X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনার করুণ কাহিনি: সাধারণ ছুটি থেকে লকডাউন ও অতঃপর

মাকসুদুল হক
২৭ জুন ২০২১, ১৪:৪৭আপডেট : ২৭ জুন ২০২১, ১৬:৩০

মাকসুদুল হক ‘কোভিড কেন্দ্রিক কোনও প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা দেখামাত্রই গুলি চালানো হবে।’—ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে, ২০২০।

‘লক’ বা ‘লকডাউন’ শব্দ আমাদের সংস্কৃতিতে খুবই বেমানান, কারণ বাঙালির ডিএনএ সেই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পুলিশি ‘লকআপ’-এর কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। স্বাধীন দেশ হলেও আমাদের আইন ও আমলাতন্ত্র উপনিবেশিক শোষণ শাসনের কায়দায় এখনও চলে, তাই পুলিশ হাজারও চেষ্টা করলেও ‘জনগণের বন্ধু’ হতে আজ অবধি ব্যর্থ। তাছাড়া, আছে বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল জনগণের যেকোনও কর্তৃপক্ষের প্রতি অবজ্ঞা, অবিশ্বাসসহ স্বভাবগত ভয় ও এলার্জি।

কোনও কিছুই জোর খাটিয়ে আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব। তর্কপ্রিয় জাতি আমরা সব ‘নতুনত্ব’-কে হিতাহিতজ্ঞান দ্বারা অনুধাবন ও তীক্ষ্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গ্রহণ করি। ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের অতিমাত্রিক সন্দেহপ্রবণতা সবকিছুরই এসিড টেস্ট করে। জিজ্ঞাসা ছাড়া ‘অবিসংবাদিত’ সত্য বলে কোনও সত্যকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিই না।

করোনা মহামারিও সম্পূর্ণ নতুন, তাই এই ‘নতুনত্ব’কেও সহজে আমরা গ্রহণ করিনি। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক জনগণ তাকে সম্মান করে গুণকীর্তন গাইলেও ১০০ ভাগ বিশ্বাস কোনোকালে করেনি ও ভবিষ্যতে করবে না। এই সত্য-মিথ্যা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি অবস্থান বাঙালি জাতি বহু যুগ ধরে করে আসছে– এটা আমাদের আজকের দৃশ্যমান দোদুল্যমানতার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

জানি না এসব কারণেই নাকি কাকতালীয়ভাবে হোক ২০২০-এ মহামারির আবির্ভাবের পর সরকার এই শব্দটা ব্যবহার না করে খুবই সুকৌশলে লম্বা সময়ের জন্য ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করে দেয়। তাতে অহেতুক প্রশাসনিক চাপ কমিয়ে দিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও ‘টেক ইট ইজি’ জীবনের মোড কার্যকর করে রাষ্ট্র দৃঢ়তার সঙ্গে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মনোনিবেশ করে। জনগণের মন থেকে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা সরিয়ে দিয়ে নিজ বাসায় থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত খুবই কার্যকর হয়।

এক ধরনের ‘ঈদ ঈদ রব’ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন নিজ নিজ গ্রামে চলে যায়, আর শহুরে মানুষ আনন্দের বন্যায় ভাসতে থাকে। জীবনে কত কিছুই তো করার আছে যা এই যান্ত্রিক ব্যস্ততার বাস্তবতায় বহুকাল ধরে আমরা বঞ্চিত। পরিবারের সবাই মিলেমিশে বিশেষ করে গ্রামে থাকা বৃদ্ধ মাতা-পিতার সঙ্গে বদ্ধঘরে দিনরাত সময় কাটানো, হাসি-ঠাট্টা, গান, গল্প, টিভি, ফেসবুক, নেটফ্লিক্স, ইউটিউব দেখা, রান্না শেখা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, নিজ ছাড়া পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া, ব্যায়াম, ইয়োগা, জিম করা, বই-পুস্তক পড়া ইত্যাদি ‘করোনায় করণীয়’র এক বিশাল লিস্ট সবটাই জনগণকে ব্যস্ত রাখে।

আর নতুনত্বের আরেক ‘মজা’—অনলাইন পড়ালেখাসহ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। রাস্তাঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা বা স্মার্ট কাপড়-চোপড় পরে অফিস যাওয়ার ঝামেলা নেই। বাসায় যেভাবে থাকি অর্থাৎ শর্টস, টিশার্ট বা লুঙ্গি পরেই কাজ করা যায়, তদুপরি অফিসের ‘বসের’ চেহারা কারই বা প্রতিদিন দেখতে ইচ্ছা করে?

আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ বছর আগে কার্যকর করা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন’, যা নিয়ে অতীতে প্রচুর সমালোচনা, তিরস্কার, বিদ্রুপ ও অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছিল, মহামারির সময়ে যুগান্তকারী ‘লাইফ সেভিং’ ভূমিকা পালন করে। এই ডিজিটাল যুগে সবকিছুই করা সম্ভব। কাঁচা বাজার, মাছ, মাংস, আসবাবপত্র ক্রয় ছাড়াও পিৎজা, হ্যামবার্গার, কাচ্চি বিরিয়ানি, খিচুড়ি, এমনকি ফুচকা-চটপটি ইত্যাদি অর্ডার দেওয়ার মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কাছে উপস্থিত  হওয়া ‘আলাদিনের চেরাগ’কেও হার মানিয়ে দেয়। আমরা এই ডিজিটাল যুগে পদার্পণ না করলে আজ কি পরিস্থিতিতে থাকতাম তা সহজে অনুমেয়।

তবে সাধারণ ছুটি সফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল জনগণের ভেতরে প্রচুর মৃত্যু-আতঙ্ক কাজ করেছে, তা ছাড়া রাষ্ট্র ছিল যথেষ্ট  কঠোর। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সামাজিকভাবে ‘সভ্য আচরণ’ গৃহীত হওয়া তদুপরি বাঁশ দিয়ে রাস্তা রোধ করতো স্বয়ং জনগণ। দোকানপাট, বাজার নির্দিষ্ট সময়ে খোলা আর বন্ধ করা হতো এবং মসজিদগুলোতেও দেখা যেত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ আদায় করা।

অতি গুরুত্বপূর্ণ: সামরিক বাহিনীর কড়াকড়ি টহল চলতো নিয়মিত। আইন লঙ্ঘনকারীদের ওপর সেনাদের বেদম প্রহারের বহু ঘটনা ঘটেছিল। বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি, রাষ্ট্র যদি চায় সে যেকোনও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে ও উচ্ছৃঙ্খল জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।

তবে এই অবস্থা বড়জোর এক মাস স্থায়ী থাকলেও মৃত্যুর মিছিলসহ সংক্রমণের হার ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার ওপরে অর্থনৈতিক ধস ও হতদরিদ্র মানুষের করুণ অবস্থা দেখে সরকার বাধ্য হয়েই এই সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করে ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার’ আদেশ দিয়ে জনগণকে তার ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনীতির এক বিরাট যোগসূত্র থাকার ফলে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সমগ্র দেশকে চমকে দেয়।

ব্যাপক মহামারিকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও ধরপাকড়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাসহ বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিক শ্রেণির সাধারণ ছুটির পক্ষে-বিপক্ষে লাগাতার সমালোচনা সরকারকে দিকভ্রান্ত ও বিব্রত করে।

সমন্বয়হীনতা ও পাবলিক মেসেজিংয়ের সরকারি ব্যর্থতায় জনগণের ভেতরে চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

মেসেজিংয়ে সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ দিক ছিল সরকারি আমলা, মন্ত্রী মিনিস্টার, রাজনীতিবিদদের একই ইস্যুতে একই পুস্তকের বিভিন্ন পৃষ্ঠার বিভিন্ন ধরনের গল্প পাঠ জনগণকে হতাশ ও দ্বিধাবিভক্ত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। অতি সাধারণ বিষয়, যেমন– লকডাউন  কবে, কোন তারিখ থেকে, কীভাবে কার্যকর হবে তা নিয়ে অস্বচ্ছতা ও ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা জনগণকে বিভ্রান্তির চরমে নিয়ে যায়।

স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকি অন্য কোনও মন্ত্রণালয় লকডাউন ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার কার আছে তা আজ অবধি অস্পষ্ট।  রাষ্ট্রীয় বক্তব্যের স্বচ্ছতার এই ভয়াবহ ঘরটি আগামীতে কল্যাণকর হবে তা ভাবাটা একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত নয়।

করোনা মহামারি একটি ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ তাই স্বচ্ছ তথ্য প্রদানের জন্য যে গম্ভীরতা প্রয়োজন তা আজ অবধি চোখে পড়েনি। উপর্যুপরি বিন্দুমাত্র সমালোচনার মুখে সরকারের দ্রুত বক্তব্য পাল্টে ফেলার অভ্যাস এই প্রমাণ করে যে তারা মাইক্রোফোনের সামনে আসার আগে কোনোরকম প্রস্তুতিমূলক হোমওয়ার্ক করে না। এই দায়িত্বহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে।

দায়িত্বহীনতা ও সময় পার হয়ে যাওয়ার অনেক পর রাষ্ট্রের নড়েচড়ে ওঠে হাঁটু ঝাঁকানো রিঅ্যাকশন দুঃখজনক কেবল নয়, তা সম্পূর্ণ হাস্যকর। আমরা নিতান্ত অভিযোগপ্রিয়—সমাধানপ্রিয় জাতি নই, তা জেনেও  গ্রাম্য মোড়লতন্ত্র ও ‘বিচার যা-ই হোক তালগাছটা আমার’ অহংবোধ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে আমরা পারিনি। শহুরে মোড়লতন্ত্রের গ্রাম্য বিলাপ আজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

মার্চ ২০২১-এর শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লির ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও লাখ লাখ লোকের সংক্রমণের খবর সারা বিশ্বে আতঙ্ক শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল ২০২১ বাংলা নববর্ষের দিনেই বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো লকডাউন ঘোষণা করলো। এরপরে বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির কয়েকটা দিক উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি:

১. উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী হেফাজতের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীসহ মুজিব শতবর্ষ উদযাপন ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের সময় চালানো তাণ্ডবের কারণেই নাকি এই লকডাউন দেওয়া হয়েছে,  এই প্রোপাগান্ডা রাজনৈতিকসহ সামাজিক যোগাযোগের আঙিনায় ভাইরাল করা হলো। হেফাজতকে এমন এক ‘শক্তি’ বলে ধারণা দেওয়া হলো যে সরকার তাকে কোনোভাবেই দমাতে পারছে না।

২. সব স্তরের জনগণ রমজান মাসে লকডাউন দিয়ে সরকার ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত করছে এই প্রোপাগান্ডা চালু হবার পর ব্যবসায়ী, দোকান মালিক, খুচরো বিক্রেতা ইত্যাদি সংগঠনের লাগাতার  চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ৭২ ঘণ্টা পার হতে না হতেই বিভিন্ন ‘অব্যাহতি’ দেওয়া শুরু করলো। জনগণের যত্রতত্র ভিড় করাকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল কমার চেয়ে ঢেরগুণ বেড়ে গেলো। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান সবই ভেস্তে গেলো। রাষ্ট্র এক ইঞ্চি ছাড় দিলে জনগণের তাকে টেনে এক কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার বদভ্যাস আরও প্রকট হলো।

৩. এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছুই আগের মতো খোলা হলো। বিলাসবহুল মল থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার, পাইকারি খুচরো বিক্রেতারা সবকিছু স্বাভাবিক মজ্জায় ফের পথঘাটে দোকান খুলে বসলো। “মুভমেন্ট পাস”-এর আকস্মিক কার্যক্রম ওই “আকস্মিক”-ভাবেই গায়েব হয়ে গেলো।

৪. ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ‘সামাজিক দূরত্বের’ জুজু কখনোই কাজ করেনি আর মাস্ক পরা তামাশাই থেকে গেলো। ‘সরকার কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করবে’—এই ফাঁকাবুলি জনগণের কানের ধারেকাছে না ঢুকে ফাঁকা গুলির নেয় আকাশে উড়াল দিলো। বোঝা গেলো ‘বোকা’ জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার দিন শেষ।

৫. এলো ‘খুশির ঈদ’ এবং হাজারো সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আকুল আবেদন ‘যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করেন’ তারও কেউ পাত্তা দিলো না। যানবাহন সব বন্ধ থাকলেও বিকল্প পরিবহন, ইজিবাইক, প্রাইভেট মাইক্রোবাস, ফেরি, স্পিডবোট, নৌকা এমনকি পায়ে হেঁটে লক্ষ লক্ষ লোক শহর ছেড়ে জেলা শহর ও গ্রামে রওনা করলো। সরকার কেবল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। এই ‘খুশির’ মাঝে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে কি না, তার অনুসন্ধান এখনও হয়নি। আমাদের মতো তথাকথিত ‘সচেতন জনগণ’ এ-দৃশ্য দেখে শুকনো ঢেঁকুর গিললো ও ‘ঈদ শপিং’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

‘এত ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে জনগণকে হয়রানি করে কী লাভ’, অপরদিকে ‘এই লকডাউনে কোনও ফল আসবে না’ বা ‘হতদরিদ্র মানুষ এখন কী করবে’ এসব তর্কবিতর্কেরও শেষ নেই।

সরকারের দোটানা চিন্তা ‘লকডাউন দিলেও সমস্যা না দিলেও সমস্যা’—এই সরল সমীকরণ করে জনগণকে ফের তার ভাগ্য ও নিয়তির ওপরে ছেড়ে দিলো—কী বা করার আছে?

ফেসবুকে এলো এলিট শ্রেণির  অশনি সংকেত: ‘বুঝছো এসব গরিব ‘ইললিটারেট পিপল’দের ইরিস্পন্সিবিলিটির জন্য আমরা সবাই মরবো’—প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘আমরা’ আসলে কারা?

ফাস্ট ফরওয়ার্ড ২১ জুন ২০২১: ভারতের সঙ্গে বর্ডার সিল করা সত্ত্বেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকায় ঢাকা শহরকে সব বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। ঢাকাতে কেউ ঢুকতেও পারবে না বা বের হতেও পারবে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভেতরে এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে মৃত্যু ও সংক্রামণের হার দিনকে দিন হুহু করে বেড়েই চলছে।

দেশের ৪০টি জেলা আজ কোভিড সংক্রমণের ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’। ঢাকা শহরে যে এই ভ্যারিয়েন্ট থেকে মুক্ত তেমন কোনও সাক্ষ্য তথ্য নেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকা শহরকে কেবল অবরুদ্ধ রাখলে কি আমরা বেঁচে যাবো? ঘুরেফিরে আমরা এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতেও ঢাকাকেন্দ্রিক ‘টপডাউন’ চিন্তামুক্ত হতে পারছি না কেন? কী কারণে ঢাকা একাই এই পক্ষপাতমূলক ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে? এসব প্রশ্ন কোথাও নেই—এবং উত্তর আশা করাটাও বোকামি।

এই একচেটিয়া ভয়ানক সুড়ঙ্গ মার্কা মানসিকতার ফলশ্রুতিতে সামাজিক যোগাযোগসহ মেইনস্ট্রিম মিডিয়া গত বছর যতটা ঢাকা শহরে আক্রান্ত ও মৃত্যু দেখে মায়াকান্না ও আতঙ্কে বিভোর ছিল—তা এবার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ভাবখানা এমন যে ঢাকা বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কী অদ্ভুত দেশে আমরা বাস করছি!

তবে গত ক’দিনের তথ্য-উপাত্ততে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ এবং আগামী দু-সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ভাগ্যের লিখনিতে কী আছে তার এক ভাসা ভাসা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।

আমাদের শত্রু কোভিড, না—আমরা নিজেরাই নিজেদের বড় শত্রু। স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা ও নির্বুদ্ধিতা আমাদের ভয়াবহ এক অবস্থার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখান থেকে উত্তরণের কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ উপস্থাপন করে এই লেখার  ইতি টানছি:

  • দেশজুড়ে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করা।
  • ভ্যাকসিনের জন্য বয়স ৪০-এর নিচের ক্যাটাগরির কথা বিবেচনা করা ও কর্মসূচি সম্পন্ন না হওয়া অবধি দেশের প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টেস্ট করা।
  • আসন্ন কোরবানি ঈদে পশুর হাট বন্ধ ঘোষণাসহ ভারতীয় গরুর চোরাচালান রুদ্ধ করা।
  • পরিস্থিতি বেগতিক হলে কারফিউ জারিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারি নির্দেশ অমান্যকারী, বিশৃঙ্খলাকারীদের ‘দেখা মাত্র গুলি’ করার ক্ষমতা প্রদান।
  • বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যথা- চীন, ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফিলিপাইন কী করে কোভিড মোকাবিলা করছে তা অনুসরণ করা।

মরিয়া সময়ে মরিয়া মাপকাঠিতে বিচার না করতে পারলে আমাদের অবস্থা দিল্লিকে ছাড়িয়ে যাবে। যে জল্পনাকল্পনা চলছে—তা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ আমাদের নেই। সরকার ‘কঠোর’ হওয়ার হুমকি না দিয়ে অনতিবিলম্বে প্রকৃত অর্থে কঠোর হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

জানি, আমার মানবাধিকারবাদী বন্ধুরা এই লেখা পড়ে কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু তথাকথিত ‘মানবাধিকার’ কেবল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে সুরক্ষিত রাখার কোনও বিধান নয়। প্রতিটি নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারও মানবাধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিকূল সময়েও তা নিশ্চিত করা।

আগের অনেক লেখায় বলেছি এই মহামারি এক অঘোষিত ‘মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বযুদ্ধ’। ‘মানবিক যুদ্ধ’ বলে কোনও যুদ্ধ নেই। অমানবিকতা মোকাবিলা করতে মিষ্টি বাক্য বা রাজনৈতিক যুক্তিসিদ্ধতা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও, কখনও কোনও কাজে লাগেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থের ওপর ভর করা উচ্ছৃঙ্খল ও স্বার্থান্বেষী জনগোষ্ঠীকে অমানবিকতা দিয়েই ঘায়েল করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ