X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলাবদ্ধ চট্টগ্রাম নগরবাসী

আনিস আলমগীর
০৮ জুন ২০২১, ১৫:০৩আপডেট : ০৮ জুন ২০২১, ১৮:৩৯

আনিস আলমগীর একটুখানি বৃষ্টি হলে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম শহরের অনেক জায়গা, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় প্রায় নগরজুড়ে। মেয়ররা তখন নানা মেগা প্রকল্পের গল্প বলেন। সেসব বাস্তবায়ন হলে নাকি জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিন্তু বছরের পর বছর যায়, জলাবদ্ধতা যায় না। প্রকল্পও শেষ হয় না। বরং চলমান প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আর ৫ বছর পর জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মেয়র প্রার্থীরা ভোট চান। অবশ্য ইদানীং আর ভোট চাওয়ারও দরকার হচ্ছে না। কে জিতবে আগেই জানা যাচ্ছে।

একসময় চাকতাই খাল চট্টগ্রামের দুঃখ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হতো প্রায় সব দৈনিকে। দুঃখ এখন আর চাকতাই কেন্দ্রিক নেই। চট্টগ্রাম শহরের বিশাল বিশাল জলাধার ভরাট করে আবাসিক এলাকা করা হয়েছে। ডজন ডজন পাহাড় কেটে সড়ক বানানো হয়েছে। শহরে নালার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় আর অপরিকল্পিত মার্কেট তৈরি করা হয়েছে। খালগুলো দখল করে সরকারি অফিস বানানো হয়েছে। সবই করেছেন নগর কর্তারা। কিন্তু বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতা হলে তারা নিরীহ জনগণের ওপর আঙুল তুলে বলছেন, ওরা চিপসের প্যাকেট আর পলিথিন ফেলে এ অবস্থা করেছে।

জলাবদ্ধতার প্রতিশ্রুতিটা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যেমনটা বড় ইস্যু, দেশের অন্য কোথাও তেমনটা নেই। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন জলাবদ্ধতা ইস্যুটিকে সামনে এনে তাদের নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য একদল তারকা ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটকে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এখন যখন বৃষ্টিতে কোমর পরিমাণ পানি তখন এসব তারকার বক্তব্য নিয়ে ট্রল হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমল থেকে সর্বশেষ মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি ইস্যু হিসেবে আছে। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৭ বছর, বিএনপি থেকে নির্বাচিত এম মনজুর আলম ৫ বছর, আবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের ২৭ বছরে চাকতাই খাল খনন, তলা পাকাকরণ প্রকল্প থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত নানা প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পকেট ভরেছে। কিন্তু এর সুফল নগরবাসী পায়নি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পটির কাজ চলছে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল প্রকল্পটির কাজ। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয় প্রকল্পের মেয়াদ। বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। বলা যায় না এরমধ্যে প্রকল্প ব্যয় আরও কত বাড়বে।

টেলিভিশনের খবরে দেখলাম আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালের অভ্যন্তরে পানি ঢুকেছে হাঁটু পরিমাণ। চিকিৎসা নেবে কী! মানুষ নিজেই নর্দমার পানির সংস্পর্শে এসে সেখানে অসুস্থ হচ্ছে। এই দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন।

অথচ কী অসাধারণ একটি শহর চট্টগ্রাম! বলা হতো প্রাচ্যের রানি। পাহাড়, সমতল, নদী, সমুদ্র মিলে একাকার। পৃথিবীতে এমন কম্বিনেশনের শহর মনে হয় আর একটি কী দুটি আছে। অথচ চট্টগ্রামের সঙ্গে জলাবদ্ধতার সম্পর্ক এমন হয়েছে যে, বর্ষা এলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। পানি কবে নামবে সে প্রহর গুনতে হয় তাদের। একদিকে জোয়ারের পানি, আরেকদিকে বৃষ্টির পানি- দুটি মিলে নগরজীবনের নাভিশ্বাস।

নগরীর আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, গোসাইলডাঙ্গা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, জিইসি মোড়, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় একটু বৃষ্টিতে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি ওঠে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ চাকতাই এলাকার ব্যবসায়ীদের জন্য বর্ষা মৌসুম এক অভিশাপের নাম। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাকলিয়া মৌসুমি আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা বর্ষায় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই মৌসুম পার করেন। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় অনেক স্থানে নালা-নর্দমার কাজ চলছে। নির্মাণকাজের কারণে নালায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন স্থানে সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

সর্বশেষ রবিবারের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা। হাঁটু থেকে বুক-সমান পানি উঠেছে বিভিন্ন স্থানে। বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে বেড়েছে আতঙ্ক। বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, নালা ও খালে প্রতিবন্ধকতা থাকায় এই জলাবদ্ধতা।

পত্রিকায় দেখলাম মেগা প্রকল্পের কাজের জন্য খালের মুখে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে সেগুলো অপসারণ না করলে চট্টগ্রাম নগরীতে বুক-সমান পানি হবে বলে ৩ জুন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, খালে বাঁধ ও স্লুইসগেটের (রেগুলেটর) কাজ শেষ না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, বাঁধের কারণে বৃষ্টি হলে খালে পানি নামতে পারে না। আর জোয়ারের কারণে সাগরের পানি যা প্রবেশ করে তাও বন্ধ করতে পারে না।

বাঁধগুলো সরছে না কেন! চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মেগা প্রকল্পের মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত স্লুইসগেট নির্মাণ ও মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না ততদিন জলাবদ্ধতা থাকবেই। বৃষ্টি মৌসুমে বিশেষ করে মে থেকে জুলাই খালে কাজ না করে অন্যত্র কাজ করলে খালের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে পানি চলাচলের ব্যবস্থা হতো। কিন্তু ভরা মৌসুমেও রেগুলেটর তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে, আবার বৃষ্টির পানি সরতে পারছে না।

সিডিএ বলছে, মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খালের মধ্যে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে সেগুলো খুলে দেওয়ার জন্য। এছাড়া পানি দ্রুত নামার জন্য ড্রেন ও নালা দ্রুত পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সব বাঁধ খুলে দেওয়ার জন্য ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে সেনাবাহিনী।

দেখা যাক, সিডিএ’র কথা কতটুকু বাস্তবায়িত হয় আর চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা যেতে নগরবাসীকে আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। 

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ