X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষা পিছিয়ে দিতেই কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ?

এস এম আববাস
০৫ জুন ২০২১, ১৮:০৪আপডেট : ০৫ জুন ২০২১, ১৮:১২

এস এম আববাস ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নগরকেন্দ্রিক হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে আপাতত বিবেচনায় করারোপের বিষয়টি ভালো পদক্ষেপ মনে হতে পারে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় এই প্রস্তাব কতটা সুফল বয়ে আনবে উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষায়– সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপ করলেই কি জাতীয় বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দ রাতারাতি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাবে? গণমাধ্যমের প্রকাশিত গত কয়েক বছরের চিত্র দেখে আমার তেমনটি মনে হয়নি। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক বাজেটের করারোপ প্রস্তাব দেখে যেকোনও সচেতন মানুষের মনে হতে পারে বিশেষায়িত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা এবং তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষাকে পিছিয়ে দিতে করারোপ প্রস্তাব করা হয়েছে।

এসবের কারণ ব্যাখ্যা করার আগে বাজেটের চিত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক করারোপের আওতায় দেখে নেওয়া উচিত। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরিচালনব্যয়সহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

এবার দেখবো শিক্ষা খাতে ব্যয়ের অবস্থা কী। এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা যা জতীয় বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসেবে তা ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গত বছর ছিল ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরে শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ বড় বাজেটে সীমিত বরাদ্দ।

সরকারের অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক মানের দিকে তাকালে এ বরাদ্দ অতি নগণ্য। কারণ যেকোনও দেশের শিক্ষা বাজেট সেই দেশের মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বা জাতীয় আয়ের ৪ থেকে ৬ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।  আর এ নিয়ে আলোচনাও চলছে বছরের পর বছর।

এই আলোচনায় প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরতেই হচ্ছে। নতুন বাজেট প্রস্তবানায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এখানে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং বাজেট ঘাটতি প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ দেখে নেওয়া যাক। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রস্তাবে বলেছেন ‘প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রযোজ্য সাধারণ কর হার হ্রাস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ থেকে উদ্ভূত আয়ের ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সংসদে আমি এ করহার অর্থ আইনের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।’

আলোচনার শুরুতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসা জরুরি মনে করছি। কারণ দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের সময়। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এই বিষয়টি বেশ স্বোচ্চার হয়েছে।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৫ সালের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের কথা। অর্থ বিভাগের সেই ভ্যাট প্রস্তাব সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। 

এখন আসা যাক মূল আলোচনায়। দেশে বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একশ’র বেশি। হাতে গোনা কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বচ্ছলতা রয়েছে। তবে করোনাকালে তাও তলানিতে। বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থার চিত্রটি জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, আর্থিক সংকটে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মচারীদের পুরো বেতন নিশ্চিত করতে পারেনি। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান অর্ধেক বেতন দিয়েছে। অন্যদিকে অর্থাভাবে এখনও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালুই করতে পারেনি।

এই পরিস্থিতির মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের আয়ের ওপর বাজেটে করারোপ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এটি নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপ করা যায় কিনা এবং বাংলাদেশের কোনও আইনের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক কিনা? আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে—অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক দায় সরকার ঘাড়ে নিয়ে শেয়ার করতে চায় কিনা?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে এই করারোপ আইনবিরোধী। যদি আইনবিরোধী হয় তাহলে এই প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। হয়ত এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করেও নেওয়া হতে পারে। আমি সেদিকে যাবো না। বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারের দায় রয়েছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা খুব জরুরি।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বছর শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করার পরও এখনও ছাত্র-ছাত্রী হল তৈরি করতে পারেনি।  উপাচার্যের ভবন নিশ্চিত করতে পারেনি। সেসব বিশ্ববিদ্যলয়ের আয়ের ওপর করারোপ করায় মনে হতে পারে—সরকারের সংশ্লিষ্টরা এই খাতে বিনিয়োগ করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। আর তা যদি না করা হয়, তাহলে আয়কর কেনও এত জরুরি হয়ে দাঁড়ালো?

যে দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে আয়ের ওপর কর শতভাগ করা আদায় নিশ্চিত করা যায়নি।  সেখানে আয়ের নতুন উৎস কীভাবে অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে হতে পারে? মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে, ভবন তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। এমনকি শিক্ষাপকরণও নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাহলে সেভাবেই কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনা করা হবে? যদিও তা হবে বলে কেউ মনে করেন না। তাহলে করারোপ কেন? করারোপ নিশ্চিত হলে এই কর আসবে কার কাছ থেকে? শিক্ষার্থীর টিউশন ফি ছাড়া আয়ের উৎস নেই।  তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপ মানেই শিক্ষার্থীদের ব্যয় বড়ানো। অর্থাৎ শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থবিভাগ।

নতুন করে করারোপের প্রস্তাব শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়।  এই তালিকায় রয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ।

এ বিষয়ে আলোচনা আরও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য খাতের দিকে তাকালে প্রথমে দেখা যাবে চিকিৎসক সংকট। এই সংকট দূর করতে বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলো ভূমিকা রাখছে।  দেশের বেসরকারি চিকিৎসা সেবাতেও তাদের ভূমিকা কম নয়।  কারিগরির ওপর গুরুত্ব বাড়াতে সরকার বেসরকারি সাধারণ উচ্চশিক্ষা সংকুচিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ এবং বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর করারোপ করছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে বেসরকারি এই বিশেষায়িত শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সরকারের কোনও অবদান নেই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী যে কথাটি মোটেও শুনতে ভালো লাগেনি তা হচ্ছে— তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের ওপর করারোপ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশকে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল করা সম্ভব হয়নি। অথচ যেসব বেসরকারি কলেজ ভবিষ্যত প্রজন্মকে তথ্য-প্রযুক্তি শেখাবে তাদের আয়কর দিতে হবে এখন। এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে অন্তরায় নয় কি?

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ