X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার কি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘বলির পাঁঠা’ বানাবে?

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৮ জুলাই ২০২১, ১৭:১২আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২১, ১৭:৩৯

ডা. জাহেদ উর রহমান

এক বছর পেছনে যাওয়া যাক। করোনার শুরুর দিকে এই রোগ মোকাবিলার প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিয়মিত মানুষের সামনে ব্রিফিং নিয়ে আসতেন। করোনায় তখন নানা রকম অব্যবস্থাপনা। নানারকম সমন্বয়হীনতা। নানা রকম তথ্য গোপনের অভিযোগ। মানুষ তাকে সামনে পাচ্ছিল এবং যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দেওয়া হচ্ছিল তার ওপর। এক অবিশ্বাস্য অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন তিনি।

আসা যাক সাম্প্রতিক সময়ে। ‌সংসদ উত্তাল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিতে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতারাও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চরমভাবে তুলোধুনো করছেন। তাকে নির্লজ্জ বলছেন, পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন। মূল ধারার মিডিয়াতেও অনেক রিপোর্ট হয়েছে তার বিভিন্ন ব্যর্থতা নিয়ে। সামাজিক মিডিয়াতেও দেখছি ভীষণ বিষোদগার করার ধুম।

করোনার কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপরে মিডিয়ার স্পটলাইট। তাই আমরা একের পর এক রিপোর্ট দেখছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি নিয়ে। বলাবাহুল্য, এসব যেহেতু আমাদের গায়ে সরাসরি এসে লাগছে, আমাদের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে, তাই আমরা ক্ষুব্ধ হচ্ছি খুব। বর্তমান পরিস্থিতিটা দেখলে মনে হবে যে বাংলাদেশের আর সব মন্ত্রণালয় অসাধারণ চলছে।

খুব স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যতটুকু অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ, বাংলাদেশের আর সব মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও কমবেশি একই রকম। যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই কলামের আলোচনার বিষয় তাই অন্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কথা সরিয়ে রাখি আপাতত।

খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যত ব্যর্থতা সেটা কি শুধু এই মন্ত্রণালয়ের‌ই? কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বুঝে নেওয়া যাক।

সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই জানেন এই উপমহাদেশে জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে। মাস দুয়েক আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, স্বাস্থ্য খাতে কম বাজেট বরাদ্দের মাশুল আমরা দিচ্ছি।

এই করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সেরকম কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। অথচ নতুন অর্থবছরের বাজেটে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা (হেলথ অ্যান্ড ওয়েল-বিয়িং) খাতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করেছেন আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ সেই দেশের স্বাস্থ্য বাজেট আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় আড়াইগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সম্পূরক বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে এই বছরের বাজেট বরাদ্দ মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। তাহলে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা কি পাওয়া গেছে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ কেনার জন্য?

এটার একটা জবাব সরকারের অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। তারা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে বরাদ্দ দেওয়া টাকাই ঠিকমতো খরচ করতে পারে না, তাহলে কেন বরাদ্দ বাড়ানো হবে? সরকারের বাইরের কাউকে কাউকেও এই যুক্তি দিতে দেখা যায়। গত অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের সর্বশেষ তথ্য এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে দেখা যায়, অর্থবছরের ১০ মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ভীষণ কম। সার্বিকভাবে এই হার যখন ৪৯ শতাংশ তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের পরিমাণ ২৫ শতাংশ।

নাগরিক হিসাবে আমরা একটা কথা খুব স্পষ্টভাবেই বলতে পারি, দশ মাস পরে এসে তো এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে দেখা যায়নি, মাসের পর মাস ধরে নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এমনকি করোনার মতো সময়ে। দেশের হাসপাতালগুলো করোনার চিকিৎসা সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতির জন্য দফায় দফায় চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে।

হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা, জনবল প্রশিক্ষণ, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মতো অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাসিলিটি দফায় দফায় চেয়েও পাওয়া যায়নি।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা তো খুব সিরিয়াসলি প্রশ্ন করতেই পারি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্প পাসের ক্ষেত্রে এবং অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোথাও সমস্যা করেছিল? আর যদি সমস্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে হয়ে থাকে তাহলে সরকার সেই সমস্যা দূর করতে কী করেছে? এই মন্ত্রণালয় তো বিরোধী দল চালায় না, এটা ক্ষমতাসীন সরকারেরই একটা অংশ।

গত বছরের একটা পর্যায়ের পর থেকে তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আমলাদের। আজ এই পর্যায়ে এসে আমরা প্রশ্ন করতেই পারি, এই আমলা নির্ভরতার প্রশাসনিক কতটুকু সুফল দেখছি আমরা?

করোনার এই পুরো সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, লকডাউনসহ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে কোনও আলোচনাই করা হয়নি; প্রশাসনিক আমলারা তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রশাসনিক আমলাদের দায়িত্ব দেওয়া এবং তাতেও ব্যর্থতার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেওয়া যাক। করোনার শুরু থেকেই কেনাকাটায় দুর্নীতি এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সংকটের অভিযোগ মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল স্টোর (সিএমএসডি)-এর পরিচালক পরিবর্তন করা হয়। প্রচলিত রীতি ভেঙে এই পদে ডাক্তারকে বাদ দিয়ে একজন প্রশাসনিক আমলা বসানো হয়। একটা উপ-সচিব পদমর্যাদার পদে একজন অতিরিক্ত সচিব বসানোজনিত নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এটাই হয়েছে। সেটা এর কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান আদৌ কোনও দক্ষতা দেখাতে পারেনি এবং দুর্নীতির অভিযোগ এখনও আছে।

জুন মাসের শেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বর্তমানে সিএমএসডিতে কোনও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, রেমডিসিভির ইনজেকশন, কোভিড-১৯ টেস্টিং কিট ও ভেন্টিলেটর নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুত নেমে এসেছে পাঁচ হাজারে। সেই রিপোর্টে জানা যায়, করোনা বাড়তে শুরু করায় এপ্রিল-মে মাসে নানা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের রিকুইজিশন দিয়ে বহু সিভিল সার্জন কিছুই পাননি। এই প্রশাসনিক আমলাকে তো অনেক ওপর থেকে এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনিও সমপরিমাণ ব্যর্থ। তাহলে দেশের অতি পরাক্রমশালী প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র কি সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় নেবে না?

জরুরি পরিস্থিতি জরুরি পদক্ষেপ ডিমান্ড করে। করোনার মতো এক অতি জরুরি পরিস্থিতিতে খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, প্রাসঙ্গিক সব মন্ত্রণালয়ের একটা সমন্বিত মনোযোগের মাধ্যমে সবার প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সুন্দরভাবে চালানো যেত। কিন্তু সেগুলো কোনও কিছুই করা হয়নি। ক্ষমতাসীন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো কোনও বিরোধী দল চালাচ্ছিল না। তাহলে সেই মন্ত্রণালয়ের সঠিক কাজ করার জন্য সমন্বিত কোনও ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি?

এর একটা জবাব অনেক সময়ে চিকিৎসকরা দিয়েছেন। সিএমএসডি’র পরিচালক নিয়োগে রীতি ভেঙে প্রশাসনিক আমলা বসানোর পর সরকার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের সভাপতি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি এবং অন্যান্য অনেক চিকিৎসক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ব্যর্থ দেখিয়ে ধাপে ধাপে প্রশাসনিক আমলারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নিতে চায়।

আমি কোনোভাবেই এটা বলতে চাইছি না স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনও দোষ নেই, উনি খুব দক্ষ-যোগ্য মানুষ। নিশ্চিতভাবেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় সমস্যার পেছনে তার দায় খুব ভালোভাবেই আছে। মোটামুটি সভ্য একটা দেশ হলে এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন অনেক আগেই। কিন্তু আমি যে কথাটা বলার চেষ্টা করছি, সেটা হলো করোনা ম্যানেজমেন্টে যে ব্যর্থতা সেটা সার্বিকভাবে সরকারের ব্যর্থতা, শুধু এই মন্ত্রণালয়ের নয়।

‘বলির পাঁঠা’ ধারণাটি এসেছে ওল্ড টেস্টামেন্টের লেভিটিকাস-এর ষোড়শ অধ্যায় থেকে। পুরো ইসরায়েল জাতির পাপ মোচনের জন্য দুটো ছাগল/ভেড়াকে বলি দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে সেখানে। দুটির মধ্যে একটি ছিল ‘গোট ফর আজাজেল’, যেটিকে ইংরেজিতে ‘স্কেপগোট’ নামকরণ করা হয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সরকারের একটা ভালো কৌশল হতে পারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো—করোনা ম্যানেজমেন্টের সব ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে তাকে পদত্যাগ করানো বা বরখাস্ত করা। স্বাভাবিক যুক্তিতে জনগণের কাছে মনে হতে পারে যে সরকার এই ব্যর্থতা কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে চাইছে নতুন কাউকে দিয়ে। ওল্ড টেস্টামেন্টের বলির পাঁঠাটি ‘নিষ্পাপ’ ছিল, কিন্তু তাকেও বলি দেওয়া হয়েছিল জাতির পাপ মোচনের জন্য। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘বলির পাঁঠা’ বানালে সেটা আরও গ্রহণযোগ্য। কারণ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী পৌরাণিক পাঁঠাটির মতো ‘নিষ্পাপ’ নন।

সবদিক থেকে সমস্বরে চিৎকার হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। সরকার কি এমন কিছু করতে যাচ্ছে? কোনোভাবেই না। সরকার খুব ভালোভাবেই জানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া মানে করোনা ম্যানেজমেন্টে যে বাংলাদেশ খুব খারাপ করেছে সেটা স্বীকার করে নেওয়া। একই সঙ্গে তারা এটাও জানে এই ব্যর্থতা আসলে শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর না, পুরো সরকারের। তাই তাকে সরানো মানে সরকারকেই ব্যর্থ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। 

আমি নিশ্চিত, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার কথা দূরে থাকুক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি নেহায়েত প্রচণ্ড লজ্জায় পড়ে পদত্যাগ করতেও চান, ক্ষমতাসীন দল তাকে পদত্যাগ করতে দেবে না। তাই আমরা সবাই নিশ্চিত থাকতে পারি, অনাগতকালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার স্বীয় পদেই বহাল থাকছেন।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ