X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ বছর পর জঙ্গির উপলব্ধি ‘সহিংসতা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না’

নুরুজ্জামান লাবু
০১ জুলাই ২০২১, ১০:০০আপডেট : ০১ জুলাই ২০২১, ১০:০০

‘সহিংসতা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যারা সহিংসতার মাধ্যমে ইসলাম বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে, তারা ভুল করছে। তরুণ বয়সে আমি ভুল নেতৃত্বে চালিত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পেরেছি যে, এই পথ সঠিক ছিল না। আমার মতো অসংখ্য তরুণকে আসলে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছিল। কারণ, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনোভাবেই জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। খুব সাধারণভাবে দ্বীনের পথে কাজ করতে হবে, কোনও সহিংসতা করা যাবে না।’

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর পর এই উপলব্ধি হয়েছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর এক শীর্ষ নেতার, যিনি ১৫ বছর ধরেই কারাবন্দি রয়েছেন। আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ নামে এই জঙ্গির সঙ্গে সম্প্রতি একটি বিশেষ ব্যবস্থায় কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাসনিম বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে বন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে ডজন খানেক মামলা রয়েছে।

আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ জানান, ২০০৪ সালে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা আমীর শায়খ আব্দুর রহমানের হাত ধরে জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয় তার। ওই বছরের কোনও এক শুক্রবারে ঢাকা জেলার ধামরাই এলাকার শরিফবাগের একটি মসজিদে জুমার খুতবা দিয়েছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান। খুতবা শেষে শায়খ রহমান জানতে চান কারা কারা জিহাদে শরিক হতে চান। শায়খ রহমানের সেই ডাকে হাত তুলেছিলেন তাসনিম নাহিদ। তখন থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

‘আম বয়ান শেষে শায়খ রহমান যখন জিহাদে শরিক হতে আগ্রহী কারা জানতে চান, অন্যদের সঙ্গে আমিও হাত তুলি। তিনি আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নেন। আমি তখন টঙ্গীতে তামির-উল-মিল্লাত আলিয়া মাদ্রাসায় আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিক সমমান) পড়ি। আমি টঙ্গীতে যে মেসে থাকতাম, সেই মেসের ঠিকানাও দিয়েছিলাম। শায়খ রহমান সেই মেসে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’—বলছিলেন আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ। তিনি ২০০৫ সালে সারাদেশে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার পর গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি রয়েছেন। ২০১৪ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে মাস ছয়েক বাইরে থাকার পর আবারও গ্রেফতার হন তিনি।

২০০১ সালে গোপনে কার্যক্রম শুরু করা জেএমবি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে ও প্রচারপত্র বিলি করে আলোচনায় আসে। অবশ্য গোপন তৎপরতার জন্য ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। তবে এর আগেই শায়খ আব্দুর রহমানসহ জেএমবির শীর্ষ নেতারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ করেছে। রাজশাহী-নওগাঁসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় জাগ্রত মুসলিম জনতা নাম নিয়ে তারা সর্বহারা দমনের কথা বলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞও চালিয়েছে।

২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় শায়খ আব্দুর রহমানসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের। ২০০৭ সালের ৩ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমানসহ শীর্ষ ছয় জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই আব্দুর রহমানের হাত ধরে চালু হওয়া জেএমবিরই একটি অংশ নব্য জেএমবি নামে আত্মপ্রকাশ করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ এবং হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালায়।

আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ জানান, টঙ্গীতে তার মেসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন শায়খ আব্দুর রহমান ও আতাউর রহমান সানী। সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের আলোচনা হয়। এ সময় সর্বহারা দমনের বিষয়টি নিয়েও তার সঙ্গে কথা বলেন শায়খ রহমান ও সানী। তৎকালীন সরকার তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে বলেও জানিয়েছিলেন তারা। এমনকি সরকারের সহযোগিতা নিয়ে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

‘কয়েক দফা মিটিং শেষে আমাকে জেএমবির ছাত্র শাখার নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি ও এনালাইসিস করার দায়িত্ব দিলেন তারা। এর আগে শায়খ আব্দুর রহমানের কাছে বায়াত (আনুগত্য স্বীকার করা) গ্রহণ করি আমরা। সঙ্গে আমার ভাই আব্দুল্লাহ আল সোহেল ও তৈয়বুর রহমান হাছানও ছিল। আমরা একসঙ্গে ছাত্র শাখায় কাজ করতাম। এ সময় দাওয়াতি ও সামরিক অর্থাৎ শারীরিক কলা-কৌশলের কিছু প্রশিক্ষণও আমাদের দেওয়া হয়। আমরা সেখানে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলাম।’—বলছিলেন তাসনিম নাহিদ।

তাসনিমের ভাই আব্দুল্লাহ আল সোহেল ২০০৫ সালের অক্টোবরে গাজীপুর কোর্টে বোমা হামলা মামলার আসামি ছিলেন। আদালত বিচার শেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি পলাতক রয়েছেন।

আব্দুল্লাহ আল তাসনিমের বাবার নাম অধ্যাপক আব্দুল হামিদ (মৃত)। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নিলেও তার পরিবারের সদস্যরা সবাই ছিল উচ্চ-শিক্ষিত। তার এক চাচা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, আরেক চাচা ছিলেন সচিব। টঙ্গীর তামির-উল-মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করে তাসনিম নাহিদ টাঙ্গাইলের করটিয়া কলেজে ইংরেজি বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন।

তাসনিম নাহিদ বলেন, ‘টঙ্গীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য জোশের সঙ্গে কাজ করেছি। টাঙ্গাইলে গিয়েও একই কাজ করতাম। সংগঠনের কাজে আশেপাশের জেলাগুলোতেও ভ্রমণ করতাম। আমরা সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করতাম। সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ইয়ানত সংগ্রহ করে তা শায়খ আব্দুর রহমান বা শীর্ষ নেতাদের কাছে জমা দিতাম। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা সবকিছু উলট-পালট করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। ২০০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।’

তাসনিম নাহিদের ভাষ্য, জেলে গিয়েও জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যান তিনি। ছোট বেলা থেকেই ইসলামি বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। জেলে গিয়েও সহকর্মী ও আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করতেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে জামিন হয় তার। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাকে জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে যায়। পনের দিন তাকে কাউন্সেলিং করানো হয়। এরপর ছাড়া পান তিনি।

তাসনিম বলেন, ‘জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি সৌদি আরবে চলে যাওয়ার চেষ্টা করি। এ জন্য পাসপোর্টও তৈরি করেছিলাম। এর মধ্যেই নাঈম নামে এক পূর্বপরিচিত জেএমবির সাথীভাই সারোয়ার জাহান মানিককে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা আমাকে নব্য জেএমবিতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাদের পরিকল্পনার কথা আমি শুনি। তারা তামিম আহমেদ চৌধুরী নামে একজন বিদেশি নাগরিকের দ্বীনের কাজ করার জন্য দেশে আসার কথা বলেন। তামিম সিরিয়ায় ত্রাণ সংস্থায় কাজ করতো বলে জানান এবং তার লন্ডন-আমেরিকার অনেক লিংক আছে, যারা বিপুল অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করবে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা আমার কাছে আরও বেশি উগ্র টাইপের মনে হয়।’

তাসনিম জানান, মানিক ও নাঈমের সঙ্গে তার কয়েক দফায় মিটিং হয়েছিল। তাদের বক্তব্য শুনেছেন। তারা তাকে নতুন করে বায়াত নিতে বলেন। কিন্তু তিনি তাদের ডেস্ট্রাক্টিভ চিন্তা-ভাবনায় সমর্থন করেননি বলে দাবি করেন। এর মধ্যেই তার সঙ্গে সামিউন ইবনে হামদুন নামে একজন বৃটিশ নাগরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। গুলশান আজাদ মসজিদে বসে একাধিকবার মিটিং হয়েছে। এমনকি সিলেটে গিয়েও তারা মিটিং করেছেন। তখনও খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য হন্যে হয়ে নতুন কোনও পথ খুঁজছিলেন তিনি।

সারোয়ার জাহান মানিক হলো নব্য জেএমবির একজন শীর্ষ নেতা, গুলশান হামলার আগে পাঁচ জঙ্গি তার হাতেই বায়াত নিয়েছিল। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর র‌্যাবের এক অভিযানে আশুলিয়া এলাকায় নিহত হন তিনি। নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার ও গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমে চৌধুরী নিহত হন ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক অভিযানে। আর সামিউন ইবনে হামদুনকে ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তিন বছরের মাথায় জামিনে বেরিয়ে গোপনে ভারতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হন তিনি। বর্তমানে ভারতের কারাগারে বন্দি থাকা সামিউন সিরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ঢাকায় এসে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন-আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিলেন।

তাসনিম বলেন, ‘সারোয়ার জাহান মানিক এবং সামিউন কারো সঙ্গেই আমার মতের মিল হয়নি। কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার কারণে বিষয়টি টের পেয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর আবারও শুরু হয় বন্দিজীবন। এখন আমার মনে হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠা বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য আমি যে পথে গিয়েছিলাম, সেটি সঠিক ছিল না। সহিংসতা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইসলামের জন্য কাজ করতে চাইলে করতে হবে খুবই সাধারণভাবে, জোর-জবরদস্তি করে নয়।’

‘আমার উপলব্ধি হয়েছে। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ করতে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমি তাদের বলেছি, যদি সুযোগ পাই, আমি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করতে চাই। আমাকে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ব্যবহার করেন। কিন্তু কপালে কী আছে আমি জানি না। হয়তো আমার আর জেলের বাইরেই কোনোদিন যাওয়া হবে না।’—দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন প্রায় পনের বছর ধরে বন্দিজীবন কাটানো শীর্ষ জঙ্গি নেতা আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ।

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া