X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
বাড়ছে নদীভাঙন

ভিটেহারা মানুষগুলো আর ফিরে যেতে পারে না

আমানুর রহমান রনি
১৪ জুলাই ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২১, ১৪:০৩

মিতুল রানী (৪৫), থাকেন রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তির একটি ঝুপড়ি ঘরে। মেঘনার ভাঙনে ঘর হারিয়ে আশির দশকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভোলার মনপুরা থেকে আসেন ঢাকার এ বস্তিতে। এখানে বড় হয়েছেন। বিয়ে ও সন্তানের জন্মও এখানে। আর কখনও মনপুরা ফেরা হয়নি তার।

সাততলা বস্তির নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বাপ-দাদার ভিটে হারানোর দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে করে মিতুল রানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছোটবেলায় এই এলাকায় আসি। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি পরিবার ছিল। ঘরবাড়ি সব নদীতে ভেঙেছে। আমার বাবা এবং শ্বশুর একই এলাকার ছিলেন। তারা একসঙ্গেই এখানে আসেন।’

মিতুল রানী বলেন, ‘সংসার চালানোই দায়। লেখাপড়ার উপায় ছিল না। বড় ছেলে গাড়ি চালানোর শেখার পর সংসার চালাচ্ছে।’

মনপুরায় এখন মিতুল রানীর কেউ নেই। তাই কারও সঙ্গে দেখা করতেও যাওয়া হয় না। মিতুল রানী বলেন, ‘মনপুরায় যাবো কই। যা ছিল সব তো নদীর মাঝখানে। এখন দিন আনি দিন খাই। জায়গা জমিও আর জুটবে না। বস্তিতেই বাকি জীবন কাটবে।’

মিতুল রানী

মিতুল রানীদের সঙ্গে মনপুরা থেকে আসা অপর হিন্দু পরিবারগুলোর অবস্থাও একই। তারাও নিজের গ্রাম বা এলাকায় ফেরার স্বপ্ন দেখছেন না আর।

মহাখালীর সাততলা ও বনানীর কড়াইল বস্তিসহ বেশ কয়েকটি বস্তি ঘুরে দেখা গেছে অসংখ্য নদীভাঙা মানুষ এখানে বাস করছেন কয়েক দশক ধরে। এমনও আছেন, যাদের দুই-তিন প্রজন্মও বাস করছে বস্তিতে।

দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা বরগুনার নাহিদা আক্তার (২১)। বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর হলো। বরগুনার তালতলীর ছোট বগী গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। নদীভাঙন ও দারিদ্র্যতা ঘিরে ধরলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তার স্বামী জুয়েল একজন দিনমজুর। সাততলা বস্তিতেই থাকেন স্বামী-স্ত্রী। বাড়িঘর নেই। তাই গ্রামে ফেরারও আর সুযোগ নেই তাদের।

নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকা আসতে বাধ্য হয়েছিলেন ভোলার দক্ষিণ আইচা থানার মাঝেরচরের রাজমিস্ত্রি লাল মিয়া। একই থানার নুর ইসলাম হাওলাদার, ইব্রাহীম, সালমা আক্তার ও নিপা আক্তারসহ অনেকেই আসেন তার সঙ্গে। প্রত্যেকেই এখন সাততলা বস্তিতে আছেন পরিবার নিয়ে।    

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন কয়েক বছর ধরে সাততলা বস্তিতে থাকেন। বছর পাঁচেক আগে পদ্মার ভাঙনে জমি ও ভিটে হারায় তার পরিবার। এরপরই ঢাকায় আসেন বাধ্য হয়ে। পেশায় রিকশাচালক জসিমের জানা নেই, আদৌ আর নিজের জন্মস্থানে ফিরতে পারবেন কিনা। বস্তির ছোট্টঘরে স্ত্রী রুমী আক্তার আর সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্নহীন জীবন কেটে যাচ্ছে কোনোরকম।

ঢাকার ছোটবড় বস্তিতে এমন হাজার হাজার নদীভাঙা পরিবারের দুঃখগাথা পাওয়া যাবে। তারা দেখেছেন, নদীভাঙন কী করে মুহূর্তেই নিঃস্ব করে দিতে পারে শত শত পরিবারকে।

তিন বছরে দেশের প্রধান প্রধান নদীসহ ছোটবড় প্রায় সব নদীর কোথাও না কোথাও ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। গতবছরও নদীগুলোর ১৬৫৮ পয়েন্টে প্রায় ৭ শ’ কিলোমিটার বিলীন হয়েছে। এই তিনবছরে বেড়েছে নদীভাঙা উদ্বাস্তুও।

ঢাকায় প্রতিদিন ১২ হাজার

দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারা পরিবারগুলোর বেশিরভাগই ঢাকামুখী হয়। এতে রাজধানীতে চাপ বাড়ছে ক্রমাগত।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীভাঙনের কারণে ‍ঢাকায় প্রতিদিন ১২ হাজার মানুষ প্রবেশ করছে। এতে বস্তি ও ফুটপাতে চাপ বাড়ছে। দরিদ্ররা এসে সবার আগে বস্তি খোঁজে। তারপর ফুটপাতে কোথাও টুকটাক ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করে। এদের নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনা আছে। তাদের আবাসনসহ উন্নত জীবন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।’

মেয়র আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘নদীভাঙনের শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় যারা আসছেন তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার পরিকল্পনা করছে। ফুটপাত ও বস্তির চাপ কমাতে আবাসন ও কাজের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।’

তাদের ভাগ্য উন্নয়নে আশার কথা শুনিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও। তিনি বলেন, ‘সরকার গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। নদীভাঙন রোধে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। আমরা মানুষের ভিটেমাটি রক্ষা করতেও কাজ করছি।’

৫৫ হাজার পরিবার নিঃস্ব, ক্লান্ত

গতবছরের বন্যায় দেশের ২৯টি জেলায় দেখা দেয় তীব্র ভাঙন। আর তাতেই ১০৯টি উপজেলার ৫৫ হাজার ২২১টি পরিবারের জমিজমা ও বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ২০২০ সালের শেষের দিকে একটি তালিকা করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। তাতেই উঠে এসেছে এ তথ্য।

সংস্কারের জায়গা থেকেও বালু উত্তোলন

পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব নদীর তীরের সংস্কার করে, সেসব নদী থেকেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি, যাতে কোনও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা না হয়। তারপরও রাতের আঁধারে কিছু অসাধু লোক বালু তুলছে। এমনকি যেসব তীর আমরা সংস্কার করেছি, সেখান থেকেও উত্তোলন করা হচ্ছে। এটা কেবল পুলিশ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্যরা ঠেকাতে পারবে না। স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে। বাধা দিতে হবে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের এক হাজার ৬৫৮ পয়েন্টে ৬৪২ দশমিক ৯৪৮ কিলোমিটার ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ সময় মেরামত বা ভাঙন ঠেকাতে ২৮৫ পয়েন্টের ৪৬ দশমিক ৯৫৩ কিলোমিটার সংস্কার হয়েছে। যা ভাঙনের তুলনায় খুবই কম।

২০১৮ সালে ৫২৭টি পয়েন্টে ২৯১ দশমিক ২৮১ কিলোমিটার ভেঙেছিল। এর মধ্যে মেরামত হয় ১৫৭টি পয়েন্টের ২৪.৩২৫ কিলোমিটার।

২০১৯ সালের ৪০৫টি পয়েন্টে ভাঙনে ক্ষতি হয় ১৫৮ দশমিক ০৫৩ কিলোমিটার ভূমি। যার বিপরীতে ৬৮টি পয়েন্টে ১২ দশমিক ৬২৮ কিলোমিটার সংস্কার করা হয়।

২০২০ সালে ৭২৬টি পয়েন্টের ১৯৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়ে। এরপর ওই বছর ১৬০টি পয়েন্টের মাত্র ১০ কিলোমিটার সংস্কার করা হয়।

প্রতিবেশীদের উন্নয়নে বাংলাদেশে ভাঙন

ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উজানের পানিতে পলি ও বালু আসছে বেশি। এতে আমাদের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর গভীরতা কমছে।

এক জরিপে দেখা গেছে, বছরে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন থেকে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ কোটি টন পলি বাংলাদেশের নদীগুলোতে জমছে।

সম্প্রতি ভারতের মেঘালয় ও সিকিমে উন্নয়ন কাজ চলায় সেখানে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। ওই গাছের শিকড় যে মাটি আঁকড়ে ধরতো সেটাও আসছে উজানের পানিতে। এতে বর্ষায় পাহাড়ি ঢল বেড়েছে। চাপ বাড়ছে দেশের নদীগুলোর তীরে।

নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড় থেকে ঢল নেমে বদ্বীপে এলে নদীভাঙন হবেই। আমাদের এখানে নদী সবসময়ই ভাঙতো। ইদানিং বেড়েছে। তবে ডেল্টায় যদি ভাঙন থাকেও সেটা একসময় স্থিতিশীল পর্যায়ে আসার কথা। আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। ভাঙন ক্রমাগত বাড়ছে।’

 

 
 
/এফএ/
সম্পর্কিত
অসময়ে ভাঙছে ব্রহ্মপুত্রের পাড়, দুশ্চিন্তায় স্থানীয়রা
নদ থেকে অবৈধভাবে তোলা বালুতে পৌরসভার চত্বর তৈরি করছেন প্যানেল মেয়র
অসময়ে পদ্মার ভাঙনে আতঙ্কে এলাকাবাসী
সর্বশেষ খবর
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’
বিএনপির নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’