X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বরাদ্দ বাড়ালেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয় না

ড. সেলিম রায়হান
০৪ জুন ২০২১, ২১:০৯আপডেট : ০৫ জুন ২০২১, ১২:০৮

ড. সেলিম রায়হান করোনাকালের এ সময়ে বাজেট নিয়ে আমাদের যে একটি বড় ধরনের প্রত্যাশা ছিল, তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। তবে আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে আমাদের এই বড় প্রত্যাশা হয়তো সেভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভবও না। তবে বাজেটে কিছু বিষয় দেখেছি যা আমাকে আশাবাদী করেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছেন, যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। তিনি অগ্রাধিকারের বিষয়ে স্বাস্থ্য খাতের কথা বলেছেন, প্রণোদনা প্যাকেজের কথা বলেছেন, কৃষি খাতের কথা বলেছেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতের কথা বলেছেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির বিষয়ে আরও কিছু বাস্তবতা বাজেটে প্রতিফলিত হতে পারতো।

করোনা মহামারিকে বাজেটে অনেক ক্ষেত্রেই মনে করা হয়েছে একটি সাময়িক ঘটনা হিসেবে, মনে করা হয়েছে সাময়িকভাবে কিছু মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটি মনে করার কারণ নেই যে করোনাভাইরাস একটি সাময়িক ঘটনা। এ মহামারি যেভাবে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যেভাবে সমাজের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে দিয়েছে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি ধাক্কা লেগেছে, সমাজে ও অর্থনীতিতে নানাভাবে অসাম্য সৃষ্টি করেছে, সেখানে বাজেটে বড় ধরনের একটি প্রত্যাশা ছিল যে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক পুনরুদ্ধার কীভাবে হবে সে বিষয়ে বাস্তবতাকে স্বীকার করে এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে একটি সঠিক ও বিস্তৃত দিকনির্দেশনা থাকবে। কিছু প্রচেষ্টা বাজেটে দেখছি, হয়তো সরকার মনে করছে প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমেই এবং বাজেটে ঘোষিত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধারগুলো হবে। কিন্তু বাজেটে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, যেটি আমরা বারবার বলছি, শুধু বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ালেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না। আমরা দেখেছি যে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের জন্য গত অর্থবছরেও বিশ হাজার কোটি টাকার টাকার একটি বরাদ্দ ছিল, তা কিন্তু সম্পূর্ণ খরচ করা যায়নি। সুতরাং আমি মনে করি সামগ্রিকভাবে বাজেট কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সেই রোডম্যাপ বাজেটে অনুপস্থিত।

এবারের বাজেটে ঘাটতির যে হিসাব সেখানে জিডিপির প্রায় ছয় শতাংশকে ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশের নিচে রাখা হয়, এটি এক ধরনের একটি অলিখিত প্রথায় পরিণত হয়েছিল। তবে গত অর্থবছরে বলা হয়েছিল করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে, সে বিষয়ে তখন অর্থনীতিবিদরাও মহামারি পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়াকে সমর্থন করেছিলেন। এখনও আমরা মনে করছি বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক খাতে সরকারের খরচ বাড়ানো উচিত, তবে আমরা দেখছি সরকার খরচ বাড়াতে পারছে না। ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। সে জায়গায় আমার একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেন সরকার খরচ করতে পারছে না? কেন স্বাস্থ্য খাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেখানে গত বাজেটে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি করা হয়েছিল, সে বরাদ্দ কেন খরচ করা যায়নি? আমাদের এটিও মনে রাখতে হবে যে খরচ করা আর বাস্তবায়নের মধ্যে একটি বড় ফারাক রয়েছে। খরচ করা মানেই বাস্তবায়ন নয়। সে জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধির জায়গায় আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি।

কর খাতে, ব্যাংক খাতে, শিক্ষা খাতে, স্বাস্থ্য খাতে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো দশকের পর দশক ধরে আটকে আছে, আমরা আশা করেছিলাম এই সংকটকালে  এই বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের একটি প্রক্রিয়া এই বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের সংকট আমরা একেবারে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি, বাজেট বাড়ানোর পরেও সেটি খরচ করা যায় না, স্বাস্থ্য খাতের সামর্থ্য বাড়ে না, বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি দূর হয় না। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের একটি বড় দাবি ছিল স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতে যতটুকুই সম্ভব সংস্কারের একটি রূপরেখা বাজেট ঘোষণায় থাকবে। কিন্তু এ ধরনের কোনও সংস্কারের রূপরেখা আমরা বাজেটে দেখিনি। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির যখন প্রবৃদ্ধি হয়, মাথাপিছু আয় যখন বাড়ে তখন আমরাও খুশি হই; কিন্তু আমরা যাতে প্রবৃদ্ধিতে ‘আসক্ত’ না হয়ে যাই। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রবৃদ্ধি কোনও জাদুর কাঠি নয়, প্রবৃদ্ধির ধূম্রজালে আমরা যেন আসল বিষয়গুলো ভুলে না যাই। গত পাঁচ দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের যে সাফল্য, করোনার ধাক্কায় তা কিন্তু এখন টলমান। করোনার সময়ে আমাদের ‘জবলেস গ্রোথ’-এর বিষয়টি আরও তীব্র হয়েছে। ডিজিটাল ডিভাইড-এর মতো নতুন বৈষম্য আমাদের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোকে যদি আমরা সামনে না আনি, আমরা যদি শুধু একমাত্র প্রবৃদ্ধির রঙিন চশমা দিয়ে সবকিছু দেখি তাহলে কিন্তু প্রবৃদ্ধির ধূম্রজালে হারিয়ে যাবো। প্রবৃদ্ধি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, প্রবৃদ্ধি যদি না বাড়ে আমরা সম্পদ বাড়াতে পারবো না, আমরা বণ্টন বাড়াতে পারবো না, তবে প্রবৃদ্ধিই একমাত্র বিষয় নয়। বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের সঙ্গে যদি মহামারির কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান ও অসাম্যের চ্যালেঞ্জগুলোকেও স্বীকার করে তা উত্তরণের পন্থা থাকতো, তাহলে এই বাজেট ঘোষণা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হতো।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ