X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লা হয়ে বস্তায় ঢোকা জীবন

জোবাইদা নাসরীন
১১ জুলাই ২০২১, ১৮:১০আপডেট : ১১ জুলাই ২০২১, ১৮:১০
জোবাইদা নাসরীন গতকাল করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৮৫ জন, তার আগের দিন ছিল ২১২ জন। এর সঙ্গে  নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আগুনে পোড়া ৫২ জন যোগ হয়েছে। দেশ লকডাউন চলছে, অনেক কিছুই বন্ধ। কিন্তু কারখানাগুলো বন্ধ থাকেনি। পুঁজির বাজারে সস্তা শ্রমের জোগান বন্ধ করবে কে? তাই বিশেষ ব্যবস্থায় সব কলকারখানা খোলা রাখার ঘোষণা লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই ছিল। শ্রমিকরা করোনা ভয়ের ঊর্ধ্বে, তাদের একটাই পরিচয়, তারা শ্রমিক। তাই তারা জ্বলবে, মরবে কিংবা বকেয়া বেতন ভাতার দাবি নিয়ে রাজপথে মিছিল করবে। কারণ, তাদের শ্রম সস্তা, জীবন সস্তা, এমনকি ক্ষয়ে যাওয়া হাড়গুলোও আগুনের শিখায় ছাই হয়ে যায়।

গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি যে গত ৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতার কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির কার্টন ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যায়। সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ২০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। প্রথম দিন তিন জনের মৃত্যু সংবাদ এবং অনেকে নিখোঁজ থাকলেও ৯ জুলাই দুপুর থেকেই  কারখানার ভেতরে আগুনে ঝলসে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ বের করার কাজ শনিবার পর্যন্ত করে গেছেন উদ্ধারকর্মীরা। কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর এ পর্যন্ত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। প্রথমেই  আগুনে নিহত তিন জনের লাশসহ এখন পর্যন্ত মোট ৫২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ওই কারখানার পাঁচ ও ছয়তলার ফ্লোর দুটোতে আগুন ডাম্পিংয়ের কাজ করে চলছে ফায়ার সার্ভিস। বলা হয়েছে যে, ডাম্পিংয়ের কাজ শেষে সেখানে আরও লাশ আছে কিনা সেটি জানা যাবে।

তবে অনেক লাশই পুড়ে এমন কয়লা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে সেই ব্যাগের ভেতরে আসলে শরীর হয়তো নেই,  আছে শুধু কয়লা। জানা গেছে, লাশ শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হবে। এখনও  প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। সে রকম এক নারী শ্রমিকের মা মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে অনুরোধ করেছেন  মেয়ের হাড়গোড় পাওয়ার জন্য। কর্তৃপক্ষের সূত্রমতে  সেই কারখানায় দুইশত শ্রমিক কাজ করতেন। এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও এই কারখানায় বেশিরভাগ শ্রমিকই ছিলেন শিশু। কারণ, এই শিশু শ্রমিকদের কম বেতন দেওয়া যায় এবং ঘটনার পরে পত্রিকা প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানা যায় যে এই শিশু শ্রমিকদের কয়েক মাসের বেতনও বকেয়া রাখা হয়েছিল। তবু একটু জীবনের  তাড়নায়, বেতন পাবে এই আশায় সেই শিশু শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছিলো।  আগুন থামাতে দেরি, মৃত্যু, নিখোঁজ, স্বজনদের আহাজারি সবকিছু  বিক্ষুব্ধ করেছে স্থানীয় জনগণকে। তারাও ভাঙচুর করেছে।

বিক্ষুব্ধ আসলে সবাই। এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন মনে হয় জীবনে কখনও যেন আর এ ধরনের ঘটনা না দেখতে হয়। কিন্তু তা কী হয়! কয়েক দিন পরপরই এ ধরনের ঘটনা এখন শোকের পাশাপাশি ক্ষোভকেও সমানভাবে পোষে। তবু এ দেশে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। প্রাথমিকভাবে যা জানা গেছে তা হলো ভবনটির প্রত্যেক তলায় বিকল্প সিঁড়িতে তালা লাগানো ছিল। এ কারণে শ্রমিকরা আগুন লাগার পরেও বের হতে পারেনি। তাজরীন গার্মেন্টস কিংবা রানা প্লাজার মতো বড় ধরনের ক্ষত তৈরির ঘটনাতেও পরিস্থিতি পাল্টায় না। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পরে দেশের বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়ে একটা কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতা এবং কোম্পানিগুলোর চাপ অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সেটি দেশের সব কারখানায় প্রয়োগ করা হয়নি। যেখানে বিদেশের চাপ নেই, সেখানে স্বভাবতই খুব বেশি নজর  কারোরই নেই।  তাই সেখানে শ্রমিকের স্বার্থ আটকে থাকে তালায়। এমনটা হয়তো অনেক কারখানাই আছে, আগুন লেগে প্রাণ খেলেই খুলে যায় তাদের আসল অবস্থা। বেশিরভাগেই বিচার হয় না, কিছু দিন আহাজারি, কান্না আর ‘বিচার চাই’ স্লোগান ওঠে। এর বাইরে আর কিছুই হয় না। তাই মালিকরাও তাদের অবস্থা এবং অবস্থান থেকে সরে না।

শ্রমিকদের জবানিতে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সেজান জুসের এই কারখানায় প্রচুর তৈরি জুস, নিচতলায় কার্টন এবং পরিত্যক্ত মালামাল, তৃতীয় তলায় হিট মেশিন, চারতলার পশ্চিম পাশে স্টোর রুমে বিপুল পরিমাণ তৈরি প্যাকেট এবং প্যাকেট তৈরির কাঁচামাল মজুত ছিল। আরও  ছিল এসব কাজে ব্যবহার করার জন্য প্রচুর রাসায়নিক দ্রব্য। কারখানায় এই রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক, কাগজ, মোড়ক তৈরি করার প্রচুর সরঞ্জাম মজুত থাকায় আগুন মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

সজিব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনা তদন্তে নিয়ম মাফিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানি না সেই রিপোর্ট আদৌ প্রকাশিত হবে কিনা, প্রকাশিত হলেও সেটিকে আমলে নেওয়া হবে কিনা? প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তর  ‘না’এর দিকেই বেশি। শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এটিকে আমলে নেওয়া।

কারণ, এ দেশে শ্রমিকদের জীবনের দাম নেই, মৃত্যুর দামের প্রশ্নই আসে না। তাই ওই পঞ্চাশ বস্তা কয়লায় মিছে হাড় খুঁজে কী লাভ! পরিবার হা-পিত্যেশ করবে, কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজের কী আসে যাবে? মালিকরা প্রতিনিয়তই আরও সস্তায় শ্রমিক পাবে, কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রণোদনা পাবে। কী হবে এই কয়লায় রূপান্তরিত হওয়া ৫২ জন শ্রমিকের পরিবারের? তারা কি আদৌ বিচার এবং ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাবে?

ইতিহাস বলে অন্য কথা। আমরা খুব সহসাই ভুলে যাই, কিংবা ভুলে যাবার ভান করি। তা না হলে বারবার কেন ঘটবে এ ধরনের ঘটনা? আমাদের চর্চিত রাজনীতিই শেখায় আমরা কোনটা ভুলে যাবো আর কোনটা মনে রাখবো। কারণ, আমাদের শ্রমিকের হত্যার ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করাই শিখানো হয়।

আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না, অভিজ্ঞতা থেকে কিছু অর্জন করি না। আমরা নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি আমাদের ক্ষমতা অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আজকের ৫০ কিংবা রানা প্লাজার ১২শ’ জীবনের ক্ষত কয়েক ঘণ্টায়ই শুকিয়ে যায়।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ