একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে থেকে বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রাখায় দেশের বিশিষ্ট ১২ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন সংগঠকরা এ তালিকাকে ‘পুরোপুরি অসম্পূর্ণ’ মনে করছেন। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিলেত প্রবাসীদের সংগঠিত করে যারা বিভিন্ন কর্মসূচি, তহবিল সংগ্রহ, এমনকি স্থানীয় পাকিস্তানিদের হামলা মুখে পড়েছেন, কেউ কেউ কারাবরণও করেছেন তাদের অনেকেই এই তালিকায় স্থান পাননি। স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পর এ ধরনের ‘খণ্ডিত’ ও ‘অসম্পূর্ণ’ তালিকা প্রকাশ নিয়ে তাদের কণ্ঠে হতাশা উঠে এসেছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা রাখা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনে যুক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সাল বা তার আগে-পরে বার্মিংহাম,ওল্ডহামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে বার্মিংহামে ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। মার্চের শুরুতে দুইবার লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করা হয়। ৭ মার্চ ডাকা সর্বদলীয় সভায় প্রায় ১০ হাজার বাঙালি জড়ো হন। এদিন পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৮ মার্চ বার্মিংহামের স্মলহিত পার্কে দশ থেকে ১৫ হাজার মানুষ জড়ো হন। ওইদিনই বাংলাদেশের বাইরে প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয় বার্মিংহামে। ২৮ মার্চ স্মরণ কমিটি এখনও প্রতি বছর দিবসটি পালন করে, এতে অবদান রাখা মানুষদের স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা দেওয়া। বার্মিংহামের জগলুল পাশা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন স্বীকৃত সংগঠক। তার কমিটির সেক্রেটারির নাম আসলেও সভাপতির নাম আসেনি। টনি হক মুল নেতৃত্বের একজন ছিলেন। ট্রাফলগার স্কয়ারের সমাবেশেও ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়া একমাত্র বাংলাদেশি ছিলেন তিনি।
তাদের কাছ থেকে আরও জানা গেছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে যে তহবিল গঠনের কমিটি করা হয় সে কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন হাফিজ মজির উদ্দীন আহমেদ। এ কমিটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে ব্রিটেনের সে সময়ের প্রখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে আইনজীবি হিসেবে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধেও ইউকে সংগ্রাম কমিটির ট্রেজারার মজির উদ্দীনসহ পাচঁ জনের একটি টিম ব্যক্তিগত অর্থ নিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে যায়। খাবার, অর্থ সাহায্য নিয়ে শরণার্থীদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মরহুম এম এ জি ওসমানীর নির্দেশে ট্রাক ভরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বস্ত্র, জুতাসহ অন্যান্য সামগ্রী সরাসরি হস্তান্তর করে।
জানা গেছে, ওই সময় বাংলাদেশের জন্য অর্থ তুলতে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা গিয়েছিল ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের তোলা চাঁদার অর্থ। যার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯২ হাজার পাউন্ড। শুধু বিলেতের বাংলাদেশিরা নন, রজার গোয়েনের মতো শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরাও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে মিছিল-সমাবেশে অংশ নেন।
ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে হতাশা
বার্মিংহামে ২৮ শে মার্চ উদযাপন পরিষদের সেক্রেটারি কমরেড মসুদ আহমেদ মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা ৭১ সালে সবেমাত্র বিলেত এসেছিলেন চাকুরি বা পড়তে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিলেতের বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ যারা সাত দিন ৪০ ঘণ্টা কাজের পুরো মজুরি মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা তহবিলে দিয়েছিলেন তাদের নাম নেই। সুদূর ওল্ডহাম, ম্যানচেস্টার থেকে বাস ভর্তি করে হাজারো বাংলাদেশি গার্মেন্টসকর্মী শরিক হতেন লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারের বিক্ষোভে। কর্মসুচিতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি কমিউনিটির হাজারো নারী সংসার ও সন্তানের দুধের পয়সা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতা তহবিলে। বার্মিংহামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জগলুল পাশার স্ত্রী বদরুন্নেসা অনেক নারীরা সমাবেশে নিয়মিত বক্তব্য দিয়েছেন, হাতে লিখে তৈরি করেছেন ফেস্টুন, ঘরে ঘরে তৈরি করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেই পতাকা আর ফেস্টুন নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এদের প্রায় সবার নাম তালিকার বাইরে থেকে যাওয়াটা দুঃখজনক।
মসুদ আহমেদ আরও বলেন, অতীতে আমরা দু’দফায় বাংলাদেশ সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু আমাদের দাবি ও অনুরোধ রাখা হয়নি। সদ্যঘোষিত এ তালিকার ব্যাপারে বৈঠকে বসে প্রতিবাদের পরবর্তী কর্মসুচি ঠিক করা হবে।
বার্মিংহামে ২৮ শে মার্চ উদযাপন পরিষদের সভাপতি সাবেক হাইকমিশনার তোজাম্মেল হক টনি বলেন, ইতিহাসে বার বার স্বীকৃত মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠকদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে প্রবল অবহেলায়, নিদারুণ লজ্জাকরভাবে। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে আমি আহত, দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ।
ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন লেখক ড. রেনু লুৎফা। তিনি বলেন, কবীর চৌধুরী, আতা খান, বার্মিংহামের টনি হক, লুলু বিলকিস বানু, আফরোজ মিয়া, খলিলুর রহমান, সবুর চৌধুরী, জমসেদ মিয়া, সৈয়দ আবদুর রহমান, ওয়াতির আলী মাস্টার, শাহ নুরুল ইসলাম, কভেন্ট্রির সিতু মিয়ার মতো সংগঠকদের নাম এ তালিকায় না দেখে বিস্মিত ও হতাশ হয়েছি।
ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক লোকমান উদ্দীন বলেন, একাত্তরে বর্বর পাকিস্তানের প্রবাসীরা ব্রিটেন ও আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর হামলা করেছে। কিছু ঘটনা অনেক লেখাতেই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ যাদের নাম সরকারি তালিকার সূত্রে আলোচনায় এসেছে, তাদের প্রায় সমসাময়িক ৯০ শতাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরাসরি মাঠে নামেন, ভুমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আজির উদ্দীন ও রশিদ ভুইয়া জানান, ৬৯ থেকে ৭১ সালে প্রবাসী বাঙালির মিছিল-সমাবেশ দেখলে পাকিস্তানিরা গালিগালাজ করত, তেড়ে আসত। কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে। বেশ কয়েকজন বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশি পাকিস্তানিদের হামলা ঠেকাতে গিয়ে মারামারি করে দফায় দফায় জেলে পর্যন্ত গিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফয়জুর রহমান চৌধুরী এমবিই ও মোহাম্মদ দবির জানান, সেই সময়কার প্রায় ৯০ ভাগ বিলেত প্রবাসীই ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের। বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে নামগুলো বার বার ইতিহাসে উঠে এদের তাদের প্রায় সবার নাম এই তালিকার বাইরে রয়ে গেছে। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবন, হাইকমিশনারের বাসভবন কেনা হয় মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিলেত প্রবাসীদের সহযোগীতা তহবিলের অর্থ থেকে।
বার্মিংহামের ডাক্তার আব্দুল খালিক বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় লন্ডনে অবস্থানরত সিলেটিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হবে এসব প্রবাসীদের নাম। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো আজও স্মরণে আছে প্রবীণ প্রবাসীদের।
স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পর এ ধরনের খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ হতাশাজনক ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের ট্রেজারার সাইদুল ইসলাম ও লেখক সাংবাদিক মাহবুব সুয়েদ। তারা এ তালিকা সম্পূর্ণ করে প্রকাশের দাবি জানান।