X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষগুলোর শূন্যতাই বিশৃঙ্খলার কারণ

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
১২ জুলাই ২০২১, ১৬:৫১আপডেট : ১২ জুলাই ২০২১, ১৬:৫১
হায়দার মোহাম্মদ জিতু আমেরিকার রসবোধসম্পন্ন লেখক মার্ক টোয়েন সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়াল নির্মাণের জন্যে চাওয়া চাঁদার দাবিতে জানান, সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়াল দেওয়ার কোনও প্রয়োজন দেখি না। কারণ, যারা ওখানে থাকে তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। আর যারা বাইরে থাকেন তাদের ওখানে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে আছে বলে আমার মনে হয় না। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং উদ্যোগকে সামনে রেখে যারা ব্যবসা করেন তাঁদের চপেটাঘাত করেছেন।

এরকম রসদ এবং সরবরাহকে সামনে রেখে এখানেও কিছু বাতুলতা গজিয়েছে। ফলাফল, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অযাচিত বিশৃঙ্খলা এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এর কারণ যে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থান সেটাও বুঝতে বাকি নেই। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নের রিলে দৌড়ে এক দুরন্ত গতির ঘোড়া, যা বিশ্বের কাছে অনন্য এবং বিস্ময়কর।

সে হিসেবেই এখানকার মানুষের মাঝে এখন উদ্বৃত্ত অর্থের জোগান আছে। যা তাদের বিনোদনের তৃষ্ণাবোধকে আরও প্রেরণা জুগিয়েছে। আর রাজধানী যেহেতু বহুত্ববাদকে জড়িয়ে এগিয়ে চলতে চাইছে, তাই এখানে বহুত্ববাদীয় সুবিধা-সংস্কৃতি ভাড়া করে হলেও আনতে হচ্ছে, চালাতে হচ্ছে। অথচ বাঙালি সংস্কৃতির যে অফুরান ভাণ্ডার সেখান থেকে পাশ্চাত্যের আহরকবৃন্দ রসদ সংগ্রহ করে নিজেদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে চলেছেন। যেমন ব্রেখটের এলিয়েনেশন তত্ত্ব বাঙালির বাউল সংস্কৃতি থেকে নেওয়া। যেখানে সুর-সংগীত এবং নাটকীয়তার মাঝে পয়ার ছন্দ-ছড়ায় কিংবা কথায় নানান বার্তা, কথা, গান পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ দর্শককে একঘেয়েমি বিনোদনের বাইরে প্রশ্ন উত্থাপনের সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়া হয়।

অথচ এর বিপরীতে এখানকার সংস্কৃতি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। যদিও এই সময়টায় বুক চিতিয়ে লড়াই চলেছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। ফলাফল আজকের উদ্বৃত্ত অর্থনৈতিক অবস্থান। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ আজ এশিয়ার সুপার পাওয়ার হওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে শ্রীলংকা এবং আফ্রিকার একটি দেশকে ঋণও দিয়েছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি তকমার বিপরীত বা ওই চিন্তার চপেটাঘাত।

যদিও এও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এই পয়সা গোনার হিসেবে ব্যস্তানুপাতিক হয়ে উঠেছে এখানকার সংস্কৃতি চর্চা। আরও স্পষ্ট করে বললে, পয়সার উদ্দামতায় সংস্কৃতির ক্ষমতা খর্ব হয়ে চলেছে। যার ফলাফল এখানে বিত্তশালীদের  ক্লাব পাড়া, ডিজে সংস্কৃতি এবং হাত বদলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারাকে অবলম্বন করতে গিয়ে ঘটছে বিপত্তি। সাম্প্রতিক ক্লাব সংস্কৃতির বিপদে পড়া এমন নারীদের গল্পও উঠে আসতে শুরু করেছেন। যার শুরুটা হয়েছে শোবিজ জগতের একজন নারীর মাধ্যমে।

তার অভিযোগকে কেন্দ্র করেই ক্লাব সংস্কৃতির নেপথ্যের গল্প এবং পক্ষে-বিপক্ষের মতামত উঠে আসছে। যদিও এও সত্য ইদানীং এখানে এমন এক পরিস্থিতি চলছে যে যাই ঘটুক, যেভাবে ঘটুক কিছু জেনে হোক না জেনে হোক পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলে। যা প্রতিক্রিয়াশীল আচরণকেই ইঙ্গিত করে। তবে এই আচরণ যে আগামীতে আরও প্রকোপ হবে এটাও নিশ্চিত।

কারণ, একটা সময় ছিল যখন এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে সংগঠন করেছেন, থিয়েটারসহ ছোট ছোট করে সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করেছেন। তৎকালীন সময় তাঁদের বোকা বা তাচ্ছিল্য করলেও আসলে এই মানুষগুলোর শূন্যতাই আজকের বিশৃঙ্খলার কারণ। তাদের অনুপস্থিতির কারণেই এখন সংস্কৃতি চর্চার বিষয় চলে যায় সরকারি বাজেট কিংবা পরের ঘাড়ে দায়িত্বে। অথচ ব্যক্তি উদ্যোগ বা ক্লাব সংস্কৃতিতেই এই সংস্কৃতি চর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে।

তবে তা অবশ্যই বর্তমান সময়ের ক্লাব সংস্কৃতির আদলে নয়। যেখানে ক্লাবের নিয়ম থাকে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে বাইরে জানানো যাবে না। ঘোরতর অন্যায় করলেও শাস্তি হিসেবে ক্লাব থেকে সাময়িক ও স্থায়ীভাবে সদস্য পদ বাতিলেই শেষ ! তবে ম্যাজিকাল বিষয় হলো, এই ক্লাব সংস্কৃতির আওতায় আসতে হলে ৩০/৫০ লাখ থেকে ১ কোটি বা কোথাও কোথাও আরও বেশি অর্থ লগ্নি করতে হয় এবং ইদানীং সেখানে সরকারি কর্মচারীরাও যুক্ত হচ্ছেন। যা তাদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

কাজেই এই ক্লাবগুলোর সদস্যপদ ধরে ধরে এদের অর্থের উৎস এবং সরকারি ট্যাক্সের বিষয়ে তদন্ত জরুরি। এতে দুর্নীতি বহুলাংশে নিরুৎসাহিত হবে। পাশাপাশি সেখানকার উদ্বৃত্ত অর্থ যদি বৈধ হয়ে থাকে তবে তারা যে সেটাকে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা এবং বিকাশে কাজে লাগাতে পারেন, সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

দৃশ্যমান দালান কাঠামোয় সংস্কৃতি চর্চা এবং বিকাশ নির্ভর করে না। কাজেই এই শিল্পকলা এবং চেয়ার-টেবিল নির্ভর সংস্কৃতি চর্চার খপ্পর থেকে বেরোনো জরুরি। কারণ, রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত বাজেটের প্রায় সবটাই এই দালান সংরক্ষণ এবং এর সঙ্গে যুক্ত কর্মচারী পালতেই যায়। শুধু তাই নয়, দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি এদের এতটাই অজ্ঞতা যে দেশের প্রায় প্রতিটি মঞ্চই পাশ্চাত্যের প্রসেনিয়াম আর্চ ধাঁচের নির্মাণ করেছেন। যেখানে এ দেশের পরিবেশনা রীতি দর্শকদের ভেতরে থেকে অর্থাৎ এরিনা ফর্মেটের।

বাঙালি সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ উভয়েই সমসম্মানের। কিন্তু দিনে দিনে এর চর্চাহীনতার কারণে আজ বিশ্বজয়ের বাংলাদেশেও মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ বিদায়ে নারী ইউএনওকে অগ্রাহ্য করার প্রস্তাব আসে। অর্থাৎ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উৎকর্ষতায় নিবেদিত হলেও মানসিক মানচিত্রে আজও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

তাছাড়া এ ধরনের আচরণ মুক্তিযুদ্ধের সম্মানকেও খাটো করে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে সমতল-অসমতলের সব নারী-পুরুষ যৌথভাবে লড়াই করেছেন। কাজেই রাষ্ট্রের নারী কর্মচারীকে যারা বাদ দিতে সুপারিশ করেছেন তাদের মনস্তাত্ত্বিক মানচিত্রও বিশ্লেষণ জরুরি। পাশাপাশি ক্লাব সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব উদ্যোগের প্রতি যত্নশীল এবং নজরদারি প্রয়োজন। নইলে আবারও ক্লাবপাড়ায় যৌন নির্যাতনের অভিযোগ কিংবা টিকটকের মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে সেলিব্রেটি হওয়ার ঝোঁকে নারী পাচারের ঘটনা ঘটবে।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ

[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ