X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোটরসাইকেল কিংবা ‘চলমান কফিন’

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৭ জুন ২০২১, ১৯:৫৯আপডেট : ২৭ জুন ২০২১, ২০:০২
ডা. জাহেদ উর রহমান যুদ্ধবিমানের ইতিহাসে অন্যতম সফল যুদ্ধবিমান মিগ ২১। এই যুদ্ধবিমান সোভিয়েত ইউনিয়নে‌ প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তৈরি হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার, ব্যবহার করেছে পৃথিবীর ষাট‌টির বেশি দেশ। কয়েকটি ধাপে এর কিছু আপগ্রেডেশন হলেও দীর্ঘ সাত দশকের বেশি সময় পর এসে বিমানটিকে সেকেলে বলাই যায়। কিন্তু এখনও কিছু দেশের বিমান বাহিনী এটি ব্যবহার করে। এদের মধ্যে আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আছে। বাংলাদেশ একসময় এই বিমান ব্যবহার করলেও এখন আর করে না। তবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অতি গুরুত্বপূর্ণ বিমান চীনের তৈরি চেংদু জে ৭ আসলে মিগ ২১-এর একটি চীনা সংস্করণ। মোটরসাইকেল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই বিমানটির কথা কেন মনে হলো সেই প্রসঙ্গে আসছি কলামের শেষের দিকে। তার আগে কয়েক দিন আগের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ‌ শেয়ার করা যাক।

ছোট ভাইয়ের বাচ্চার ভীষণ ডায়রিয়া হলো কিছু দিন আগে। ডিহাইড্রেশনের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে সে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। সঙ্গে ছিল বমি, তাই মুখে ওষুধও খাওয়ানো যাচ্ছিল না। অগত্যা তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। একদিন রাতে ওকে দেখে বাসায় ফেরার জন্য হাসপাতালে নিচে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিলাম।

ঠিক তখনই দেখলাম পর পর দুটি রিকশা হাসপাতালের গেটে এলো। প্রতিটি রিকশায় তিন জন করে তরুণ। দুটো রিকশাতেই একই দৃশ্য– দু’জন তরুণ আরেকজন ভীষণভাবে রক্তাক্ত তরুণকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। কোনোমতে ধরে নামিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে ঢুকিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’টি বাইক এসে সে হাসপাতালের সামনে থামে। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারি আহত দুই তরুণ একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এভাবে আহত হয়েছেন। বাইক নিয়ে আসা তরুণ-তরুণীরা তাদের বন্ধু। একই সঙ্গে বাইক চালাচ্ছিল তারা। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য দেখা যায় সেই দুই তরুণকে বের করে আনা হচ্ছে হাসপাতালে ইমারজেন্সি থেকে; জানলাম তাদের রাখা হয়নি, নিয়ে যেতে বলেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা শেষে যখন সেই হাসপাতালেই আমি ইন্টার্নশিপ করছিলাম তখন বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা এই পর্যায়ে যায়নি; ছিল অনেক অনেক কম। কিন্তু সেই সময়েও বহু মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টের বীভৎসতার সাক্ষী হতে হয়েছিল ইমারজেন্সি এবং ক্যাজুয়ালটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সময়। প্রকৃতিগতভাবেই মোটরসাইকেলের একটা বড় সমস্যা আছে দুই চাকার বাহন বলে এটি খুবই আনস্টেবল। রাস্তায় পানি, কাদা কিংবা বালিতে ভারসাম্য হারাতে পারে। এমনকি হঠাৎ সামনে পড়া কোনও মানুষ কিংবা প্রাণীকে বাঁচাতে গিয়েও চালক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। আর অতি উচ্চ বেগে অসতর্কতায় চালানো তো আছেই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা মানে হলো এর চালক এবং আরোহী অতি দ্রুত বেগে রাস্তায় পড়ে যাওয়া, যেটা রিকশা ছাড়া আর কোন‌ও বাহনের ক্ষেত্রে হয় না।

এই দেশে অনেকেই মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পরে না। আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই চালক পরলেও তার সঙ্গে অন্য আরোহী পরে না। যারা হেলমেট পরেন তাদের খুব বড় একটি অংশ দুর্ঘটনায় যথেষ্ট প্রোটেকশন দিতে পারে এমন মানের হেলমেট পরেন না। এমনকি মারাত্মক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে একটি সঠিক মানের হেলমেটও যথেষ্ট নিরাপত্তা দেয় না। ফলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা বাংলাদেশের মতো দেশে খুব বীভৎস হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ মোটরসাইকেলের সংখ্যা অতি দ্রুত বাড়ছে। মানুষ তার ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে যেমন এটি কিনছেন তেমনি‌ বহু তরুণ অন্য কোনও কর্মসংস্থানের পথ না পেয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য মোটরসাইকেল কিনছেন। মোটরসাইকেল বাড়ছে মানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর খবর এখন প্রতিদিনকার মিডিয়ার সংবাদ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এরমধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনা। বুয়েটের এআরআইর হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন। অর্থাৎ দেশের সব সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনার পর আমরা সব সময় নিহতের সংখ্যা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু মারাত্মক আহত হওয়া কিংবা অঙ্গহানির মতো ঘটনাও ঘটে অনেক।

নানা কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্লান্তি নিয়ে চালানো, মাদক সেবন করে চালানো, অন্যান্য যান্ত্রিক যানবাহনের বেপরোয়া চালানো ও হঠাৎ লেইন পরিবর্তন, অযান্ত্রিক যানবাহনের হুটহাট মোড় ঘোরানো ও লেইন পরিবর্তন, রাস্তায় হঠাৎ গর্ত, ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা ও গতিরোধকে চিহ্ন না থাকা, পথচারীদের অসতর্কতা এবং হঠাৎ করে কুকুর, গরু-ছাগল রাস্তায় চলে আসা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ।

কিন্তু সব গবেষণায় একটা বিষয় নিশ্চিত হয়েছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো হলো– উচ্চগতি, ওভারটেকিং এবং হঠাৎ লেইন পরিবর্তন। আর আমি নিজে এখন দেখি রাস্তায় ছেলেরা অতি উচ্চ গতিতে পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দেয়; নানারকম কারিকুরি করে মোটরসাইকেল নিয়ে।

ঈদের তিন দিন পরে একটি সংবাদে দেখি নড়াইলের ৯ বন্ধু মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল পদ্মা সেতু দেখতে। পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটি মোটরসাইকেল একটি গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ে। মারা যায় ওই মোটরসাইকেলের আরোহী তিন বন্ধু।

আমরা যারা ঢাকায় থাকি তাদের কাছে মোটরসাইকেল এক মূর্তিমান উপদ্রবে পরিণত হয়েছে; অনুমান করি দেশের অন্যান্য জায়গায়ও পরিস্থিতি একই। রাস্তার শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পেছনে এই বাহনটির এক বড় দায় আছে। এই শহরেই ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চলা রোধ করার জন্য লোহার খুঁটি দিয়ে ব্যারিয়ার তৈরি করতে হয়েছে। রাস্তায় বহু মোটরসাইকেল চালকের উচ্ছৃঙ্খলতার ভুক্তভোগী কমবেশি আমরা সবাই। বাসের যাত্রী রিকশাচালকসহ এই শহরের বহু মানুষকে মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে তীব্র উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি।

ফিরে আসা যাক মিগ-২১ প্রসঙ্গে। অনেক বেশি পুরনো হয়ে গেছে বলে এই বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ার হার অনেক বেশি। আমরা খেয়াল করেছি, হয়তো এই কয়েকদিন আগে ঈদের পরপরই ভারতে আরেকটি মিগ ২১ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেক বেশি দুর্ঘটনায় পড়া এবং তার জেরে বহু পাইলটের জীবনাবসানের কারণে  ভারতে ডাকা হয় ‘ফ্লায়িং কফিন’ নামে। বিমানবাহিনী থেকে এই বিমানটি পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দাবি বহু সময় উঠেছে।

রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে ন্যূনতম শৃঙ্খলা না মেনে চলা মোটরসাইকেল দেখলে আমার মনে মিগ ২১-এর ছবি ভেসে ওঠে। আমার কাছে মনে হয় মোটরসাইকেল দেখছি না, দেখছি কিছু ‘চলমান কফিন’। যেকোনও মুহূর্তে বীভৎস দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়ে নিতে পারে এর আরোহীদের। মিগ ২১-এর দুর্ঘটনা ঘটে তার যান্ত্রিক সমস্যার কারণে, তাই এগুলোর পেছনে তার পাইলটদের দায়ভার প্রায় সব ক্ষেত্রেই থাকে না। কিন্তু এই দেশের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান অংশটাই ঘটে চালকদের অসতর্কতা এবং অসচেতনতার কারণে। অর্থাৎ এই মোটরসাইকেলগুলো চলমান কফিনে পরিণত হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্রেফ নিজেদের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য।

মোটরসাইকেল চালকদের শৃঙ্খলা, ট্রাফিক ‌আইন মানা (কিংবা মানতে বাধ্য করা) তাদের জীবন যেমন বাঁচাবে, আহত হওয়া কিংবা পঙ্গুত্ব থেকে যেমন রক্ষা করবে, রাস্তার শৃঙ্খলা যেমন অনেকটা নিশ্চিত করবে, তেমনি এই শহরের রাস্তায় বেরোনো লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রতি যে নেগেটিভ ধারণা রাখে সেটা থেকেও মুক্ত হবেন তারা।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ