহারা সংস্কৃতির? কিছু একটা করবার ছিল, কিছু একটা করবার ছিল, মনে হতে থাকে। এইরকম এক সময়ে, বন্ধুবৃত্তে একটা কথা ওঠে : লেখার সঙ্গে শিল্পের জগতের কোনো একাত্মতা নেই কেন, কেন কোনো চলাচল নেই এক সৃষ্টি থেকে অন্য সৃষ্টিতে? যাঁরা ছবি আঁকেন, যারা কবিতা লেখেন, গল্প লেখেন যাঁরা, নিজেদের মধ্যে তাঁদের মেলামেশা আলাপসংলাপ আরো একটু ঘন হলে হয়তো কেটে যেতে পারত এই জড়তা, হয়তো তখন এর কাছে ওর, ওর কাছে এর প্রেরণাও মিলতে পারত কিছু।
তাই ঠিক হলো, এক একজনের বাড়িতে এক-একদিন মিলব আমরা সবাই, নিছক আড্ডারই জন্য, আর সেই সঙ্গে শিল্পবিষয়ে কিছু কথা হতে পারে...।’ কবির বাসার আড্ডার নিভৃতে হয়তো এই কথাগুলোই প্রেরণা হয়ে রয়ে গেছে।
এমনই বন্ধুবৃত্তের আড্ডায় একদিন উঠে এলো ওরিয়েন্টাল আর্টের প্রসঙ্গ। জিজ্ঞাসা এলো, শিল্পের মধ্যে জাতীয়-চিহ্ন খুঁজবার মানে আছে কিছু? শিল্প কি স্বভাবতই আন্তর্জাতিক নয়? ‘আলোচনায় শেষ পর্যন্ত এই মতেরই জোরালো প্রতিষ্ঠা হলো যে ভারতীয়তা একটা অলীক ব্যাপার, তার অস্তিত্ব নেই কোথাও।’ কিন্তু একথাটায় তাঁর মনের সায় ছিলো না একদম। ‘মনে হচ্ছিল কোথাও কোনো ভুল হয়ে যাচ্ছে; আছে, কিছু আছে। সমাবেশের মধ্যে কথাবলার অনভ্যাসে, জড়তায়, বলতে পারিনি সেকথা, ভিতরে ভিতরে তাই জমে উঠছিল একটা অসম্পূর্ণতার কষ্ট।’ কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে সেই রাতে কবি ঘুরে বেড়ান পার্কস্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গী। ‘আর কিছু দূরে এসে চোখে পড়ে শেয়ালদায় গৃহমুখী মানুষের চলচ্ছবি, কবিতার লাইন ভেসে আসে : death has undone so many! কাদের এ মুখ? কোন দেশের মানুষ এরা?... কোন আন্তর্জাতিক মানুষ তুমি, কী তোমার ভাষা, কী তোমার জীবন, কোনো কি ঘর আছে তোমার?... মনে পড়ছে অনেকদিনের অনেক হাঁটা, সেই-বাংলা থেকে এই-বাংলায়। কোথায় চলেছি? চকিতে মনে পড়ছে আত্মপরিচয়হীন এক সত্যকামের কথা, উপনিষদের কাহিনী, মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রাহ্মণ’। জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জাবালার ক্রোড়ে! আমরাও কি নই তা-ই? কিছু কি করার নেই আমাদের?’

‘...পরিচয়? কেন পরিচয় চাও প্রভু?
ওই ওরা বসে আছে অন্ধকার বনচ্ছায়াএ সকলেই ঋদ্ধপরিচয়?
বনে ভরে আগুনকুসুম―
আমি যে আমিই এই পরিচয় ভরে না হৃদয়? কেন চাও আত্মপরিচয়?’

‘আমি আড়াল চেয়েছিলাম চার কিনারে
কিন্তু প্রভু ভুল কোরো না রাত্রি সকাল
পথই আমার পথের আড়াল।’

১৪ মার্চ ২০০৭, রাজ্যের রাজনীতিকে টুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিলো নন্দীগ্রাম। প্রিয় বন্ধু অশ্রুকুমার সিকদারের সঙ্গে তখন পাহাড়ের নির্জনাবাসে শঙ্খ ঘোষ। পরদিন নেমে এলেন সমতলে, শ্বশুরবাড়ি জলপাইগুড়িতে। আমি সন্ধ্যায় দেখা করতে গেলাম। প্রবল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ মন তাঁর কিন্তু বাইরে সেই সীমিত প্রকাশের ধ্যানমূর্তি। স্বভাবিকভাবেই আমি নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ না টেনে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম। এই দিনই তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই সবকিছুর মধ্যেও তিনি স্থির ও মগ্ন চৈতন্যের ঋষিপ্রতিম দৃঢ়। এর আগের বছর ‘দ্যোতনা’র পক্ষ থেকে তাঁকে একটি পেইন্টিং দিয়েছিলাম, চিত্রকলা প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা জানার ইচ্ছা থেকে কিছু জিজ্ঞাসা রাখলাম, যোগেন চৌধুরীর প্রসঙ্গ এলো। কলকাতায় তাঁরা কবি ও চিত্রকরেরা একটা জায়গায় আসার চেষ্টা করছেন সেই কথা জানালেন। সেই ছবিটির চিত্রকর, জলপাইগুড়ির স্বপন দাসের কাজের প্রশংসা করলেন। যখন জানলেন শিল্পী নিজেকে গৃহবন্দি করে রেখেছেন এক অজ্ঞাত অভিমানে তখন আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পরদিন বিকালে আমাকে আসতে বললেন। সেদিন ১৬ মার্চ, বিকাল ৫টা নাগাদ বের হলাম আমরা। একটা সাইকেল রিকশায়, শহর থেকে কিছুটা বাইরে। বুঝতে পারছিলাম একটা মুক্ত পরিসর চাইছেন কবি। পাণ্ডাপাড়া কালীবাড়ির আগে ডানদিকে মণ্ডলঘাটের দিকে চললাম, রিকশায়। পরিস্থিতি ও তাঁর ভেতরের যন্ত্রণা অনুভব করে ‘নীরবতার কাছে বিসর্জিত কবি’র নিঃশব্দ সহচর হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় মনে হলো। তিনি যতটুকু বলছেন শুধু তার উত্তরটাই দিচ্ছিলাম। তিনিই মণ্ডলঘাট নামটা শুনে ৬৮র বন্যা প্রসঙ্গ আনলেন। উল্লেখ করা দরকার যে ১৯৬৮র ৪ অক্টোবর তিস্তার ভয়াবহ বন্যায় জলপাইগুড়ি ও নিকট এলাকা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই বিধ্বস্ত একটি জনপদ এই মণ্ডলঘাট।
তিনি চলতে চলতেই বললেন, ‘আমি সেই সময় এখানে ছিলাম, জানো কি?’
‘হ্যাঁ’। আমি উত্তর দিলাম। ‘আপনার আরুণি ও উদ্দালক’ কবিতাটির কথা তো আপনি লিখেছেন:
‘হ্যাঁ, সেই রাতের অভিজ্ঞতা আমি ভুলব না।’
এই রকম নানা কথায় কথায় অনেকটা চলে গিয়েছি বুঝে ফেলার কথা বললাম। আলোটাও কমে আসছিল। ফেরার পথে স্বপন দাসের বাড়ি পড়বে, স্বপন দা-ও চেয়েছেন তিনি যদি সময় পান তবে অবশ্যই যেন তাঁর আঁকা দেখে যান। আমি সেকথা তুলতেই তিনি রাজি হলেন। স্বপন দাস, মফস্বল শহরের এক স্বশিক্ষিত শিল্পী, প্রচারের কোনো রকম আলোর থেকে অনেক দূরে থাকা শিল্পীর আঁকা দেখতে তার বাড়ি যেতে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন শঙ্খ ঘোষ, এই ঘটনাটা পাঠককে এই মানুষটাকে জানতে সাহায্য করবে। প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি খুঁটে খুঁটে দেখলেন তাঁর আঁকা। চোখমুখে একটা মুগ্ধতা লক্ষ করলাম। উঠবার সময় বললেন, ‘আপনি ছবি নিয়ে কলকাতায় আসুন। আমার বন্ধু যোগেন চৌধুরীকে এই ছবিগুলো দেখাতে পারবেন? আপনার নিজস্বতা ও রঙ আমার ভালো লেগেছে।’
এমন অনেক ছোটছোট ঘটনার স্মৃতি মানুষটাকে ক্রমশ নতুন নতুন করে আমাকে চিনিয়েছে। এর অনেক দিন পরে, যখন কামদোনিতে একটি স্কুলছাত্রীকে পৌশাচিক গণধর্ষণের শিকার হতে হলো, তার কদিন পরে সকালে তাঁর ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসে গিয়েছিলাম। কামদোনিতে এক প্রতিবাদী চিকিৎসকের ওপর হামলার খবর দিলেন কেউ একজন। সেই প্রথম ধৈর্য হারাতে দেখলাম তাঁকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন, শুধু একটা কথা উচ্চারণ করলেন, ‘এও তো এক সর্বনাশের সূচনা, শাসকের ও সমাজেরও।’ আরো অনেক কথা হলেও সে কথাগুলো ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। আসলে একজন শিল্পী বা স্রষ্টা তো দ্রষ্টাও। যাদবপুরের সহকর্মী ও প্রিয় বন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, ‘আমার ধারণা, দুই বাংলার অবিভক্ত সংস্কৃতির অন্যতম জনপ্রিয় এই মানুষটির স্নায়ব সংবেদন এতই গভীর যে তার রহস্য হৃদয়ঙ্গম করা অনেকেরই সাধ্য নয়। হ্রদের মতন স্বচ্ছ এবং শায়রের মতো ঋজু তাঁর প্রকাশভঙ্গি। ঐ প্রত্যক্ষতার আড়ালে এমন একটি সত্তা লুকিয়ে আছে যার নাগাল পাওয়া ভার।’ এই সত্তা আসলে মানবতার প্রতি উৎসর্গকৃত এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্রষ্টার অন্তরাত্মা:

‘আসলে সকলে মিথ্যা বলে বলুক, দু-চার জনের কাছে আমরা সত্য চাই।
আর সকলে ভ্রান্ত করে করুক, দু-চার জনের কাছে আমরা ব্রত চাই।’

এই ব্রতচারী নির্মাণেই জীবনের প্রায় সম্পূর্ণটা নিয়োজিত করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেটা একজন শিক্ষক হিসেবে বিদ্যায়তনে বা একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে সচেতন সামাজিক মানুষের খোঁজে। বহরমপুর গার্লস কলেজ, সিটি কলেজ হয়ে ১৯৬০-এর গোড়ায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। যাদপপুরে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সুকুমার সেনের মতো মানুষেরা, পিএইচডি না করা একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সুকুমার সেন নাকি বলেছিলেন, শঙ্খ নিজেই পিএইচডি করাবে!
গোটা জীবন একজন আদর্শ ও ছাত্রপ্রিয় শিক্ষকের মতো পড়ানোর আনন্দেই পড়িয়েছেন তিনি। একজন শৃঙ্খলাবদ্ধ কিন্তু সরস ও প্রাণবন্ত ক্লাস করার অভিজ্ঞতা হতো তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের। ক্লাসঘরে ঢুকেই সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে দিতেন। পড়ানোর বিষয়ের প্রয়োজনে বিষয়ান্তরে যেতেন কিন্তু কখনো রেফারেন্স হিসেবে নিজের বইয়ের নাম করতেন না। ঋজু বসু লিখেছেন যে পড়ানোর আনন্দে তিনি শান্তিনিকেতনে ফেলোশিপ পর্বে পাঠভবনের ছোটদের ক্লাসও নিতেন। ১৯৯২-তে যাদবপুর থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন তিনি।
শিক্ষক শঙ্খ ঘোষের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ভালোবাসা ছিল অকৃত্তিম ও অন্তর থেকে উৎসারিত। এই ভালোবাসা তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাত্র নির্বিশেষে বহতা ছিলো। সত্তরের রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা, নকশাল আন্দোলন, জরুরি অবস্থার সময় তিনি তাঁর আত্মক্ষয় নিবেদিত ছাত্রদের ওপর রাষ্ট্রের আক্রমণে নিজেও রক্তাক্ত হতেন। আগামী প্রজন্মের প্রতি আত্মনিবেদিত থেকেছেন আমৃত্যু। অন্তরের নাভিমূল থেকে উচ্চারণ করেছিলেন:

‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
...
না কি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?’

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন