X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার টিকা ও মেধাস্বত্ব আইনের প্রাসঙ্গিকতা

ড. মাহতাব ইউ শাওন
১৬ জুন ২০২১, ১৭:২৭আপডেট : ১৬ জুন ২০২১, ১৭:২৭

ড. মাহতাব ইউ শাওন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন দেশে জরুরি বা সীমিত ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত টিকাগুলোর আওতায় আনছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাসও ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। আর আবিষ্কৃত টিকাগুলো ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর সেটা নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। এমনকি যদি এটি স্পষ্টও হয় যে অনুমোদনপ্রাপ্ত টিকাগুলো কোভিড-১৯-এর যেকোনও রূপকে মোকাবিলা করতে পারছে তবু বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।

এটি কেবল এই কারণেই নয় যে টিকা উৎপাদনকারী ওষুধ সংস্থাগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম নয়, এর পাশাপাশি বিবেচনায় আনার মতো আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, টিকার সুষম বিতরণে রাজনৈতিক বাধা কিংবা উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রয়োজনীয় টিকা কেনার মতো যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য না থাকা। সুতরাং রাষ্ট্রগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য করোনার টিকার দ্রুত এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, বিকল্প কোনও পন্থা বের করার প্রয়োজন হতে পারে।

একটি কার্যকর বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে এরকম – রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই যার যার দেশে টিকা উৎপাদন করছে। তবে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে মেধাস্বত্ব অধিকারের বিষয়টি। যদিও শুরুতে কিছু টিকা উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান (যেমন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়) বলেছিল তাদের উদ্ভাবিত টিকাগুলোর ওপর তারা কোনও মেধাস্বত্ব অধিকার বা মালিকানা রাখবে না, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। অক্সফোর্ড শেষ পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে টিকা তৈরির একক অধিকার দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (ডব্লিউটিও) কোভিড-১৯ সম্পর্কিত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলোর মেধাসম্পত্তি অধিকারের ওপর অস্থায়ী একটি ছাড় আনার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি প্রায় শতাধিক দেশের এবং বিভিন্ন সংস্থার ও জোটের সমর্থনও পেয়েছে। ২০২১ সালের ১০ এবং ১১ মার্চ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভায় এই প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং আলোচনা অব্যাহত থাকার কথা রয়েছে। তবে যেহেতু সব সদস্য দেশ এই প্রস্তাব সমর্থন করবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়, প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত হবে কিনা তা বলা মুশকিল। তবে, এই প্রস্তাব অনুমোদিত বা প্রত্যাখ্যাত যাই হোক না কেন, কোভিড ১৯ বা করোনা মহামারি মোকাবিলায় রাষ্ট্রগুলো ভাবতে পারে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিংয়ের কথা, যা কিনা দ্য ‘এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড রেলেটেড এসপেক্ট্স অফ ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপারটি রাইট্স’ (ট্রিপস্ এগ্রিমেন্ট) (১৯৯৪)-এর আওতায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের চিকিৎসা সরঞ্জাম বা চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রযুক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করার নিমিত্তে (দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে বা বিদেশি আমদানির মাধ্যমে) প্রয়োগ করার অধিকার রাখে। এইডস মহামারির সময় অ্যান্টি আর্ট্রোভাইরাল ড্রাগের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কিছু দেশ বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের ব্যবহারকে একটি সফল নীতি হিসেবে ব্যবহারও করেছিল।

ট্রিপস এগ্রিমেন্টের ৩১নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো প্রকৃত পেটেন্ট অধিকারীর অনুমতি না নিয়ে স্থানীয় নির্মাতাদের কোনও পেটেন্টকৃত পণ্য উৎপাদন করার জন্য আদেশ দেওয়ার অধিকার রাখে। এই অনুচ্ছেদটিই ‘বাধ্যতামূলক লাইসেন্স’-এর প্রধান আইনি ভিত্তি।

পরবর্তীতে, ‘ট্রিপস এগ্রিমেন্ট এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক দোহা ঘোষণা’র ৫নং দফায় (নভেম্বর ২০০১-এ গৃহীত) আবারও নিশ্চিত করা হয় যে ‘প্রত্যেক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদানের অধিকার রয়েছে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা রয়েছে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদানের ভিত্তি নির্ধারণ করার’।

এছাড়াও, এ ঘোষণায় জাতীয় জরুরি অবস্থার সময়ে এবং চূড়ান্ত জরুরি অবস্থা নির্দেশ করে এরকম অন্যান্য পরিস্থিতিতে সরকারকে স্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রযোজ্য প্রয়োজনীয় বিধি অনুসরণ ছাড়াই (উদা. পেটেন্টধারীর সাথে পূর্ব-আলোচনা ছাড়াই) স্থানীয় উৎপাদকদের পক্ষে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। দোহা ঘোষণার ৫(গ) দফা আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, ‘এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা , ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য মহামারি সম্পর্কিত জনসাধারণের স্বাস্থ্য সংকট,’ ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা বা চূড়ান্ত জরুরি অবস্থা নির্দেশ করে এরকম অন্যান্য পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারে। এর অর্থ, কোভিড মহামারিটি দোহা ঘোষণার ৫(গ) দফা মোতাবেক ‘একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা বা চূড়ান্ত জরুরি অবস্থা নির্দেশ করে এরকম অন্যান্য পরিস্থিতি’ সৃষ্টির ক্ষেত্র একটি ন্যায়সঙ্গত জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচিত হতে বাধা নেই।

স্বল্প কিংবা মধ্যম-আয়ের দেশগুলো যারা কিনা নিজেরা ওষুধ উৎপাদন সক্ষম নয়, অর্থাৎ যে দেশগুলো ট্রিপস এগ্রিমেন্টের ৩১নং অনুচ্ছেদের অধীনস্থ বাধ্যতামূলক লাইসেন্স বিধানের সুবিধা নিতে পারবে না, তারা চাইলে এগ্রিমেন্টের ৩১নং অনুচ্ছেদে দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। কারণ, এই অনুচ্ছেদটি [৩১ (বিস.)] কোনও উন্নত সদস্য দেশকে কম উন্নত সদস্য দেশে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের অধীনে জেনেরিক ড্রাগ রফতানি করার অনুমতি দিয়েছে।

এখন আন্তর্জাতিক মেধাসম্পত্তি আইনে যাই থাকুক না কেন করোনা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স ব্যবহারের আগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিশ্চিত হতে হবে যে তাদের রাষ্ট্রীয় মেধাসম্পত্তি আইনসমূহ এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে অনুমতি দেয়।

বাংলাদেশের বিদ্যমান পেটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্টে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের বিধান রয়েছে; তবে এই বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ভিন্ন। বাংলাদেশের পেটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্টের ২২নং ধারায় উল্লেখিত বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদানের উদ্দেশ্য হলো যেকোনও পেটেন্টযুক্ত পণ্যের বাজার চাহিদা পূর্ণাঙ্গরূপে পূরণ করা, জাতীয় জরুরি অবস্থা কিংবা জনস্বাস্থ্যের কোনও সমস্যা সমাধান করা নয়। বিধানটিতে সরকারকে নিজে উদ্যোগী হয়ে কোনও স্থানীয় প্রস্তুতকারকের পক্ষে কোনও পেটেন্টকৃত সরঞ্জাম বা প্রযুক্তি উৎপাদনের জন্য বাধ্যতামূলক লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

যাহোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে এখনই সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করতে হবে না। আসলে করোনা মোকাবিলায় পেটেন্টকৃত চিকিৎসা সামগ্রী দেশেই উৎপাদন করার জন্য বাংলাদেশের মূলত প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট টিকা কিংবা চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদনের ফর্মুলা ও কারিগরি জ্ঞান। কেননা, একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনো ট্রিপস এগ্রিমেন্টের বিধানসমূহের পূর্ণাঙ্গ আওতাভুক্ত নয়। কারণ, ‘স্বল্পোন্নত দেশের সদস্যদের বিশেষ প্রয়োজন’ বিবেচনা করে,ট্রিপস এগ্রিমেন্টের-এর ৬৬(১) অনুচ্ছেদ এই দেশগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তির বিধানগুলো (৩, ৪ এবং ৫ অনুচ্ছেদ ব্যতীত) প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকার অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় ট্রিপসের দেওয়া এই বিশেষ সুবিধাটি জুলাই ১, ২০২১ পর্যন্ত উপভোগ করবে। যদিও ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এই ছাড়ের মেয়াদ আরও ১২ বছরের বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে, তবে এখনও এটি স্পষ্ট নয় যে বাংলাদেশ (স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে) আর কতদিন এই ছাড়ের আওতায় থাকবে। তবে আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশকেও একসময় ট্রিপস এগ্রিমেন্টের বিধানগুলো সম্পূর্ণরূপে মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেও ট্রিপসের আলোকে বর্তমান পেটেন্ট আইন সংশোধন করতে হবে আর তখন (করোনা মোকাবিলায় পেটেন্টকৃত চিকিৎসা সামগ্রী দেশেই উৎপাদন করতে চাইলে) সংশোধিত আইনে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের বিষয়টিও হয়তো নিয়ে আসতে হবে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ